জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৬৯

সম্পাদকীয়,
সরস্বতী পুজোর রেশ কাটেনি। সবাই নিশ্চয়ই নিজেদের স্কুলে স্কুলে ঠাকুর দেখে এসেছো? প্রচ্ছদের ছোটো বন্ধুর মতো মাস্ক পরে গেছিলে তো? সোনা বন্ধু তোমরা। তাই তো মৃণাল আঙ্কেল লক্ষ্মীসোনা এক ছোটো বন্ধুর ছবি তুলে পাঠিয়েছে। যারা স্কুলে যাবার অনুমতি এখনও পাওনি তাদের বলি মন খারাপ কোর না। তোমাদের মতো ছোটো বন্ধু জয়াবতীও স্কুলে যেত না। কেন? সেটা জানতে তোমাদের পড়তে হবে তৃষ্ণা আন্টির নতুন উপন্যাস জয়াবতীর জয়যাত্রা। সরস্বতী পুজোর আমেজ এখনো কাটেনি তাই ছোটোবন্ধু স্নেহা আমাদের দেবী সরস্বতীকে এঁকে পাঠিয়েছে। সেই আনন্দে আমরা মুক্তি জেঠুর আর সুব্রত আঙ্কেলের লেখা ছড়া গুলো পড়ে নি।  জয়াবতীর জন্য না হলেও পরবর্তীকালে জয়াবতীর মতো মেয়েদের জন্য অনেক শিক্ষাব্রতী মানুষ স্কুল স্থাপন করেছেন। এমন একজন পন্ডিত শিবনাথ ভট্টাচার্য। আরে না আমি ভুল বলিনি যিনি শিবনাথ ভট্টাচার্য তিনিই শিবনাথ শাস্ত্রী, সেটা কেমন করে হল তা আমরা জেনে নেব মানস আঙ্কেল আর পীযূষ আঙ্কেল বলেছেন তাঁর জীবনী। তোমাদের  স্নেহা দিদি তাঁর লেখা কবিতা আলোচনা করে আর সুস্মিতা দিদি তাঁর প্রতিকৃতি এঁকে সদ্য চলে যাওয়া তাঁর ১৭৫ তম জন্মদিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমাদের। এসো আজ শুভদিনে আমরা ছোটোবেলার পাঠক লেখক ও বন্ধুরা জয়াবতীর জয়যাত্রা, সরস্বতী পুজো আর শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্মদিবস কে স্মরণ করে এক ত্রিবেণী ধারা বহে নিয়ে চলি। চলে কোথায় যাব? কেন কেরালা। কি খুশি তো?  -- মৌসুমী ঘোষ।


ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
( পর্ব ১)
তৃষ্ণা বসাক
 

বোলসিদ্ধির বুড়োশিবতলায়
ডুরে শাড়ি কোমরে জড়ানো, এক ঢাল চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে, ছোট্ট কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে যেন মুকুতা, খল নুড়ির ওপর ঝুঁকে রয়েছে সমস্ত শরীর, জগত সংসারের কোন দিকেই তার হুঁশ নেই। কালীগতি এত কাছে থেকে দুবার ডাকলেন ‘জয়া, জয়া মা’, তা শুনতেই পেল না সে। কালীগতি এবার ওর মাথায় হাত দিয়ে ডাকলেন ‘জয়া জয়া’ জয়া চমকে তাকাল। তার মুখে ফুটে উঠল অপূর্ব এক হাসি।
‘আপনি ডাকচেন পিতাঠাকুর?’
‘আমি ডাকিনি, তোমার মা তোমাকে অনেকক্ষণ থেকে ডাকছেন। শুনতে পাও নি তুমি?’
‘না পিতাঠাকুর। মা কেন ডাকচেন? এই তো তাঁর শাক বেছে, লাউ কেটে দিয়ে এলাম’
‘দুর্গাগতি উঠে পড়েছে, কান্না শুনতে পাচ্ছ তো? তোমার মা তাই ওকে একটু খেলা দিতে বললেন, তিনি রন্ধন ছেড়ে আসতে পারছেন না’
জয়া মুখের এক অপরূপ ভঙ্গি করে বলল ‘শিশু ঘুম ভেঙে উটে মাকেই খোঁজে পিতাঠাকুর। ওর খিদে পেয়েচে, মাকেই যেতে হবে। রন্ধনের এত তাড়া কীসের? কেউ তো কাচারি যাচ্চে না। আমি বলি কি, খেলা দিতে হয়, আপনিই দিন। আপনার ছাত্ররা তো একনো এসে পড়েনি। দেকচেন তো আমি আপনারই জন্যে কালি তৈয়ারি করচি, একন ফেলে গেলে সব নষ্ট হবে’
কালীগতি তর্করত্নকে বলছে কিনা গিয়ে ছেলের সঙ্গে খেলা করতে! এই বোলসিদ্ধি গ্রাম তো দূর, আশেপাশে দশটা গ্রামের মানুষের সাধ্য নেই তাঁর মুখের ওপর কথা বলে, নবদ্বীপ, কাশী কোথায় না পৌঁছেছে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি। স্ত্রীও ঘোমটার আড়ালে যাই বলুন, উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস নেই। একমাত্র এই মেয়েই...
কেন যে একে গৌরীদান করেননি পাঁচ বছরে? এ নিয়ে প্রায়ই দুর্গাগতির মা তাঁকে মৃদু গঞ্জনা দ্যায়। মেয়ে যে খারাপ তা না, অবাধ্যও বলা চলে না, বরং কাজেকর্মে সে অতি দক্ষ। যে কাজই করে, নিখুঁত করে করে। সেখানে কারো কিছু বলার যো থাকে না। কিন্তু মেয়ে বড় জেদী। নিজের শর্তে কাজ করে সে। শত ডাকাডাকিতেও যে এই কাজ ছেড়ে সে উঠবে না, তা বোঝাই যাচ্ছে।
কালীগতি চেয়ে দেখেন খল নুড়িতে কালো মতো একটা পদার্থ ঘুঁটছে জয়াবতী। ঐ তাঁর পুঁথির কালি। অনেক রকম বস্তু মিশিয়ে ওটি তৈয়ারি করতে হয়। মিশ্রণের অনুপাত সবাই বোঝে না। কিন্তু জয়াবতীর হাতের তৈয়ারি কালি বড় উত্তম হয়, তাতে লিখে সুখ। এই কালি তৈয়ারির একটি ছড়া আছে।
‘তিল ত্রিফলা শিমূল ছালা
ছাগ দুগ্ধে করি মেলা
লৌহ পাত্রে লোহায় ঘষি
ছেঁড়ে পত্র না ছাড়ে মসী’
এই ছড়াগুলি তৈয়ারি হয়েছে যাতে নিরক্ষর মানুষ কালি তৈয়ারির সূত্র মনে রাখতে পারে, যেমন তাঁর এই কন্যা। দুই পুরুষ আগে তাঁদের বংশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী নামে দুই কন্যা জন্মেছিল। দেবগতি তর্করত্ন ছিলেন মহাপণ্ডিত, তাঁর কাছে নিয়মিত কাশী থেকে পণ্ডিতেরা আসতেন নানান কূটপ্রশ্নের মীমাংসা করতে, কখনো কখনো তর্কযুদ্ধ হত, একবার এই লক্ষ্মী সরস্বতী কাশীর মস্ত পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল। মেয়েমানুষের এত বাড়! দেবগতি নাকি তৎক্ষণাৎ তাদের বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন, তারা চলে গিয়েছিল কাশীতে, সেখানে নাকি তারা টোল খুলে বসেছিল। সত্যি মিথ্যে জানা নেই অবশ্য। তবে তার পর থেকে আর এ বংশে মেয়েদের অক্ষর পরিচয়ও করানো হয় না। 
রটিয়ে দেওয়া হয়েছে মেয়েরা পড়াশোনা শিখলেই তারা বিধবা হবে। এই শুনে কোন মেয়ে আর পড়াশোনা শিখতে চাইবে? কিন্তু আজ জয়াবতীর খল নুড়ির ওপর ঝুঁকে পড়া তন্ময় রূপ দেখে তাঁর কেমন অপরাধবোধ হল। কি দক্ষতায় মিশ্রণটি প্রস্তুত করছে, এর সঙ্গে যদি ওর একটু বিদ্যা থাকত!
তাঁদের  দেশের এই এক রোগ। হাতের কাজকে বড় ছোট করে দেখা হয়। এই হাতের কাজ যারা করে, তারা সব নিচু জাতের মানুষ- কামার, কুমোর, ছুতোর, চর্মকার। এদের কর্মদক্ষতার সঙ্গে যদি পেটে একটু কালির জল থাকত, তাহলে এরাই হত আগেকার চরক সুশ্রুত আর্যভট্টের মত বিজ্ঞানী।
একটা সময় তাঁদের ঘরের মেয়েরাও কত হাতের কাজ করত, বাইরেও অবাধে যাতায়াত করত। মুসলমান জুজুর ভয় দেখিয়ে তাদের রান্না আর আঁতুড়ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।
চরক সুশ্রুতের কথায় মনে পড়ল একটি ভিষক পুথি তাঁর হাতে এসেছে। কোন রচয়িতার নাম নেই। বিভিন্ন অসুখের ওষুধ কীভাবে হাতের কাছে পাওয়া উপকরণে তৈয়ারি করতে হবে তা লেখা আছে। এতে গরিব মানুষের উপকার হবে। চিত্র করা এই পুঁথিটি সামান্য কড়ির বিনিময়ে একজন বিক্রয় করে গেল। তাকে তিনি চেনেন না। ভবঘুরে মানুষ একজন।  অতি মূল্যবান এই পুঁথি। তিনি কী করবেন এটি নিয়ে? তাঁর এক বন্ধু আছে, বৈদ্য, সে পেলে উপকার হত। 
 
জয়াবতীকে যদি তার কাছে শিক্ষানবিশি করানো যেত! তা হবার নয়। ওর মাতা মেয়ের বিয়ের জন্যে মাথা খেয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের সমান কুল শীলের পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না এই অজুহাতে তিনি কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছেন বিয়ে। আসলে এই কন্যা তাঁর গলার মালা। একে চোখের আড়াল করতে চান না তিনি।
দুর্গাগতির কান্নার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না, কালীগতি উঁকি মেরে দেখলেন দুর্গার মা ছেলে কোলে দুধ খাওয়াচ্ছেন, ছেলে খাবার পেয়ে চুপ করে গেছে তাই। তাঁর মুখে ফুটে ওঠে কৌতুকের হাসি। মেয়ের কথা তাহলে কানে গেছে মায়ের। রান্না ফেলে তিনি ছেলেকে খাওয়াতে এসেছেন। কালীগতি ভাবেন একটি ভালো রাঁধনির সন্ধান করবেন, তাহলে ছেলেটাও মায়ের যত্ন পাবে আর জয়াকেও বারবার ডাকাডাকি করতে হবে না। ( ক্রমশ)


শিবনাথ ভট্টাচার্য থেকে শিবনাথ শাস্ত্রী:এক যাত্রাপূরণের কাহিনি

মানস শেঠ

১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দের একত্রিশে জানুয়ারি। রবিবার। চাংড়িপোতা গ্রামে মামারবাড়িতে জন্ম হয় ছোট্ট শিবনাথ ভট্টাচার্যর । বহুদিন পর সেই বাড়িতে এলো কোনো শিশু। মামা দ্বারকানাথ ছোট্ট শিবনাথের কপাল দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন ,''এ ছেলের যে কপাল দেখছি , বেঁচে থাকলে বড়লোক হবে ।''শিবনাথের ছ'মাস বয়সে তাঁকে নিয়ে মা গোলোকমণি দেবী শ্বশুরালয় মজিলপুরে এলেন । সেখানে ছিলেন  প্রপিতামহ অতিবৃদ্ধ রামজয়,সমাদরের সঙ্গে তাকে গ্রহণ করলেন। কিন্তু শিশু শিবনাথকে হিংসা করতে শুরু করলেন তাঁর বড় পিসি আনন্দময়ী। তাতে রেগে গোলোকমণি দেবীও পুত্রের যত্ন নিলেন না । মায়ের উপেক্ষায় শৈশব থেকেই শিবনাথ রুগ্ন হয়ে পড়লেন । এই রুগ্নাবস্থার কথা বড় হয়ে তিনি বন্ধু - বান্ধবদেরও বলতেন । ক্রমে তাঁর বয়স হল চার বছর। কিছু ঘটনার বীজ শৈশবে প্রবিষ্ট থাকে।ভবিষ্যতে তিনি যে পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণ বর্জন করবেন , এমন ইঙ্গিত কিন্তু তিনি শৈশব থেকেই দিয়েছিলেন ।শিশু শিবনাথের পরিবারে নিয়ম ছিল যে , গৃহদেবতাগণকে নিবেদন না করে কেউ আহার গ্রহণ করতে পাবেন না । কিন্তু ছোট শিবনাথ অতি শৈশবেই ঠাকুরের ' উচ্ছিষ্ট ' গ্রহণ করবেন না বলে পণ করেছিলেন,অবশ্য এজন্যে তাঁকে নিপীড়নও কম সহ্য করতে হয় নি ।
  পাঁচ বছর বয়সে হাতেখড়ি হলো তাঁর।মজিলপুরে বসুদের বাড়িতে এক পন্ডিতের কাছে তিনি ভর্তি হলেন।পন্ডিত আসতেন বর্ধমান থেকে। মায়ের ব্যক্তিগত যত্নে ও অসাধারণ মেধার সাহায্যে শিবনাথ লেখাপড়ায় উন্নতি করতে লাগলেন । বাল্যকাল থেকেই পড়াশুনো ও পড়ার সাজ - সরঞ্জামের উপর তাঁর প্রখর যত্ন ছিল । পাঠশালার নির্দিষ্ট পাঠ‍্যক্রম ছাড়াও তিনি বাড়ীতে রামায়ণ পড়তেন । তাঁর মা প্রায় প্রতিদিন দুপুরবেলা রামায়ণ পড়তেন এবং শিবনাথকে শেখাতেন।
কাজেই সমবয়সী সহপাঠীদের চেয়ে শিবনাথের প্রতিভা অধিকতর প্রকাশ পেয়েছিল । শৈশবের এই গভীর পাঠানুরক্তির অনুসরণ তাঁর শেষ জীবনেও আমরা লক্ষ্য করি । কিছুদিন এখানে পড়ার পর গুরুমশাইয়ের আচরণের জন্য শিবনাথের মা তাকে পাঠশালা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন,ভর্তি করালেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে মজিলপুরে যে আদর্শ বাংলা স্কুল স্থাপিত হয়েছিল সেখানে।  সেখানে তিনি পড়তে লাগলেন, ' স্কুল বুক সোসাইটি ' প্রকাশিত ' বর্ণমালা' এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কারের নবপ্রকাশিত 'শিশুশিক্ষা'।১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি শিবনাথ পা রাখেন কলকাতায়।

 শিশুকাল থেকেই শিবনাথের পশুপ্রেম দেখা গেছিল, সেকথা পরবর্তী সময়ে তাঁর উপন্যাসেও দেখা গেছে। ঘরের রূপী বেড়ালকে নিয়ে তিনি  শুতেন।পিঁপড়ের কথা শোনার জন্য তিনি বহু সময় খরচ করতেন ।আকর্ষণ বোধ করতেন ‘ রবা ’ কুকুরের প্রতি।এমনকি ' টুনো ' নামে শালিখ পাখীটিকে উড়িয়ে দেওয়ার অপরাধে তিনি নিজের পত্নীকে পর্যন্ত বিদায়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। জীবজন্তুর প্রতি এই প্রীতিই শিবনাথকে প্রকৃতি প্রেমিক করে তুলেছিল । তাছাড়া শিবনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন যে,এর মধ্য দিয়ে তাঁর মনে অনুসন্ধিৎসা - প্রবৃত্তি এবং তন্ময়তা গড়ে উঠেছিল।বাল্যকাল থেকেই শিবনাথ আমুদে ছিলেন । পাড়ায় রামায়ণ গান শুনে তার অনুকরণে একদল বাল‍্যসঙ্গী নিয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে রামায়ণ গান গাইতে শুরু করেন । নির্দোষ সরল শিবনাথের এই আমোদ - প্রবণতার কথা প্রসঙ্গে তাঁর সহপাঠী দীননাথ দত্ত লিখেছেন , "শিবনাথ বাল্যকালে বড় আমোদপ্রিয় ছিলেন , একটা আমোদ করবার কিছু পেলেই ছুটে যেতেন।"বাক্- পটুতাও শিবনাথের স্বভাবসিদ্ধ গুণ ছিল । শৈশবের এই বাক্‌-পটুতাই সম্ভবতঃ উত্তরকালে তাঁকে শ্রেষ্ঠ বাগ্মীরূপে পরিচিত করেছিল।অবশ্য বাল্যকালে এই বাচালতার জন্য তাঁকে গঞ্জনাও কম সহ্য করতে হয়নি ।তাঁর একটা ডাকনামই হয়ে গিয়েছিল ' শিবে জেঠা '।

১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতার চাঁপাতলায় সিদ্ধেশ্বর চন্দ্র লেনের ‘ মহাপ্রভুর বাড়ী ' - তে মাতামহ হরচন্দ্র ন্যায়রত্নের বাড়িতে এসে তিনি উঠলেন।শুরু হলো তাঁর যথার্থ কঠিন শিক্ষাজীবন। 
 পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত তিনিও  'বিদ্যাসাগর ' উপাধিতে ভূষিত ছিলেন।সেকথা আর জানেই বা কজন! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন যে , যে যুগ অনিবার্যভাবে এসে পড়েছে , তাতে শুধুমাত্র সংস্কৃত শিখে আহার জোগাড় সম্ভব নয় ।তাঁর মাসিক উপার্জন ছিল মোটে পঁচিশ টাকা । সেই কারণে হরানন্দ পুত্রকে ইংরেজি শিক্ষা দিতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন। ভর্তি করলেন সংস্কৃত কলেজে। উনিশ শতকের বিখ্যাত ব্যক্তিগণের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্র ,অথচ শিবনাথ ভর্তি হলেন সংস্কৃত কলেজে,আসলে হরানন্দের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে ডেভিড হেয়ারের স্কুলেই ভর্তি করার । কিন্তু প্রধানতঃ দুটি কারণে তা সম্ভব হয়নি; এক , ডেভিড হেয়ারের স্কুলে পড়ানো ছিল ব্যায়সাধ্য - পঁচিশ টাকা মাইনের পণ্ডিতের পক্ষে তা জোগানো অসম্ভব ছিল । দুই , সংস্কৃত কলেজে ছিলেন তাঁর  বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,তাই তাঁর অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না হরানন্দ। সেই সময় বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজেও ইংরেজি পঠন - পাঠনের জন্য একটা বিভাগ খুলেছিলেন । আর শিবনাথের মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন ঐ সংস্কৃত কলেজেরই অধ্যাপক । সুতরাং শিবনাথ সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়ে গেলেন । সংস্কৃত কলেজে পাঠের ফলে শিবনাথের জীবন কিছুটা ফলপ্রসূ হয়েছিল । পরবর্তী জীবনে শিবনাথকে যে শারীরিক , মানসিক ও আর্থিকভাবে কঠিন জীবনযাপন করতে হয়েছিল , তা সহ‍্য করার মতো শক্তি সঞ্চয়ের ভিত্তি এখানেই গড়ে উঠেছিল । কলকাতার বাড়িতে থাকার সময় তাঁকে রান্না করে ,সুদুর ভবানীপুর থেকে হেঁটে সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনো করতে হয়েছে।বিদ্যাসাগরের সংস্পর্শে আসার জন্য,তিনি কিশোরবয়স থেকেই মেতে উঠলেন বিধবাবিবাহ আন্দোলনে।আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তাঁর প্রবল।সেইসময় বিদ্যালয় পরিদর্শক উড্রো সাহেব শিবনাথকে চটি খুলে রাখার নির্দেশ দেন,শিবনাথ এই কারণের যুক্তি খুঁজে পেলেন না।প্রতিবাদ করলেন।সেইসময়কার পত্রিকা 'সোমপ্রকাশ'এ এই খবরটি প্রকাশ হয়েছিল।
   ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ।প্রিয়নাথ চৌধুরী নামে একজন  মজিলপুরে একটি বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করেন।তিনি মারা গেলে বিদ্যালয়টির পরিচালন ভার নেন গ্রামের ব্রাহ্মভাবাপন্ন যুবকেরা। মজিলপুরের জমিদারগণ এর বিরোধিতা করেন এবং শেষ পর্যন্ত আদালতে জমিদার পক্ষ পরাজিত হন । শিবনাথের চোখে এই ব্রাহ্মযুবকগণ আদর্শ স্থানীয় ছিলেন । ফলে শৈশবেই শিবনাথের মধ্যে একটা ব্রাহ্মভাব পরোক্ষে প্রবিষ্ট হয়েছিল । এই সময়ে শিবনাথের প্রথমবার বিবাহ হয় । ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে গৃহীত প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে 'সেকেন্ড গ্রেড স্কলারশিপ ' পেলেন । কলেজেও প্রথম হলেন ।পরীক্ষাদানের পূর্বে শিবনাথ তাঁর এক বন্ধুর বিধবাবিবাহের ব্যাপারে এমন গভীর ভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন যে , তাঁর ভবিষ্যৎ ভেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন । সংস্কৃত কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী শিবনাথকে ডেকে পাঠালেন এবং সতর্কও করে দিলেন । শিবনাথ বিনামেঘে বজ্রপাত দেখলেন ।  স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে গেলে বন্ধুপত্নী মহালক্ষ্মীকে তাঁর নিদারুণ অসুস্থতা থেকে বাঁচানো অসম্ভব হবে । পরহিতৈষণা প্রবৃত্তি তাঁকে সচেতন করে তুলল । প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর কাছে অনুমতি পেলেন ক্লাসে উপস্থিত না থেকেও তিনি পরীক্ষা দিতে পারবেন । ভবানীপুরের বাসভবনের একটি ঘরে শিবনাথ অধ্যয়ন তপস্যায় নিমগ্ন হলেন । সকালে এবং রাত্রে একবার করে শুধু খেতে যেতেন। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসের শেষভাগে যখন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল তখন দেখা গেল দুর্দান্ত ফল হলো তাঁর। এই নিদারুণ পরিশ্রমে তিনি  অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন , কারও কারও মতে তাঁর কুষ্ঠও হয়েছিল। ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে শিবনাথ বি . এ . পাশ করেন । এই সময়ের মধ্যে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ , পিতা কর্তৃক বর্জন ইত্যাদি সংগ্রামের মধ্যে তাঁর মন খুবই বিক্ষিপ্ত হয়েছিল । সংসার জীবন ও ধর্মজীবনের আলোড়নে পাঠ‍্যজীবন অবহেলিত হওয়ায় পরীক্ষায় তাঁকে আশানুরূপ ফলও হয়নি। বি.এ পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন । অবশ্য ইতিমধ্যে তিনি উকিল হবার ইচ্ছায় তিন বছর ধরে ‘ ল লেকচার ' শুনেও রেখেছিলেন । প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী তাঁকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন । বি.এ পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দিকে তাঁর মন যাওয়ায় উকিল হওয়া তাঁর হল না । কেশবচন্দ্রের কর্মে তিনি আত্মনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন । ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে শিবনাথ প্রথম শ্রেণীতে এম . এ . পাশ করে ‘ শাস্ত্রী ' উপাধি পান ও কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত মহিলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কার্যে যোগদান করেন । কলেজের পড়াশুনোর এখানেই শেষ ।শিবনাথ ভট্টাচার্য থেকে এভাবেই তিনি শিবনাথ শাস্ত্রী হয়ে উঠলেন।


নির্বাসিতের বিলাপ: শিবনাথ শাস্ত্রী রচিত কবিতার আলোচনা

স্নেহা মণ্ডল

স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী, হাবড়া শ্রীচৈতন‍্য কলেজ, উত্তর চব্বিশ পরগনা

আন্দামান দ্বীপে নির্বাসনে থাকাকালীন প্রায় প্রতিটা দিনই গোধূলি সময় কবি এসে বসতেন সমুদ্রতটে।এমনই একদিন তটের সম্মুখে এসে চমকে ওঠেন তিনি!সাগ্রহে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের কালো জলরাশির দিকে।অসীম শক্তি একত্রিত করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে জলধি!তার ঢেউয়ে এক বিপুল চপলতা। কবির মন ক্ষুণ্ন হয়ে ওঠে,তিনি প্রশ্ন করে ওঠেন, "কেন হে তরঙ্গ বারংবার নিজ করালসম ঢেউয়ে আঘাত করছ কূলে?" তাঁর চঞ্চল পাপী হৃদয় যে এই সমুদ্রতটেই  একটু শান্তি খুঁজতে চায়,একটু প্রাণ খুলে শোক-আবেগ প্রকাশ করতে চায়! তাইতো তিনি আবেগবিহ্বল হয়ে বলে ওঠেন, 
          "তুমি যদি ভুলিলে হে আপনারে ভাই
      বল তবে হতভাগ্য কার কাছে যাই?"
তাঁর পাপিষ্ঠ হৃদয়ে অবিরাম অশ্রুধারা ঝরতে থাকে।আপন পাপের ফল ভোগ করতে সে যে আজ এই জনশূন্য দ্বীপের মাঝে এসে পড়েছে,যেখানে তাঁর রোদনে একবিন্দু নেত্রজল দেওয়ার জন্যেও কেউ নেই! মা,স্ত্রী,পুত্র সবাই যে লক্ষযোজন দূরে।চারপাশের তরুগন যেন বিষাদ কালিমা মেখে ডুবে আছে শোকে। নিশাকালের শশীও যেন আঁধারের সাথে সন্ধি করে নিজেকে কালো নিষ্প্রভ শোভায় ঢেকে রাখতে চায়। 
       হঠাৎই সম্বিত ফেরে কবির। হায়! দিনের আলো যে ফুরিয়ে আসছে।বিহগের কুল কলরব করতে করতে ফিরে যাচ্ছে নিজ নীড়ে। বিমল গগনে নিজ প্রিয়সীর সাথে আনন্দে মত্ত চাতককে দেখে দুচোখ জলে ভরে ওঠে কবির।কেন যে তাঁর পাপীমন লোভের ফাঁদে পড়ল,কেন যে তাঁর এই দুম্মতি?যে ধনের লোভে তাঁর পাপিষ্ঠ মন নিজ সংসারকে ভুলেছিল,সেই পোড়াধন কি আজ এল নির্বাসিত এই দুঃখের বহ্নিকে নিবারণ করতে?অশ্রু সংবরন করে তিনি রত্নাকরকে করজোড়ে বিনীত করে বলেন,কিছুদিন পর যখন এই তটের সমীপে কবি তাঁর কুটিরসহ ধরার বুকে মিলিয়ে যাবেন তখন একটা মৃত্তিকা রাশি তাঁর অশ্রুর সাক্ষীরূপে থাকবে এই ভূমিতে। কখনো যদি কোনো পথিক তটের করালদন্তের সামনে দাড়িয়ে বলে কে এখানে ছিল?কি বা নাম?কবে মরল? তবে তুমি তাকে বোলো লোভের ফাঁদে পড়ে পাপকর্ম করে এক দুরাচার কিছুদিন এখানে কারাবাসে ছিল। কেবা তার পিতা-মাতা, কেবা তার আপন,কোথায় তার ঘর কিছুই তুমি জানো না।পথিককে ফিরে যেতে বোলো, দেখো সে যেন চরণ না স্পর্শ করে।পাপ মিশে আছে তো অস্থিতে যদি তার অন্তরে সে পাপ-বিষ সঞ্চারিত হয়ে যায়!
     এতক্ষনে পশ্চিম আকাশকে সিঁদুর আভায় রাঙিয়ে দিয়ে দিনমনি প্রায় অস্তাচলে ঢলে পড়েছেন।কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে কবির ব্যথিত মন বলে ওঠে,
 "কেন যে অম্বর-মনি!লোহিত বরণ/ধরিয়া জলধি জলে হইছ মগন?/বসে যে এই তরুতলে করিত রোদন/রাখিয়া কপোল করে,ভাসিত বদন।/তুমি তো চলিলে দিক করে অন্ধকার,/বলনা কি গতি করে গেলে হে আমার?" কবির পাপরসনার এ আহ্বান বুঝি রবির কর্ণকুহরে পৌঁছাতে চায় না।
     প্রকৃতির নিয়মে রাত নামে। বিমল আকাশে শুভ্র চাঁদের আগমনের সাথে সাথেই বাতাসের প্রবল আঘাতে ফুলে ওঠে নীরনিধি,যেন সমগ্র দ্বীপকে একনিমেষে উদরস্থ করবে! কবির মলিন বদন ভেসে যায় চোখের জলে--"মহাবীর তুমি সমীরণ! করিহে স্বীকার/সবলে দেখাও বল নিকটে আমার/দীন হীন ক্ষীণ আমি কি লাভ তোমার/হইবে দেখায় বল বলোহে আমারে?/কেবা করে ক্রম-সজ্জা কীট মারিবারে?" তাঁর এই ক্লান্ত হাহাকার যেন ধীরে ধীরে দ্বীপের কর্দমাক্ত আঁধারে তলিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎই কবির ভাবনায় এল এই সমীরণ তো সর্বদেশে যায়,কত গিরি-নদী,কত দেশের উত্থান-পতন দেখে!সেবার লঙ্কাপুরে সীতার রক্ষার্থেও তো সে রামকে সহায়তা করেছিল,তবে কি এই পামরের একটা উপকার সে করবে না?একবার কি সে খোঁজ এনে দিতে পারেনা তাঁর মাতা-জায়া-সুতের?--যে বৃদ্ধার নয়ন গেলেও অনিবার জলধারা এখনও শেষ হয়নি-তার কাছে গিয়ে সে কি মাতৃস্নেহে বলে আসতে পারবে যে তাঁর কুপুত্র এখনো মরেনি! কবি আকুল কন্ঠে বলে ওঠে, "হায় গো দয়াময়ী ধরেছিলে জঠরেতে--তখন কি গো ভেবেছিলে মনে,/না যাবে সে জলধারা থাকিবে নয়নে?" তিনি সমীরণকে অনুরোধ করেন একটিবার তাঁর কুঠিরে গিয়ে প্রিয়জনদের খোঁজ এনে দিতে,চেনার সুবিধার্থে তিনি তাঁদের বর্ণনাও দিয়ে দেন। কুঠিরের দ্বার আগলে যে সলজ্জ স্বভাবের এক রমণী বসে থাকবে--যার চোখদুটো অমাবস্যার নিকষ কালোর ন্যায় নিষ্প্রভ,আকস্মিক ঝড়ের ভার সামলাতে না পেরে যার প্রাণোচ্ছল সুশ্রী মুখে এসে পড়েছে মলিনতার ছায়া আর সেই মুখমন্ডল ভাসিয়ে চলেছে সতত অশ্রুধারা,সেই-ই কবির  স্ত্রী। তিনি ভাবতে থাকেন-এই পামরের কথা কি কখনো স্মরণে আসে ইন্দুমুখীর?কেমন আছে,কোথায় আছে তার প্রিয়ে, এরূপ চিন্তার কি উদয় হয় তার মনে? তার কোমল হৃদয় কি কেঁপে ওঠে? নাকি সে ভেবে নিয়েছে সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে নৌকাডুবিতে তার প্রিয়তমের মৃত্যু ঘটেছে!আর সেই ভাসমান কলেবর ছিঁড়ে খেয়েছে শেয়াল-শকুনে? হঠাৎ বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে কবির, শূন্য আকাশে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলেন, "তুমি তাকে বোলো ভাই--মরিনি সে সুন্দরী!রয়েছে জীবন/এখনো হৃদয়াগারে জ্বলিতেছে পাপ হুতাশন/না হয় শীতল/এখনো এ পোড়ানেত্রে বহে অশ্রুজল।" আর কুঠিরের সামনের উঠানে সুঠাম,সুন্দর,গৌরবর্ণ,যে বালককে খেলতে দেখা যাবে,এমনি সময় যার মনে সর্বদা আনন্দচ্ছাস বয়ে যায় সে যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছে মাতৃপাশে।
         নির্জন দ্বীপে যেন হওয়ায় মিশে যাচ্ছিল কথাগুলো।ঘন সবুজ শাখারা যেন কথাগুলোকে পাঁচকান করতে চায় না।অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠেছে,দুর্জ্জয় সিন্ধু বুঝি ঘুমের ঘোরে ঢুলছে।কুয়াশাচ্ছন্ন সুনীল উত্তরী মুখে টেনে যেন এক গভীর অভেদ্য ঘুমে ঝাঁপ দিতে চায় সমগ্র দ্বীপ!
       "ঘুমাও সাগর!
       অকাতরে নিদ্রা তুমি যাও বীরবর!
          জন্মেছি কাঁদিতে আমি কাঁদিব বিজনে
     রাখিব মনের কথা মানস গোপনে!"--অস্ফুট শব্দে কথাগুলো শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ধীরপদে কবি এগিয়ে যান নিজ কুঠুরীতে।

স্মরণীয়

( শিবনাথ শাস্ত্রী)

কলমে - পীযূষ প্রতিহার
    
শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৪৭ সালের ৩১ শে জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪-পরগনার চাংড়িপোতা (বর্তমান নাম সুভাষগ্রাম) গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা পণ্ডিত হরানন্দ ভট্টাচার্যের বাড়ি ছিল ঐ জেলারই মজিলপুরে(জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার প্রথম পৌরপ্রধানও ছিলেন তিনি)। শিবনাথের মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন বহুল প্রচারিত 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকার সম্পাদক।
    শিবনাথ ভট্টাচার্যের প্রাথমিক শিক্ষা মজিলপুর পাঠশালায়। সেখানে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্থাপন হলে সেই স্কুলে ভর্তি হন শিবনাথ।  নয় বছর বয়সে কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৬৮ তে এফ. এ., বি. এ.(১৮৭১) এবং সংস্কৃত তে এম.এ(১৮৭২) পাশ করেন। কলেজের পড়া শেষ হলে মেধাবী ও ব্যতিক্রমী ছাত্র হিসেবে 'শাস্ত্রী' উপাধি লাভ করেন। ১৮৭৩ এ তাঁর মামা দ্বারকানাথ অসুস্থ হয়ে পড়লে 'সোমপ্রকাশ' এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। এই সময়ে মজিলপুর স্কুলের দায়িত্বও নিতে হয় তাঁকে। মজিলপুরের পাশেই হরিনাভি স্কুলের দেখাশোনাও করতে হত। ১৮৭৪ সালেই সাউথ সুবার্বন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন তিনি। ১৮৭৬ সালে হেয়ার স্কুলের সংস্কৃতের হেডপণ্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। যদিও মাত্র দুই বছরের মধ্যে সমস্ত সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্রাহ্মসমাজের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি।
     ১৮৬৫ থেকেই তিনি সমাজ সংস্কারমূলক নানা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাল্যবিবাহের বিপক্ষে ও বিধবাবিবাহের পক্ষে নানা রকম কর্ম সম্পাদন করতেন। ১৮৬৯ সালের ২২আগষ্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেন। ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়ে উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করলে পিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। India Reforms Association এ যোগদান করে শিক্ষা, সাহিত্য ও কারিগরিবিদ্যার প্রচার ও প্রসারে সহায়তা করেন। এই সময়েই ১৮৭০ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী 'মদ না গরল' নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৭৭ এ তিনি একটি 'ঘননিবিষ্ট' নামক  বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেন এবং পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে, নারী-পুরুষ সমানাধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৮৭৮ এ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে ভাঙন (নারী-পুরুষ একত্রে উপাসনার রীতি নিয়ে বিবাদে) ধরে গেলে শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৮৭৯ সালে আনন্দমোহন বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে 'সিটি কলেজ' ও 'স্টুডেন্ট সোসাইটি' নামক ছাত্র প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮৮৪ সালে মেয়েদের শিক্ষার জন্য  'ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়' স্থাপন করেছিলেন। পাটনায় স্থাপন করেছিলেন 'রামমোহন রায় সেমিনারি' এবং কলকাতায় 'সাধন আশ্রম' যেখানে আধ্যাত্মিক সাধনা ও মিশনের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো। আনন্দমোহন বসু ও তিনি মিলে 'ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন' স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
      ১৮৮৩তে তাঁরই উদ্যোগে প্রথম শিশু-কিশোর উপযোগী মাসিক সাহিত্য পত্রিকা 'সখা' প্রকাশিত হয় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে। এছাড়াও একটি শিশু কিশোরদের পত্রিকা 'মুকুল' সম্পাদনা করতেন তিনি। শিবনাথ শাস্ত্রী আরো কয়েকটি পত্রিকা যথাক্রমে 'তত্ত্বকৌমুদী', 'ইন্ডিয়ান মেসেজ', 'সমদর্শী' ও 'সমালোচক' সম্পাদনা করতেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল 'নির্বাসিতের বিলাপ'(১৮৬৮), 'পুষ্পমালা'(১৮৭৫), 'হিমাদ্রি কুসুম'(১৮৮৭), 'পুষ্পাঞ্জলি'(১৮৮৮)। 'শ্রমজীবী' নামে তাঁর লেখা একটি কবিতা এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে সেই কবিতায় ব্যবহৃত একটি শব্দ 'যুগান্তর' পরবর্তী কালে গুপ্ত বৈপ্লবিক দলের নামকরণে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাঁর লেখা উপন্যাস গুলি হল 'মেজ বৌ'(১৮৮০), 'যুগান্তর'(১৮৯৫), 'নয়নতারা'(১৮৯৯) এবং 'বিধবার ছেলে'(১৯১৬)। বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলন হল 'বক্তৃতা-স্তবক'(১৮৮৮), 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ'(১৯০৪), 'প্রবন্ধাবলী'(১ম খণ্ড ১৯০৪), 'ধর্মজীবন'(১ম - ৩য় খণ্ড ১৯১৪-১৬), 'আত্মচরিত'(১৯১৯)। 'History of Brahma Samaj' নামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থও তিনি লিখেছিলেন।
    পণ্ডিত, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক এই মহান মানুষটি ১৯১৯সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


সরস্বতীকে
মুক্তি দাশ 

শোনো মাগো সরস্বতী,
আমার কথাগুলি -
আজকে আমার মনের কথা
বলছি খোলাখুলি। 
মিথ্যেকথা বলে কী লাভ? 
বলছি তোমায় পষ্ট, 
পড়াশুনো ব্যাপারটা মা
বেজায় রকম কষ্ট! 
তারপরে তো আছেন যত
স্কুলের রাগী মাষ্টার,
পানের থেকে চূন খসলেই
মাথায় ঠোকেন ডাস্টার! 
কালিদাস তো মূর্খ ছিলেন, 
পেয়ে তোমার বর, 
পেলেন খেতাব 'মহাকবি' -
আমরা কি মা পর? 
আমাদেরও বর দাও মা,
করছি তোমায় বন্দনা, 
রাতারাতি কবি হবো -
মজা হবে মন্দ না!


 নতুন ব্যঞ্জন 

সুব্রত দেব

ক-এ কেমন আছেন ঘরে বসে
খ-এ খাচ্ছি দাচ্ছি রসে বশে 
গ-- এ  গাইছি  গান ইচ্ছে মত
ঘ-এ ঘুমিয়ে আর থাকব কত
 ঙ-এ রঙ তুলিতে আঁকছি ছবি
   চ-এ চোখ মেলছি দুরের নীলে 
   ছ-এ বাঁধছি ছড়া ছন্দ মিলে
জ-এ জানছি চিনছি ঘরকে আজ
  ঝ-এ ঝগড়া ভুলে করছি কাজ
ইঅয় -এ ঘর সাজাচ্ছি  মিয়া বিবি
  ট-এ ঘরে ঘরে টানাটানি
 ঠ-এ ঠাকুর্দার চোখে ছানি
 ড-এ  বিশ্ব জুড়ে   ডামাডোল
  ঢ-- এ বায়েন কোথা? বাজাবে ঢোল
   ণ-এ মৃত্যু মিছিলে শোক নিদারুণ
ত-এ তবু আমরা মানুষ বটে
   থ-এ এগোব,থামব না মোটে 
  দ-এ দেখছি বিশ্বে মৃত্যু হাহাকার 
   ধ-এ ধরার বুকে নামছে আঁধার
ন -এ নয় নয় ভয়,উঠছে নবারুণ
প-এ পথিক আজ হারিয়েছ পথ
  ফ-এ ফুলের কাছেই আমার শপথ 
  ব-এ   বাঁচব,বাঁচাব বসুন্ধরা
    ভ-এ ভুলব না দিন স্বজন হারা
  ম-এ মানবতা ই হোক শ্রেষ্ঠ মুখ
য-এ যারা আমাদের গেল ছেড়ে
  র-এ রইবে তারা হৃদয় জুড়ে
 ল - লক ডাউনে করোনা জয় 
  ব-এ বন্ধুত্ব যেন হয়না লয়।
  শ-এ আসবে শরৎ, কাটবে দুখ।
ষ-এ আষাঢ়ে নামবে বাদল ধারা
  স - সাজবে প্রকৃতি  স্বয়ম্বরা
 হ-এ কবে হ্ব ফের কাছাকাছি
  ড়- আমরা বড়ই দু:খে আছি
 ঢ়-এ আষাঢ় নামুক গগন তলে
  য়-এ ভয় ভুলে সব ভিজব জলে
ৎ -এ করোনা হারিয়ে বিশ্বজিৎ
ং -এ রং ছড়াব আবার আহা
:-এ জয়ের শেষে বলব বা:বা:
ঁ -এ চাঁদের হাসির ভাঙবে বাঁধ
      পূর্ণ করব মনের সাধ।

ধারাবাহিক ভ্রমণ
 চলো যাই (কেরালা) 
কলমে - বাসবদত্তা কদম

পর্ব ৫ 

ছোট্ট দ্বীপখানা ভর্তি নারকেল গাছ। খুব সুন্দর। কিন্তু একখানাও মানুষ নেই। বাড়ি নেই। কেন! তাহলে কি আমরাই প্রথম এলাম এখানে? না না তা কী করে হবে! তাহলে এত সুন্দর লাইন দিয়ে নারকেল গাছ লাগালো কে? আর ঐ ধর্মরাজের চর সেই বা এলো কার সঙ্গে। জানো তো ধর্মরাজের চর কে? আমাদের ঘরের পাশের নেড়ি গো। হ্যাঁ ওর ভাই বেরাদারও অবশ্য। সেই মেঘবাজারেও ছিল, এখানেও যেন অপেক্ষায় ছিল সে। সে দেখলাম বেশ রাজার মত ঘুরছে। নারকেল বাগান পাহারা দিচ্ছে। তাকে মাঝিভাইরা যত্ন করে কাগজের প্লেটে খেতে দিল। খাওয়া হতে আবার সে প্লেট তারাই তুলে নিল।
শুনলাম এই নারকেল দ্বীপের মত ছোট ছোট দ্বীপ আরো বেশ কয়েকটা আছে, তবে সেখানে মানুষ বাস করে না, সরকারের তরফে ইজারা দেওয়া হয় এইসব দ্বীপ, নারকেল ব্যবসায়ীদের। সেই যে বলেছিলাম কেরালায় নারকেল চাষ হয় প্রচুর, ভুলে যাওনি তোমরা আমি জানি। এগুলো এখনো মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হয়নি তাই নারকেল বাগানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।                      
এরপর আবার আমাদের ময়ূরপঙ্খি নাও (হাউসবোট) চলল উড়ে উড়ে যেন। হঠাৎ দেখি আমরা সমুদ্রের মধ্যে। 
এটা কি আরব সাগর না লাক্ষাদীপ সমুদ্র!
-না না এটা সমুদ্র না, একে আমরা আলাপুZhআর লোকেরা বলি পুন্নামাডা লেক।
আপনারা বলেন মানে? এর কি অন্য নামও আছে নাকি?
-আছে বৈকি, চারখানা জেলা জুড়ে এই লেক, এর অনেক নাম। কোট্টিয়ামের লোকেরা একে বলে ভেম্বনাদ, কোচিতে বলে কোচি লেক, এইরকম আর কি।
কি বিশাল, কি বিশাল! এটা লেক। চারিদিকে শুধু জল, জল আর জ-ল। হাউসবোট এদিকে নেয়, ওদিকে নেয় আর আমরা কেবল দেখছি দুপুরের সূর্য তাতে হাজার হীরের টুকরো হয়ে মিশে যাচ্ছে। পুরো দেশে এটাই সবথেকে লম্বা লেক আর অবশ্যই সবচেয়ে বড় ব্যাক ওয়াটার লেক। আয়তনে ২০৩৩ স্কোয়ার কিলোমিটার, লম্বায় ৯৫ কিলোমিটারেরও বেশি। পম্পা, আচান কোইল, পেরিয়ার, মনিমালা এরকম চার চারটে বেশ বড় নদী এসে নিজেদের মেলে দিয়েছে এই হ্রদে। কেরালার চারখানা জেলা এই বিশাল হ্রদের চারিদিকে। 
-বল্লম কেলির নাম শুনেছেন? সেটাও এই লেকেই হয়।(ক্রমশঃ) 
যখন মনে মনে ভাবছি বল্লম কেলি, সেটা আবার কি? 
মাঝিদাদা বললেন, 
-হ্যাঁ, আপনাদের শোনা কেরালার বিখ্যাত ‘স্নেক বোট ফেস্টিভ্যাল’ যা গত কয়েকবছর ধরে পরিচিত ‘নেহেরু ট্রফি বোট রেস’ নামে, তাও এই হ্রদেই হয়। এ উৎসব হয় ‘ওনম’ এর সময়। 
-তাই তো! এ উৎসবের কথা শুনেছি তো। ওনম হল নতুন ফসলের উৎসব। আমাদের যেমন নবান্ন। ওনম হয় অগাস্ট মাসে। 
-ওনম উপলক্ষে আমাদের এখানে উৎসব চলে প্রায় একমাস ধরে। বল্লম কেলি তারই এক বিশেষ অঙ্গ। 
সব প্রাচীন উৎসবের একটা করে গল্প থাকে। কখনো কখনো কয়েকটা গল্পও থাকে। সেরকম গল্প আছে ওনমেরও (ক্রমশঃ)


পাঠ প্রতিক্রিয়া
( জ্বলদর্চির ৬৮ তম ছোটোবেলা সংখ্যার পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন অসীম হালদার মহাশয়)

প্রচ্ছদে বড়ো বড়ো নামাঙ্কিত, NETAJI BIRTH PLACE MUSEUM লেখাটিই বলে দিচ্ছে যে এবারের জ্বলদর্চির বিষয়বস্তু কি হতে পারে। হ্যাঁ...হবারই তো কথা। যাঁকে ঘিরে উদ্দীপনায় এবং আবেগে ভাসি, তাঁর ১২৫তম জন্মদিনই তো গেল ক' দিন আগে। মৌসুমীদি পরিষ্কার করেই বলেছেন এবারে কারা লিখেছেন এই বিশেষ দিনটাকে স্মরণ করে। যদি তোমাদের খুব সহজ করে মুক্তমনে বলি, তবে বলবো তোমাদের মতো আমিও একজন নেতাজীভক্ত। আরও বেশী আকর্ষণ অনুভব করি একজন তরুণ দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাঙালি বিপ্লবী বলে। যা কিছু অনুরাগ এবং ভালবাসা, সবকিছুকে আবার যেন প্লাবিত করে দিলো এত সুন্দর সুন্দর লেখা এবং অবশ্যই তোমাদের মনোমুগ্ধকর আঁকা ছবিগুলো। 

একটি কথা তো সবার মনেই দাগ কেটেছে যে সম্প্রতি ইন্ডিয়া গেটে নেতাজীর মূর্তি বসানো নিয়ে। কথা সেটা নয়, আসল কথা হলো, গতকালের টুকরো খবর (০৪.০২.২০২২, শুক্রবার) হলো নেতাজীর হলোগ্রামসহ জিনিসপত্র নাকি বেপাত্তা! আমি জানি না, দেশের জন্য যাঁর আত্মত্যাগ, আজীবন সংগ্রাম, যে অধ্যায়ের আলোচনা করলে দু চার কথায় শেষ হবার নয়, তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে এ হেন রাজনীতি খুবই লজ্জাজনক। ঘটনা যদি সত্যি সত্যি এটাই হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই বলবো, আমরা আমাদের প্রধান বিপ্লবী সৈনিকের সম্মানকে অত্যন্ত অশ্রদ্ধা করে ফেলা হলো! যাইহোক, আলোচনায় ফেরা যাক সকলের সৃজন নিয়ে।

আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আদৌ আছো, যে নেতাজীর নামই শোন নি ছোটবেলা থেকে! বোধহয় না। আচ্ছা, তাহলে এবার বলো, নেতাজীর জন্মদিন এলে তোমরা কে কি করো। এই সময়ে দেখি, তিতির নেতাজীর জন্মদিনে স্কুলে একটা অন লাইন প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা দারুণ প্রজেক্ট বানিয়ে ফেলেছে! কি সাংঘাতিক প্রচেষ্টা, দেখো। পেপার কাটিং যে কতো গুরুত্বপূর্ণ, তার অভিজ্ঞতাও হলো। অথচ ও কিনা একটা বক্তৃতা দেবার জন্য লেখা কথাগুলো মুখস্থ করে যাচ্ছিল সেই সকাল থেকে। 

আমি জানি, তোমরা, মানে অনুশ্রুতি, সুদেষ্ণা এবং শুভশ্রীর সাথে তোমরাও পাড়ার ক্লাবে বা তোমাদের আবাসনের মধ্যের ছোট্ট প্লে গ্রাউণ্ডে নেতাজীকে নিয়ে কতো কিছু পারফর্ম করেইছো, হলফ করে বলতে পারি। আমি তোমাদের মনের কথা আর ইচ্ছেগুলোর ডানায় চেপে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছি, তোমরা ঐ দিন চকলেট, বিস্কুটের সাথে একটু দুষ্টুমিও করেছো বন্ধুদের সাথে। আর তিতিরের মতো প্রজেক্ট কেউ তো করেইছো। গান গাইলে কেউ, কবিতাও বলেছো আর স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে নেতাজীর মতো দৃপ্ত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছো, "বন্দে মাতরম্‌"! "জয় হিন্দ"! 

কি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের এই মহামানবের জন্ম হয়েছিলো পরাধীন দেশের মাটিতে! ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়। শ্রী মলয় সরকার যথার্থই লেখেছেন, দেশের নেতাদের সাথে তাঁর অনেক অনেক তফাৎ। না হলে ঘরের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, সরকারী চাকুরির মোহ মুহূর্তে ত্যাগ করে যেভাবে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বৃটীশ বাহিনীর বিরুদ্ধে, তাতে তাঁর অবদান চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি "তরুণের স্বপ্ন" নামে যে বইটি উল্লেখ করেছেন, অবশ্যই তোমরা পড়বে এবং নেতাজীকে আরও ভাল বিশদে জানতে পারবে। সে কেমন করে ছদ্মবেশে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা শিখেছেন, গোপনে সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন, ভাবতেই শিহরণ জাগে।

সুভাষকে নিয়ে আলোচনা তর্কের শেষ নেই। বেঁচে আছেন কি না সংশয়ও কম নয়। ভুরি ভুরি জল্পনা কল্পনারও নেই শেষ। কিন্তু ১২৫ বছরে তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে যদি সন্দেহ জাগে, তাহলে তো এটাও সত্য যে কয়দিন আগে শিবানন্দ গোস্বামী নামে বারাণসীর তীরে যোগাসনরত যে যোগীকে দেখা গেলো, তিনিও তো নাকি ১২৫ বছরেরই প্রবীণ। কিভাবে এখনও তিনি শুধুমাত্র নিরামিষ আহারে দিনযাপন করে চলেছেন, যিনি বুক দাপিয়ে সহাস্যে বলছেন, "NO DESIRE, NO DISEASE, NO DEPRESSION"...তিনি তো যোগসাধনার পথেই কাটিয়ে এসেছেন চরম দারিদ্রের মধ্য দিয়ে সেই ছোট্ট বেলা থেকে, জাগতিক কোন শক্তির বলে সেটা সম্ভব হচ্ছে, সে ভাবনাও কিন্তু মনে আসে! তাই সঠিক প্রমাণের অভাবে আমরা একপ্রকার এখনও ধোঁয়াশায়। তিনি যেখানেই থাকুন, আমাদের প্রধান দেশনেতা হিসাবে পূজিত হবেন সর্বদা, সেটা অবশ্যই বলতে পারি। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় এবং প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের আদর্শে উজ্জীবিত সুভাষের হৃদয়ে একটাই লক্ষ্য ছিলো ভারতকে স্বাধীন করা, দেশমাতৃকার মুক্তি। সেজন্যই এই মহামানব অষ্ট চিরঞ্জীবিদের একজন। তোমাদের মৌসুমী আন্টি সঠিকই বলেছেন। 

এই বিশিষ্ট যোগীর কথা এবং তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের কথা বলতে গিয়ে সুভাষের খাবার দাবার নিয়ে এবার একটু আলোচনায় আসা যাক...নিরামিষ খাবারের কথা প্রসঙ্গে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা সুভাষের প্রিয় খাবারের কথা সম্বন্ধে কিছু কথা। যেসব খাবার সুভাষের প্রিয়, ভালো করে দেখো, আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতেও সেইসব খাবারের আয়োজন হয়ে থাকে। কোন স্পেশাল খাবার নয়। বরং তিনি "ভাতে ভাত"ও পরমতৃপ্তির সাথে খেয়েছেন। দেশবন্ধুর মাতা বাসন্তীদেবীর পরম মায়ার আঁচলে থেকে আজীবন দেশকে ভালবেসে বীর পরাক্রমশালী এই যোদ্ধা স্বাধীনতার আন্দোলনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। খাদ্যরসিক সুভাষের জীবনের এই অসাধারণ কাহিনী পড়ে আমরা সুভাষকে আবার একবার নতুন করে জানলাম এবং বাঙালীয়ানার আঙিনায় তাঁকে অন্য চরিত্রে অনুভব করলাম। অন্যদিকে, রসিক হিসাবে সুভাষচন্দ্রকে অসামান্য রূপ দিয়ে তুলে ধরেছেন মুক্তি দাশও। সুভাষের বৌদিকে লেখা কিছু চিঠিচাপাটির মধ্যে যে হাস্যরস খুঁজে পাওয়া গেলো, তা বেশ উল্লেখ করার মতো। একটা মানুষের মধ্যে কতো বৈচিত্র্য থাকতে পারে, নেতাজীকে যে না জেনেছেন, বুঝবেন না। আসলে তিনি দেশের স্বাধীনতা আনতে কোনদিন কারো সাথে আপোষ করেন নি, বলা যায় নোংরা রাজনীতি করেন নি। তিনি সঠিকই বুঝেছিলেন যে শত্রুর শত্রু দিয়েই স্বাধীনতা আসবে একদিন। যতো লেখাই লিখে যাই না কেন, সুভাষচন্দ্রের কাছে তা কমই মনে হবে চিরদিন। কারণ তিনি মিথ্যাচার বা স্বার্থপর হতে শেখেন নি।

পীযূষবাবুও সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তুলে ধরেছেন সুভাষের জীবনী। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রাসবিহারী বসু, অরবিন্দ ঘোষ, মাস্টারদা সূর্য সেন...কাদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি! কোদালিয়ার আদি বাড়িটি এখনও "লালবাড়ি" বাস স্টপে অবস্থিত, যা পুরানো দিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে। যে সম্ভ্রান্ত সচ্ছল পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখান থেকে কেউ অনায়াসে জীবনকে ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু যে আদর্শবোধ তাঁর প্রধানশিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, তাকে তো তিনি ভুলতেই পারেন নি। স্বামীজীর অনুসারী এই মহামানব আজও তাই বারে বারে বাঙালী সমাজের কাছে আদরনীয় হয়ে থেকে যাবেন। গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে অন্তরের প্রণাম জানাই। তাঁর সম্মান এবং যথাযোগ্য মূল্যায়ন নিয়ে কোন আলোচনাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু দুঃখ এটাই যে মানুষটি চিরকাল শুধু দেশের জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেলেন। অথচ তাঁকে ঘিরে সমালোচনা আর কমিটি সৃষ্টি নিয়ে রাজনৈতিক তর্জা কম হয় না; সেটা অবশ্যই অশোভনীয় এবং অনভিপ্রেত।

বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে প্রযুক্তিবিদ্যাও এখন বেশ উন্নত। এখনকার মতো এক দেড়শো বছর আগে বিজ্ঞানের এতো উন্নতি হয় নি...যে বিষয়টি সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো গণমাধ্যম। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রয়োজনীয় খবরের আদান প্রদানের জন্য একমাত্র মাধ্যম ছিলো চিঠি। কিন্তু তাও তো সহজ ছিল না, পথেঘাটে, অলিতে গলিতে ইংরাজ সৈন্যের সাবধানী দৃষ্টি আর অবশ্যই কিছু তাঁবেদার মীরজাফরদের জন্য বিপ্লবীদের মধ্যে অনেক সময় প্রয়োজনীয় খবর পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। ফলে অনেক সিদ্ধান্ত সময়মতো করা যায় নি, অনেক আন্দোলনও ঠিকমতো দানা বাঁধে নি। এই মর্মে পেলাম শ্যামলীদির একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা, যেখানে বেতার মাধ্যম সম্বন্ধে একটি অসাধারণ লেখা উপহার পেলাম আমরা। ওয়্যারলেস ল্যাবরেটরীর কথা, হীরেন্দ্রনাথ বসুর কথা, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কথা...আরও কতো স্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলো তাঁর এই লেখনী, ভাবতে সত্যিই গর্ব হয়। গান্ধীজীর বক্তৃতা দানের মাধ্যমে তাঁর লেখার সমাপ্তি হলেও আমাদের কর্ণকুহরে যেন বেজে চলেছে তাঁর লেখা কথাগুলো। আসলে কি জানো, নেতাজী, ক্ষুদিরামের কথা মানেই তো পরাধীন ভারতের ইতিহাসের কথা, অনেক আন্দোলন প্রতিবাদের কথা জড়িয়ে আছে সেইসব ঘটনার সাথে। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই কাহিনী তাই পড়লে আমাদের চোখে ভাসতে থাকে সাদা কালো টিভির কথা, একসাথে একটা টিভির সামনে বসে থাকা গ্রামের মানুষদের কথা, একটা রেডিওর সামনে ভিড় করে বসে থাকা যখন শুধুমাত্র আকাশবাণীর সংবাদ শোনার জন্য। সেসব এখন তোমাদের কাছে গল্পের মতো মনে হবে! বিগত দিনের বেতার মাধ্যমে সম্প্রচার নিয়ে মূল্যবান কাহিনীর সাথে কতো বৈপ্লবিক ইতিহাস জড়িয়ে, সে কথা ভাবলে আমরা নস্টালজিক হয়ে পড়ি। 

নেতাজীর জন্মবার্ষিকী পালনের দুদিন বাদেই আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয় দেশ জুড়ে। যে সাম্য মৈত্রীর হাত ধরে ভারতের সংবিধান রচিত হয়েছিল, জাতি ধর্ম বর্ণ  নির্বিশেষে তৈরী হয়েছিলো সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক, সেই আদর্শের অনুগামী হিসাবে আবার সেই নেতাজী। প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের দিন যখন দেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়, তখন সমগ্র ভারতবাসী আবেগে ভাসে। এই প্রসঙ্গে পায়েল চট্টোপাধ্যায় খুব সুন্দর স্মৃতিকথা উপহার দিয়েছেন হলুদ জামার সেই ছেলেটি আর লাল ফ্রক পড়া সেই মেয়েটার কাহিনী দিয়ে। পতাকার তলায় দাঁড়ানো সব মানুষই সমান হয়ে যায়, এই কথা বেশ মনকে নাড়া দিয়ে যায়! মানুষে মানুষে কতো বৈচিত্র্য, তবু সবাই মোটের ওপর আমরা মানুষই..। তবু আমরা উঁচু নীঁচু জ্ঞান করি, দূরে সরে থাকি মানুষের থেকে। কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে দুটি সহজ কথায় বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমাদের কেমন থাকা উচিত। বর্তমান দুনিয়ার নিরিখে এই ভাবনার জয় হোক। ঘরে ঘরে আদর্শ নীতিবোধ ফিরে আসুক, বলতে পারি চলো আমরা আরো "বেঁধে বেঁধে থাকি"।

একসঙ্গে থাকার কথা লিখতে গিয়েই মনে এলো একসাথে বেরাতে যাওয়ার কথা। সত্যি অনেক দিন তো বাইরে যাওয়াই হচ্ছে না। আরে বাবা, আমারও কি ভাল্লাগে না কি! তাই বাসবদত্তা আন্টির কেরালা ভ্রমণের এই পর্ব পড়ে এখনই বেরোতে মন চাইলো। আরে তোমরাও সাথে থাকছো। স্কুল খুলেছে সবে। কটা দিন স্কুলের পড়া করে চলো বেরিয়ে পরা যাক প্রকৃতির কোলে। একটা নীলাম্বু কাঠ দিয়ে নৌকো তৈরী করে নিলে কেমন হয় বলো তো! নারকেলদ্বীপে দেদার ঘুরে বেরানোর মজাই তো আলাদা। তারপর যদি টুকটাক মাছও ধরতে পারি ক্ষতি কি! গ্রামের বাড়ির পুকুর থেকেও তো মাছ ধরেছি। এবছরে বেরোতেই হবে একবার...পারা যাচ্ছে না সুন্দর সুন্দর ছবি টবি দেখে। দেখি পরের সংখ্যায় কি থাকছে ... অপেক্ষায় রইলাম।

নতুন বছর মানেই তো জানুয়ারী মাস আর দুটো বিশেষ দিনের খবর নিয়ে বছরের শুরুতে। এ বছরও তাই ব্যতিক্রম হলো না। নেতাজীর কথা আর প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের গল্পকাহিনীগুচ্ছে ঠাসা জ্বলদর্চির এই সংখ্যাটি ঐতিহাসিক দিক দিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয়দের আবেগ আর নাড়ির স্পন্দনে জড়িয়ে থাকার মতো লেখায় সমৃদ্ধ সংখ্যাটি আশাকরি তোমাদেরকেও আকর্ষিত করেছে। অনেক ভালো থাকো সবাই, এমনই সৃজনে থাকো, আর মানুষের সাথে ও পাশে থেকো, নেতাজীর আদর্শে বলীয়ান হয়ো...কামনা রইলো। তোমাদের ওপরেই রয়েছে দেশের ও দশের ভবিষ্যত। একজন ভালো মানুষ হওয়ার মূল্য অনেক, কারণ তেমনভাবে জীবন কাটানো অনেক সম্মানের, শ্রদ্ধার। একবার ভেবে দেখো...নীরবে ... একান্তে।

আরও পড়ুন 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments