জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-৪/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত


বাংলা সিনেমার নায়কের মতো দেখতে একটা লোক,টকটকে লাল হাফহাতা টিশার্ট যার গায়ে আর ডেনিম জিন্স,রাস্তার মানুষগুলো বিশেষ করে মেয়েরা ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল যার দিকে,রাজীব তার কাছে এসে গাড়ির গতিটা কমিয়ে দিল। ইচ্ছে করেই। লোকটার মুখ ভাল করে দেখার চেষ্টা করল সে। তরুণ কোনও অভিনেতা নয় তো! রথ দেখা আর কলা বেচা দুটো তাহলে একসাথেই হয়ে যায়। গ্রামের বাতাসে ওড়ে কলকাতার আনাচেকানাচে অভিনেতা অভিনেত্রীদের যখন তখন দেখা যায়। কথাটা যে কতখানি মিথ্যে,লোকটার মুখ দেখেই বোঝা গেল। পেছন থেকে সুঠাম আর সুদর্শন মনে হলেও মুখের সৌন্দর্য ততখানি নয়। গালভর্তি চাপ দাড়ি আর টিশার্টে গেঁথে নেওয়া সানগ্লাস,সঙ্গে নায়কোচিত স্টাইলটাই মেয়েদের চোখে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। যাতে কোনওরকম অপ্রস্তুতে না পড়তে হয়,রাজীব তাই ওকেই জিগ্যেস করে,"দাদা,বেলভিউ হাসপাতালটা কোন্ দিকে?"
লোকটা ইংরেজিতে পথনির্দেশ দিল কিন্তু  রাজীব তা বুঝতে পারল না। বড় শহরের এই এক সমস্যা। নানান জন নানান ভাষায় কথা বলে।
     গাড়ির ভেতরে বসে কলকাতাকে দেখছিল কাঞ্চনা আর পাপিয়া। এভাবে কি কখনও মহানগর দেখা যায়? চোখের নিমেষে কত কিছু দ্রুত সরে যাচ্ছে। আড়ালে থেকে যাচ্ছে দৃষ্টির। আজ কত বছর ধরে চয়নদা কলকাতায়। গৃহপ্রবেশের সময় কত করে অনুরোধ করেছিল একবার আসতে। আসা হয়নি। অথচ চাইলে সহজেই আসতে পারত। চয়ন বলেছিল,"কলকাতার কিছু উল্লেখযোগ্য জায়গা তোমাদের ঘুরিয়ে দেব। যেগুলো নিয়ে আমরা ভারতবাসী গর্ব করি। বিশ্বের কাছে যেগুলো দৃষ্টান্ত।" কাঞ্চনা,পাপিয়া নাহয় মেজকাকার বউমা। বড় বউদি হয়ে সেদিন সুমিত্রাও কি যেতে পারতেন না একবার? যাননি। অয়ন পর্যন্ত  ভাইয়ের নতুন বাড়িতে পা দেননি। "সময় পায়নি রে ভাই। একা মানুষ। সবদিক সামলে উঠে যাওয়াটাই সমস্যা। তার ওপর অতদূর রাস্তা। ওদিকটার আমি কিছুই যে চিনিনা। বাড়ি যখন করেছিস,একদিন না একদিন তো যাবই। তোর বাড়িতে আমি যাব না,তা হয় কখনও?"

চয়ন এই সেদিনও বলেছিল,"তোমরা শুধু কলকাতায় নেমে আমাকে একবার ফোন করে দেবে। আমি নিজে গাড়ি নিয়ে গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসব। জায়গাটার নাম বললেই হবে,কোথায় নেমেছ।"
হয়তো কোনও কোনও বার সময় হয়েছিল অয়নের,যাওয়ার জন্য মনের দিক থেকে তৈরিও হয়েছিলেন,সুমিত্রাই রাজি হননি। "এখন থাক না,পরে না হয় একদিন......চয়নের বাড়ি তো পালিয়ে যাচ্ছে না!"
     বেলভিউ যাওয়ার রাস্তাটা এখনও খুঁজে পেল না রাজীব। রাকেশ জিগ্যেস করল একে তাকে,সজলও জানতে চাইল এর তার কাছে,কারও কথাই ঠিকমতো বুঝতে পারল না ওরা। শেষে এক ট্র‍্যাফিক পুলিশকে জিগ্যেস করতে তিনি বললেন,"কলকাতা সতেরোতে চলে যান।"

তাও বুঝতে অসুবিধে হল ওদের। অগত্যা ঋষভকে ফোনে ধরলেন অয়ন।"আমি জেঠুমণি বলছি রে ঋষভ। আমরা কলকাতায় পৌঁছে গেছি। যেতে অসুবিধে হচ্ছে। হাসপাতালটা ঠিক কোন জায়গাটায় বল্ তো?"
ঋষভ ফোনে বলল,"এলগিনে এসো জেঠুমণি। লওডন স্ট্রিট। ওখানটাতেই বেলভিউ।"
"ঠিক আছে।" ঋষভকে আর কিছু বললেন না অয়ন। ছেলেটার গলার স্বর শুনে মনে হল,মনটা বেশ খারাপ। খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সবেমাত্র চাকরিতে  জয়েন করেছে ঋষভ। দু বছর এখনও হয়েছে কি হয়নি সন্দেহ। কতটুকুই আর বয়স ছেলেটার! বাইশ তেইশ। প্রথম থেকেই চয়নের লক্ষ্য ছিল ছেলেটাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর। আজকাল ইংলিশে দক্ষতা না থাকলে কোথাও ভাল কাজ পাওয়া যায়না। বাবার মুখ রেখেছে ঋষভ। 

"ঋষভ কোথায় চাকরি করে যেন দাদা?" রাজীব জিগ্যেস করে।
"ও এখন দিল্লীতে থাকে। চয়ন তাই তো বলেছিল।" অয়ন বললেল।
"মাসে মাইনে কীরকম পায়?" কাঞ্চনা আগ্রহ দেখায়।
"তা তো আমি বলতে পারব না বউমা। হাজার তিরিশ হবে হয়তো। চাকরি পেয়ে ঋষভ দেশবাড়িতে আর গেল কই? একবার একবেলার জন্য বাবার সাথে এসেছিল। তখনও ও দিল্লীতে যায়নি। চাকরিটা হয়ে গেছে,সবেমাত্র এই খবরটুকু পেয়েছে। ওর জেঠুমণিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিল। ছেলে মেয়ের প্রতি চয়নের শিক্ষা দীক্ষাটাই এরকম। ঋষভকে নিয়ে এসে বলেছিল,'বাবা মা তো আশীর্বাদ করবেই। জেঠুমণি জেঠিমার আশিস পাওয়াটাও কম কথা নয়।' চয়নটা বরাবরই এরকম।"
কথাগুলো শুনতে পাপিয়া কাঞ্চনার ভাল লাগছিল না। লোকদেখানো অমন ভালমানুষি অনেকেই করে। ওসব আসলে দর্প। ছেলেকে দাঁড় করিয়েছে,গাঁয়ের দশজনকে বোঝাতে হবে না? তেমন ভালমানুষ হলে খুড়তুতো ভাইগুলোর বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারত। যায়নি। তখন ওর জ্ঞানটা টনটনে। নিজের দাদা আর কাকার ছেলের হিসেব করতে জানে। আদিখ্যেতা যত!
"চয়নদার মেয়েটার কী নাম যেন?" পাপিয়া জিগ্যেস করল।
"ঐশী বোধহয়। তাই না দাদা?"
অয়ন বললেন,"হ্যাঁ,ঐশী। ওটা ওর ভাল নাম কিনা জানিনা। ঐ নামেই তো সবাই ডাকে। ভাল নাম হয়তো আছে একটা।"
"ও তো পড়াশুনো করে,না?" পাপিয়া বলে।
"হ্যাঁ,শুনছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কী নিয়ে যেন পড়ে। ও-ও চাকরি পেয়ে যাবে। মাথা ভাল। ছোট থেকেই মেরিটোরিয়াস। ছেলে মেয়েদের নিয়ে খুব গর্ব করে চয়ন। নিজে সেরকম তো কিছু সুযোগ পায়নি। ছোট থেকেই শুধু লড়াই আর লড়াই।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অয়ন। দেখলেন সুমিত্রা চুপ। ও যখন বাড়িতে বউ হয়ে এল,চয়ন অনেক ছোট। এক্কেবারে ছোট। সুমিত্রা চয়নকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছেন বলেই হয়তো আজকের খবরের ধাক্কাটা সহজে মেনে নিতে পারছেন না। তার ওপর মিলির চিন্তা। মিলিকে দেখভাল করার মতো মানবিক শিক্ষা চয়ন ছেলেকে কোনওদিন দিয়েছে কি? বলেনি,মিলি তোর দিদি। ওর ভাগ্যটা ভাল নয়। ভাই হয়েও দাদার মতো আগলে রাখতে হবে ওকে!

      কলকাতার যানজটে তিন তিনবার  পড়তে হল গাড়িকে। এখন আবার ছুটছে। রাস্তায় হেঁটে চলা ছোট পোশাক পরা ঊনিশ কুড়ি বছরের মেয়েগুলোকে দেখে পাপিয়া আর কাঞ্চনা ঐশীকে ভাবে। চয়নদার  মেেয়েটা কি এরকমই আধুনিক? কলকাতায় বাড়ি,যাদবপুরের হস্টেলে থাকে কেন? প্রেম করে নাকি ঐশী? চয়নদা আর বউদির মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলে বেশ হয়।মেরিটোরিয়াস মেয়ের সেরা কীর্তি হবে সেটা। ভাবতে গিয়ে মনে মনে হাসে বংশীধারীর বউমাদুটো।

      গাড়ি যখন বেলভিউ নার্সিংহোমের সামনে এসে দাঁড়াল,অনুপম,কাবেরী,কুন্তলা,কুন্তলার স্বামী শশাঙ্ক সবাই  এসে পৌঁছে গেছে। দেশ থেকে আসা জেঠুমণি,জেঠিমাকে দেখে কাছে এগিয়ে এল ঋষভ আর ঐশী। এগিয়ে এল বৈশাখী। সুমিত্রাকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। অয়ন জিগ্যেস করলেন,"নিখিলেশ কই বউমা? ও আসেনি? খবর দিয়েছিলে ওকে?"
চোখের জল মুছে বৈশাখী বলল,"আজ অনেকদিন ওর সাথে কোনও যোগাযোগ নেই দাদা। যে ফোন নম্বরটা একসময় দিয়েছিল,ওটা আজ রং নাম্বার বলে।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments