জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- দক্ষিণ আমেরিকা (আর্জেন্টিনা)লাল পাপড়ির ফুল /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- দক্ষিণ আমেরিকা (আর্জেন্টিনা)

লাল পাপড়ির ফুল 

চিন্ময় দাশ


(আর্জেন্টিনা বললেই, সবার আগে মনে ভেসে ওঠে এক পরাক্রমী গেরিলা যোদ্ধার মুখ-- চে গুয়েভারা। কিংবা ফিদেল কাস্ত্রোর নামটিও আসে মনে। আর আসে, ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা, কিংবা ফুটবল সম্রাট লিওনেল মেসির নামও। মারাদোনা আর মেসি তো এই বাংলায় এসেওছেন সামান্য কিছুকাল আগে। 

কিন্তু আমরা আজ এখানে শোনাব আর্জেন্টিনার একটি ফুলের কথা। সে ফুলের নাম-- সেইবো। ভারী করুণ এক কাহিনী আছে ফুলটিকে নিয়ে। আর, কেবল আর্জেন্টিনা নয়, সেই কাহিনী ছড়িয়ে আছে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে। কিন্তু আমরা ক'জনইবা আর জানি সেই কাহিনী! সেজন্যই কাহিনীটির বাংলা রূপান্তর করা হল এখানে।)


সে কি আজকের কথা? হাজার হাজার বছর আগের কাহিনী। এশিয়া থেকে এক দল মানুষ বেরিয়ে পড়েছিল ঘর ছেড়ে। নৌকা করে সমুদ্রে ভেসে পড়েছিল  তারা। ভবঘুরে শিকারি মানুষ সব। 

কতদিন যে লেগেছিল, অতল আর অসীম সাগরে ভেসে বেড়াতে, কে আর হিসাব রেখেছে তার? ভাসতে ভাসতে, ভাসতে ভাসতে একদিন যেখানে ডাঙায় এসে ভিড়ল, সেটা দক্ষিণ আমেরিকা। এশিয়া থেকে বহু ব-হু দূরের দেশ।

কেবলই পাহাড় আর নদী এ দেশে। ডাঙায় নেমে, এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষগুলো। আন্দিজ পর্বতমালার উপত্যকা আর আমাজন ও ওরিনাকো নদীর অববাহিকা জুড়ে যে বিরাট এলাকা, সেখানেই নিজেদের বাস গড়ে তুলেছিল তারা। তারাই প্রথম কৃষিকাজ চালু করেছিল। এতো যে বিখ্যাত 'ইনকা' সভ্যতা, গড়ে উঠেছিল তাদের হাত ধরেই।

শান্তিকামী মানুষ তারা। নতুন দেশে নাম হয়েছিল-- গুয়ারানি ইন্ডিয়ান। রেড ইন্ডিয়ান নামটা যেমন। যাইহোক, তাদেরই একটি দলের বাস ছিল আর্জেন্টিনার পারানা ব-দ্বীপে। এই দ্বীপ তাদের। এই দেশ তাদের। আর করোও না। 

এক রাজকুমারী ছিল এই উপজাতি গোষ্ঠীর। নাম-- আনাহিতা। শক্তপোক্ত আর পেটানো তামাটে শরীর। তীক্ষ্ণ আর ঝকঝকে দুটো চোখে উজ্বল দৃষ্টি। যেমন তার তেজ, তেমনি সাহস। বয়স কম হলে কী হবে, কাউকে ডরায় না মেয়েটি।

একদিন রাতের ঘটনা। ঘণ অন্ধকার রাত। আকাশে চাঁদ নাই। এমনকি নাই একটি তারাও। স্পেন থেকে ছায়ার মত একটা জাহাজ এসে ভিড়ল নদীর তীরে। জাহাজ ভর্তি একদল মানুষ। হাতে ঝকঝকে তীক্ষ্ণ ফলার তীর-ধনুক। একেবারে সিঁদেল চোরের মত এসে নেমে পড়ল দ্বীপের মাটিতে।

কোন রকম জানান নাই। আচমকাই ঝাঁপিয়ে পড়ল গুয়ারানিদের ওপর। গুয়ারানিরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। অস্ত্র বলতে তাদের কেবল ছিল কিছু তরবারি। একেবারেই সাধারণ মানের। আর কয়েকটা কাঠের দন্ড-- ক্রূশকাঠের মত আড়াআড়ি করে বাঁধা। তা দিয়ে কি আর শত্রুর মোকাবিলা করা যায়! মেয়েদের ওপর অত্যাচার হল। ক্রীতদাস করা হতে লাগল পুরুষদের। কিন্তু মাথা নত করল না গুয়ারানিরা। লড়াই করে যেতে লাগল। চোরাগোপ্তা আক্রমণ জারি রাখল। 

সব দেখে যার মন কেঁদে উঠল, সে হল তাদের রাজকুমারী-- আনাহি। দেশের জন্য, দেশের মানুষদের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠল তার। সে এসে যোগ দিল লড়াইতে। যারা লড়াই জারি রেখেছে বিদেশিদের বিরুদ্ধে, তাদের দলে গিয়ে হাজির হল সে।

দলের নেতা বলল-- রাজকুমারী তুমি! পারবে আমাদের সাথে থাকতে?

আনাহি বলল-- তোমরা যদি পারো, আমি পারব না কেন?

-- ভয়ানক কষ্ট এখানে। আর ভয় আছে জীবনেরও।

আনাহি তো অকুতোভয়, তেমনি জেদীও। হাসিমুখেই জবাব দিল-- দেশের চেয়ে, দশের চেয়ে কি ভয় বড় হল?

দলে রয়েই গেল মেয়েটি। অবশ্য দলের কাজের সুবিধাই হল তাতে। সে তো মেয়ে, তাই কিছু বিশেষ বিশেষ কাজে লাগানো যেত তাকে। শত্রুরা অনুমানও করতে পারত না অনেক সময়। 

অবশেষে সব ঠাওর হোল শত্রুদের। তারা ওৎ পেতে রইল আনাহিকে ধরবার জন্য। সেনাপতির কড়া হুকুম-- জ্যান্ত ধরে আনতে হবে মেয়েটাকে। মেরে ফেলা চলবে না কোনমতেই। 

কী দুর্ভাগ্য! সত্যি সত্যিই একদিন ধরাই পড়ে গেল আনাহি। ফাঁদ পেতেছিল শত্রুরা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটি। আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল শত্রুবাহিনী। একেবারে চক্রব্যূহের মত, তাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে একদল লোক। সবার হাতেই তীর-ধনুক।

দু'হাত পিছমোড়া করে বেঁধে, টানতে টানতে শিবিরে আনা হল তাকে। হাত-পা বেঁধে, ফেলে রাখা হল একটা ঘরে। বাইরে একজন পাহারাদার। সকাল হলে, সেনাপতি এসে বিচার করবে। 

কিন্তু আনাহি তো দমে যাওয়ার পাত্র নয় আদৌ। সারা রাত ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেল বাঁধন খোলার। অবশেষে সত্যিই তখন বাঁধন খুলতে পারল, ভোর হয়ে আসছে। বাইরে আবছা আলো ফুটতে শুরু করছে।

পোষাকের ভিতরে লুকানো ছুরিটা বের করল তানাহি। দরজা পর্যন্ত চুপিসারে এসে, আমূল বসিয়ে দিল পাহারার লোকটার বুকে। বাইরে বেরিয়ে গেল সন্তর্পনে।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। বেশি দূর সরে পড়তে পারল না মেয়েটি। হায়েনার মত ছড়িয়ে পড়ে, আঁতিপাতি করে খুঁজে, তাকে ধরে ফেলল শত্রুরা। 

রাগে গরগর করতে করতে, শিবির থেকে বেরিয়ে এল সেনাপতি।  টকটকে লাল দুটো চোখ যেন ফেটে পড়বে তার। এইটুকুন একটা মেয়ের এত আস্পর্ধা! চিৎকার করে বলল-- নিয়ে আয় ওটাকে।

টানতে টানতে একটা গাছের গায়ে এনে দাঁড় করানো হল আনাহিকে। সেনাপতি বলল-- কড়ে আঙুলের মত একটা মেয়েকে মারবার কোন ইচ্ছা আমার নাই। হাঁটু গেড়ে বোস ওখানে। তারপর মাথা নুইয়ে ক্ষমা চা। ছেড়ে দেব তাহলে।

এবার মাথা উঁচু করে মুখ তুলল আনাহি। বলল-- দেশের মাটি ছাড়া, কোন বিদেশির কাছে মাথা নোয়াই না আমরা।

রাগে কেঁপে উঠল লোকটার গলা-- কী ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে তোকে, তুই জানিস না।

আনাহির গলায় স্পষ্ট  জবাব-- কত বড় সেই শাস্তি? তোমাদের পদানত হওয়ার চেয়ে তো বড় নয়!

এবার রাগে যেন অন্ধ হয়ে গেল সেনাপতি। চিৎকার করে হুকুম করল-- বেঁধে ফ্যাল শয়তানিকে। 

গাছটার সাথে শক্ত করে বাঁধা হল আনাহিকে। শুকনো ডালপালা এনে জড়ো করা হল পায়ের কাছে।

সেনাপতি হুকুম করতে, এক তীরন্দাজ সৈনিক এসে হাজির। আনাহিকে তাক করে দাঁড়াল সে। তার তীরের ফলায় কাপড় জড়ানো। ধনুক তুলে নিশানা করতেই, একটা লোক দৌড়ে এসে আগুন ধরিয়ে দিল কাপড়ে। অমনি অব্যর্থ নিশানায় ছুটে গেল জ্বলন্ত তীরটা। শুকনো কাঠের আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল বিদেশিগুলো। টকটকে লাল আগুনের লেলিহান শিখা বড় হতে লাগল। কিন্তু এক ফোঁটা কান্না বা আর্ত চিৎকার করল না আনাহি।

আগুন নিভিল এক সময়। ছাইয়ের একটা স্তুপ পড়ে রইল কেবল মাটিতে।

কী আশ্চর্য, তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল অঝোরে। চার দিকে বয়ে যেতে লাগল বৃষ্টির জলধারা। ছাইগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। জল গড়িয়ে গেল খালে বিলে নদীতে। গোটা দ্বীপ জুড়ে। দেশ জুড়ে। নদী থেকে সাগরে গড়িয়ে গেল জল। আর সেই জলধারার সাথে, দেশের মাটির অণুতে পরমাণুতে মিশে গেল আনাহির পোড়া শরীরের প্রতিটি কণা।

তার পরদিনই একটা গাছ গজিয়ে উঠেছিল আনাহিকে পুড়িয়ে মারবার জায়গায়। একদিন ফুল ধরল সেই গাছে। লাল রঙের পাপড়ি ফুলটার। আনাহির জ্বলন্ত শরীরের সব লাল আভা যেন নিঃশেষে শুষে নিয়েছে সেই ফুল। যেমন উজ্বল টকটকে লাল রঙ ফুলের, দেখতেও তেমনি সুন্দর। গোটা গাছ জুড়ে প্রতিটা শাখায় থোকা থোকা হয়ে ফুটেছে। ফুল নয়, যেন গাছভরা জ্বলন্ত আগুনের শিখা।

বছর না ঘুরতে, সারা দেশ জুড়ে গজিয়ে উঠল সেই গাছ। ফুল ধরল গাছে গাছে। লাল রঙের যেন মেলা বসে গেল দেশে। গাঁয়ে গাঁয়ে মোড়লরা বলল-- এ তো ফুল নয়গো। এ তো আনাহি। আমাদের রাজকুমারীই ফুটে উঠেছে ফুল হয়ে।


'সেইবো' নামে ডাকা হল ফুলটিকে। মোড়লরা বলল-- বিদেশিগুলো নেহাতই বোকা। জানতো না, আঘাত করলে, জেহাদ আরও ছড়িয়ে যায়। জেদি হয়ে যায় মানুষ। জেদকে পুড়িয়ে মারা যায় কখনও? দ্যাখো না, আমাদের রাজকুমারী আনাহি, কেমন ফুল হয়ে ফুটে আছে দেশ জুড়ে!


*** সেইবো (Ceibo-- Erythrina crista-galli) : গাছ আর ফুল  

কাহিনীটার মত, সেইবো গাছ আর তার ফুলও কিন্তু বানানো কথা নয়। দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল এলাকা জুড়ে এই ফুলের বিস্তার। আর্জেন্টিনা ছাড়াও, ব্রাজিল, উরুগুয়ে বা প্যারাগুয়ের সারা দেশ জুড়ে বিপুল পরিমানে জন্মায় এই গাছ। হ্রদের তীর বা জলাভূমি এলাকায় বেশি দেখা যায় এদের। বড় বড় বৃক্ষের আকার গাছের। কুড়ি মিটার পর্যন্তও উঁচু হয় গাছগুলো। গাছের ডালগুলি দেখতে অনেকটা বিশপের বাঁকা লাঠিটির মত। এর কাঠ হালকা এবং রন্ধ্রবহুল। সেজন্য ভেলা, বিমানের মডেল বা মৌচাক বানাতে এই কাঠের ব্যবহার হয়।

নভেম্বর থেকে ফেরুয়ারি পর্যন্ত সেইবো ফুল ফোটার সময়কাল। সুগন্ধি ফুল। পথের দু'পাশে বা পার্কের ভেতর যত্ন করে লাগানো হয় এই গাছ। উজ্বল বর্ণের বিভায় আর মিষ্টি সুবাসে আমোদিত হয়ে থাকে গোটা এলাকা।

উত্তর আমেরিকার লস এঞ্জেলেস শহরে এটি 'নগর-বৃক্ষ' হিসাবে সরকারিভাবে স্বীকৃত।

বছর ৮০ আগে, ১৯৪২ সালের ২৩ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনা সরকার 'জাতীয় ফুল' হিসাবে ঘোষণা করেছে 'সেইবো'কে। অকুতোভয় আনাহি-র মৃত্যুর শত শত বছর পর। এভাবেই দেশের জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী আনাহী-র জীবনদানকে সম্মান জানিয়েছে আর্জেন্টিনা। 

দেশের জন্য আত্ম বলিদান কখনো বিফলে যায় না। ভুলে যায় না মানুষ! 


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

http://www.jaladarchi.com/2021/09/bimoksha-festival-1428-debashish-mukherjee.html



Post a Comment

0 Comments