জ্বলদর্চি

প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলী মিত্র। শ্রদ্ধা ও স্মরণে আসুন পড়ে নিই তাঁরই লেখা 'স্মৃতির অভিজ্ঞান'

প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলী মিত্র। 

জ্বলদর্চির আপনজন। নিয়মিত লেখা দিতেন। শ্রদ্ধা ও স্মরণে আসুন পড়ে নিই তাঁরই একটি লেখা। 
🙏



স্মৃতির অভিজ্ঞান

শাঁওলী মিত্র 
(১৯৪৮-২০২২)

জ্বলদচির সম্পাদক যে বিষয়টি এই সংখ্যার জন্য চয়ন করেছেন তা অনুধাবন করে মনে হল – ‘স্মৃতি'র সঙ্গে সঙ্গে আর একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয় আমাদের মনে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে - সে হল 'অভিজ্ঞতা। যে-স্মৃতি এক অভিজ্ঞতা তৈরি করে সেই স্মৃতি আমাদের মনোভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়ে আমাদের ঋদ্ধ করে। আর যদি তা কখনো করে, অর্থাৎ সেই সৌভাগ্য হয় আমাদের মতো কারোর তখনই তার ছায়া হয়তো পড়তে পারে তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে। তা সাহিত্য হতে পারে, হতে পারে গান – সুরে এবং কথায়, হতে পারে। আবৃত্তি বা অভিনয়।

কেন বলি। আমি তো বেশ কিছু বছর অভিনয় করেছি। আবৃত্তিও করেছি। আবার অভিনয়ের সূত্রে গানও গাইতে হয়েছে, প্রয়োগ করতে হয়েছে নৃত্যের আঙ্গিক। বা ধরা যাক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিভঙ্গ। সবই তো ভাষায় পরিণত হয়ে শ্রোতা বা দর্শকের কাছটিতে পৌঁছয়। সমস্ত ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়েছে আমার সেই অগোচরে সঞ্চিত ধন আমাকে প্রবলভাবে সত্যনিষ্ঠ হতে সাহায্য করেছে।

আবার কোথাও না কোথাও আমার 'স্মৃতি', আমার 'অভিজ্ঞতা' --আমাকে ‘কল্পনা' নামক একটি অতীব প্রয়োজনীয় উপাদানকে গ্রহণ করতে এবং তা আমার সৃষ্টির প্রয়াসে সহায়ক হয়েছে। তাই স্মৃতি বোধ করি শুধু স্মৃতিতেই আবদ্ধ নয়। তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা এবং কল্পনা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যদি অবশ্য তার সঙ্গে শিল্পসৃষ্টির কোনো সংযোগ আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

এ এক অদ্ভুত খেলা। আমরা খেয়াল করলেই বুঝতে পারি অনেক টুকরো-টুকরো ছবি আমাদের মনের মধ্যে আমাদের অজান্তে ভেসে ভেসে ওঠে। সে-ছবি সবসময়ে হয়তো বাস্তব থেকে আহৃত নয়। কিছু হয়তো বাস্তব। আর কিছু কি পরাবাস্তব? বা বিমূর্তও কখনো কখনো? ধরা যাক স্বপ্নের কথা। আমাদের মধ্যে অত্যন্ত বাস্তববাদী কেউ হয়তো এমন স্বপ্ন দেখে ফেলতে পারি, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সঙ্গতি নেই। বরং বিপ্রতীপে তার অবস্থান।

যেমন বলি, কেউ হয়তো স্বপ্ন দেখলেন – একটি ষাঁড় কলাগাছে উঠছে। তার কারণ তার খুব খিদে পেয়েছে। তাই কদলী সংগ্রহের আশায় সে কদলীবৃক্ষে উঠতে শুরু করেছিল। কিন্তু সে-ওঠা আর শেষ হয় না। সেই কলাগাছ নাকি এতই লম্বা যে সে আর কলার সন্ধানই পাচ্ছে না! কলাগাছে নাকি এতই কাঁটা যে বেচারি ষাঁড়ের গা-পা ছড়ে যাচ্ছে। তবু সে তার খিদে মেটাবার কোনো উপায় পাচ্ছে না। যাকে বলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। তারপরে উঠতে, উঠতে, উঠতে উঠতে – অনে-ক উঁচুতে উঠে – সে একটা মোটে কলা পেল। মোটে একটাই। স্বপ্নেরও বলিহারি যাই!

এই যে কল্পনা – মানে, কল্পনার মধ্যে তো স্মৃতি থাকাই স্বাভাবিক – তা এই 'কহানি'র মধ্যে কোন্ স্মৃতি থাকা সম্ভব? কারণ ‘স্মৃতি’র মধ্যে তো বাস্তবের ভিত্তি থাকেই। আর যে-কেউ বুঝতে পারবেন এই কল্পনার মধ্যে কোনো বাস্তবের সংস্রব নেই মোটেই। – কিন্তু একেবারেই কি নেই? আছে! বড়ো রুক্ষ বাস্তব। সে-বাস্তব লুকিয়ে আছে ঐ খিদের মধ্যে। খিদে এবং খিদে মেটাবার বস্তু মুখের সামনে না-পাওয়া, এবং তার জন্যে জীবনের সঙ্গে এমন লড়াই যে ক্ষত-বিক্ষত এবং রক্তাক্ত হয়ে যাওয়া। সেই অতীব কঠিন বাস্তবটি --তথা এক প্রকার অভিজ্ঞতা-- হয়তো হয়তো, হয়তো, প্রচ্ছন্ন রয়েছে এই অদ্ভুতুড়ে স্বপ্নে! তাতে শিল্প নেই নিশ্চয়ই, কিন্তু বাস্তবের কাঠিন্য আছে।

তাই পরস্পর-সম্বন্ধিত এই 'স্মৃতি-অভিজ্ঞান-কল্পনা' পরস্পরে লীন হয়ে আছে বুঝি! আমাদের মনের মধ্যে এই সমস্ত ভাবগুলি কেমন করে যে প্রবল যন্ত্রণার ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে মথিত করে তোলে আমাদের! আমাদের দেহের তন্ত্রী যত সব টানটান হয়ে ওঠে! আমাদের অজান্তে কোন গ্রন্থি থেকে কখন কোন রসক্ষরণ হয় তা কি টের পাই আমরা ? আর তাই আমরা যখন তা প্রয়োগ করি কে যে কাকে কখন অতিক্রম করে যায় তা কি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি ? তাই যখন এই তিনের সম্মিলিত প্রভাব পড়ে কোনো শিল্পীর রচনায় – তখন তাতে থাকে ব্যঞ্জনার ছোঁয়া! সেই ব্যঞ্জনার সুপ্রয়োগেই শিল্প হয়ে ওঠে 'শিল্প' ---সাহিত্যে বা গানে-আবৃত্তিতে বা অভিনয়ে! বা নৃত্যবিভঙ্গে!
(জ্বলদর্চি, স্মৃতি: প্রসঙ্গ ও প্রয়োগ বিশেষ সংখ্যা, ২০১৫)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments