জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭১


ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭১

সম্পাদকীয়,
বসন্ত এসে গেছে। পলাশ শিমূলদের দেখে পাখিরা গাছে গাছে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে। এই খবর দিল কল্যাণ আঙ্কেল তার তোলা ছবি পাঠিয়ে। শুধু অরণ্যে নয় দু বছরের কোভিডকাল পেরিয়ে বিদ্যালয়ে কচি কচি ছাত্র ছাত্রীরা ফিরেছে। সেই আনন্দে বন্ধুদের গল্প বেশি বেশি ছোটোবেলায় লিখে পাঠাও। বন্ধু বা সইকে আগেকার দিনে মানে জয়াবতীদের সময় গঙ্গাজল বলতো, সেটা জানো তো? আরে জয়াবতী গঙ্গাজল পাতিয়ে ছিল পুণ্যির সঙ্গে। তা কেমন করে জানলাম? জানতে হলে পড়তে হবে তৃষ্ণা আন্টির লেখা জয়াবতীর জয়যাত্রা। তবে স্কুল খোলায় সবাই যে আনন্দে লাফাচ্ছে তা কিন্তু নয়। স্কুল খোলা মাত্রই মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ফলে বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে তোমরা যারা স্কুল ছেড়ে কলেজে গিয়ে পড়বে তাদের যে খুব মন খারাপ হচ্ছে তা শাশ্বতী লিখে পাঠিয়েছে। আর তপশ্রী আন্টি যে গল্পটা লিখেছে তাতে তো বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে বিদেশে যাবার জন্য সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর? তারপর তারা যেতে পারল না পারলনা সেটা আমরা আবার পরের সপ্তাহে জেনে নেব গল্পের বাকিটা পড়ে। মজার কথা কি জানো, স্কুল খুললেও বাঘ বেড়াল বা শেয়ালদের ভ্রূক্ষেপ নেই। সেটা অবশ্য আমাদের জানিয়েছে দেবজাত আঙ্কেল তাঁর কবিতা লিখে। যাক, সবই যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে তখন চলো পরীক্ষার পর আমরা বাসবদত্তা আন্টির মতো কেরালার হাউসবোটে ঘুরে আসি। কিন্তু পড়াশুনা ঘোরাঘুরি এগুলো আমরা কি উদ্দেশ্যে করি জানো? ঠিক বলেছো, কিছু জানার উদ্দেশ্যে। জানার কি আর শেষ আছে? এসো এবার আমরা পীযূষ আঙ্কেলের লেখা থেকে লীলা মজুমদার কে ছিলেন জেনে নিই। আর ছোটোরা তোমরা যারা রঙীন রঙীন ছবি এঁকে পাঠিয়ে ছোটোবেলার পাতা রঙে রঙে রাঙিয়ে দিয়েছো তাদের পাঠালাম বাসন্তী শুভেচ্ছা। - মৌসুমী ঘোষ।


ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
তৃতীয় পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
 
পুণ্যি ঠাকুরকে শীতল দিয়ে  ঘরে বসে পুঁথিপত্র পড়ছিল।  তার মা রান্নাঘরে ব্যস্ত, তাই ঘরে সে একাই ছিল। সেখানে মূর্তিমান ঝড়ের মতো হাজির হল জয়াবতী। তার মুখ দেখেই পুণ্যি আঁচ করল কিছু বিপদ ঘটেছে। সে খুব স্থির বুদ্ধির মেয়ে। সে হাতের ইশারায় জয়াকে বসতে বলে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এল। সে বুঝতেই পেরেছে জয়াবতী কোন গোপন বিষয়ে পরামর্শ করতে এসেছে।
একটু পরে দেখা গেল দুই সখি পুথির পাতায়  ঝুঁকে আছে। পুণ্যি পড়ছিল আর জয়াবতী চিত্রগুলি দেখছিল। খুঁজতে খুঁজতে একটি পাতায় এসে পুণ্যি চেঁচিয়ে বলল ‘পেয়েছি। তুই যা বললি, লক্ষণ সব মিলে যাচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের সময় এই জ্বর হয়, সঙ্গে থাকে সারা শরীর ব্যথা। যত তাড়াতাড়ি ওষুধ পড়বে তত মঙ্গল। নইলে...।’
আর কিছু বলল না পুণ্যি। ঘরে হঠাৎ করে নেমে এল এক অস্বস্তিকর নীরবতা। জয়াই সেটা ঝেড়ে ফেলে সেই পাতায় আঁকা লতাটির ওপর আঙ্গুল রেখে বলল – এই লতা আমি বুড়োশিবের মন্দিরের পেছনের জঙ্গলে দেখেছি। আমি এখনি গিয়ে নিয়ে আসব’
কেঁপে উঠল পুণ্যি। বুড়োশিবের মন্দিরটি পোড়ো মন্দির। দিনমানেও কেউ ওদিকে যেতে সাহস পায় না। তার গঙ্গাজলের মতো ডাকাবুকো ছেলেমেয়েরা খেলতে খেলতে ওদিকে গিয়ে পড়ে হঠাৎ, ওখানে বুনো শুয়োর, সাপখোপ কী নেই, তাছাড়া রাতে যাঁদের নাম করতে নেই...
‘তুই কি পাগল হলি নাকি গঙ্গাজল? লতা, বুনো শুয়োর ভূতপ্রেত  কিছুতেই যে তুই ভয় পাস নে তা আমি জানি, কিন্তু সারারাত নিশিকান্ত পাহারাওয়ালা টহল দ্যায় গোটা গ্রাম, তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা মেয়েমানুষ যাবে কী করে? তোর সঙ্গে তো কুপি থাকবে।
আলোই তোকে ধরিয়ে দেবে। তারপর দেশে এখন অরাজক অবস্থা, মোগলরা তো দেশটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, আর কোম্পানি তো এখনো কিছু গুছিয়ে বসেনি, সবাই চাইছে কত বেশি টাকা কামাবে, এর মধ্যে তোকে ধরে যদি চালান করে দ্যায়। তাছাড়া এতরাতে গিয়ে তুই কি ঠিক লতাটি চিনতে পারবি? উল্টে  বিষলতা আনবি। আমার কথা শোন, কাল পুবদিক ফরসা হবার আগেই তোতে আমাতে যাব বুড়োশিবের জঙ্গলে। কেউ জিগ্যেস করলে মিছে করে বলব তোর মায়ের মানত ছিল বুড়োশিবের থানে, মার অসুখ বলে তুই পুজো দিতে  এসেছিস’
জয়া বোঝে রাত্তিরে যাওয়ার ভাবনা ছাড়াই ভালো। সে বলে ‘কিন্তু দেরি করলে’
এই প্রথম তার চোখ ছলছল করে ওঠে। তাকে দুহাতে জড়িয়ে পুণ্যি বলে ‘কিচ্ছু হবে না আমি বলচি। তোর আজকে আর রান্নার ঝামেলা করতে হবে না। আমার সঙ্গে খই দুধ খেয়ে নে। তারপর একটু দুধ সাগু নিয়ে তোদের বাড়ি যাই, রাতটা কোনমতে কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটলেই...’
জয়ার মুখে এতক্ষণে ভোরের আলো ফোটে।
সে চিত্রটির ওপর আঙ্গুল রেখে বলে ‘এটা কী লতা?’
‘সংস্কৃতে এর নাম মধুগন্ধা, বাংলায় আমরা মধুলতা বলেই
ডাকি।’
 
রাতে দুজনের কেউই একবিন্দু চোখের পাতা বোজে না। তিন তিনটে রোগীর মাথায় জলপটি দেওয়া, জল খাওয়ানো, আবার ছোট শিশুটির দেখভাল করা, তার ওপর ভোররাতে ওঠার উত্তেজনায় ঘুমোয় না কেউই। নিশিকান্ত পাহারাওলা যেই ঢং ঢং করে তিনটে বাজাল অমনি ওরা উঠে মুখে চোখে জল দ্যায়, কাচা শাড়ি পরে। পুণ্যির বাড়ির এক বুড়ি দাসীকে বলা ছিল, সে এসে যেতেই তার হাতে সবার ভার দিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে একটা ডালায় একটু বাতাসা নেয় লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্যে। ফুল, বিল্বপত্র ওখানে প্রচুর পাওয়া যাবে।
ফাল্গুনের ভোর রাতে বেশ গা শিরশির করা ঠান্ডা। আকাশে এককোণে একফালি চাঁদ, এখনো অস্ত যায়নি। অনেকগুলো তারাও জ্বলজ্বল করছে। খুব ভালো লাগছিল ওদের। এইরকম সময়ে ওরা কোনদিন বাড়ির বাইরে আসেনি তো। দূর থেকে নিশিকান্তর লাঠির ঠকঠক শুনে ওরা একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। তারপর দে দৌড়, দে দৌড়। ওদের চুল ওড়ে, আঁচল ওড়ে। মনে হয় যেন মা বসুন্ধরার বিজয় পতাকা উড়ছে।
ছুটতে ছুটতে ওরা যখন বুড়োশিবতলায় পৌঁছয় তখন ভোরের আলো ফুটছে।এমন সময়ে কখনো আসেনি এখানে। কে বলে এটা ভয়ঙ্কর জায়গা? ভোরের নরম আলোয় কি অপরূপ দেখাচ্ছে যে বলার নয়। বুড়োশিবের মন্দিরের পেছনে জঙ্গলে ঢুকতে যদিও একটু গা ছমছম করে, এই সকালেও কি অন্ধকার। একটু পরে অভ্যেস হয়ে যায়। পুণ্যি পেয়েও যায় মধুলতার গাছ, সে পাতা তো তোলেই, শিকড়সুদ্ধ একটি কচি লতাও তোলে। চলে আসার আগে বাতাসা আর ফুল বেলপাতা শিবকে দিয়ে আসতে ভোলে না ওরা। আবার দৌড়, দৌড়, দৌড়। বাড়ি ফিরেই নল খুড়ি নিয়ে বসল দুজনে। সব ধুয়ে মুছে গেছিল। জয়া জিজ্ঞেস করল ‘দীননাথ সেনমশাই তো স্বর্ণ ভষ্ম, পারদ, গন্ধক এইসব দিয়ে ঔষধ বানান, ওইসব কোথায় পাব?’
পুণ্যি গম্ভীর গলায় বলল ‘ওইসব না। যা লাগবে তা হল মধু আর ছাগ দুগ্ধ’
জয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। হারানের মা একমাত্র ছাগলের দুধ দোয়, সে আবার গেছে তার মেয়ের বাড়ি, অনেক দূরে।
হঠাৎ দুর্গাগতির কান্নায় তার হুঁশ আসে। খিদে পেয়েছে ভাইয়ের, সে ভাইকে মায়ের ঘরে এনে মায়ের দুধে মুখ দেওয়ায়। মায়ের অন্য বুক থেকে অঝোরে দুধ পড়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে পুণ্যিকে চেঁচিয়ে বলে ‘আচ্ছা, কালি তৈয়ারি করতেও ছাগলের দুধ, ঔষধেও তাই, কেন বল তো?’
পুণ্যি খল নুড়িতে মধুলতার পাতা ছেঁচতে ছেঁচতে বলে ‘ছাগলের দুধ গন্ধ বলে কেউ খেতে চায় না, আর যদি এসব কাজে গরুর দুধ দেওয়া হত, তবে শিশুরা খেত কি? আসলে কি জানিস? এইসব ওষুধ একটা শুদ্ধ তরলে খাবার নিয়ম।যাতে শরীরে ভালভাবে ছড়ায়।  জলে  অনেকসময় ময়লা থাকতে পারে। দুধ তো শুদ্ধ।’
জয়ার মাথায় বিদ্যুত চমক খেলে যায়। মায়ের দুধের চেয়ে শুদ্ধ কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে? সে দৌড়ে গিয়ে ঠাকুরঘর থেকে একটা পরিষ্কার পাথরের খুরি এনে মায়ের বুকের কাছে ধরে।পুণ্যি দাওয়া থেকে অবাক হয়ে দেখে তার এই কাণ্ড। জয়া এই দুধ নিয়ে  পুণ্যির বলা মাপ মতো তৈরি করে ফেলে ওষুধ, মধু  তো ঘরেই ছিল।

৬ 
রাঁধনি রাঁধছে, কালীগতি ছেলেকে খেলা দিচ্ছেন, ওর মা এখন অক্ষর মকশো করতে ব্যস্ত। দুর্গাগতি একটা পাতার বাঁশি টানে খালি, দেখে মন খারাপ হয় কালীগতির। নাহ, মন খারাপ করবেন না। মেয়ে তো গেছে মোটে তিনটে গ্রাম দূরে, পুজোর সময় নিয়ে আসবেন। খবর পেয়েছেন সে সেখানে মহানন্দে আছে, দীননাথ সেনমশাইয়ের কাছে পরম আগ্রহে চিকিৎসা বিদ্যা শিখছে দুই সখি। পুণ্যি পুথিগত বিদ্যায় অনেক এগিয়ে গেলেও, ব্যবহারিক জ্ঞানে জয়াকে কেউ হারাতে পারবে না। ওষুধ তৈরিতে এবং রোগীর সেবায় তার নাম পাঁচ গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। অবসর পেলে দুই সখি আগের মতোই গলা জড়িয়ে গল্প করে। বিশেষ করে সেই রাতে বুড়োশিবের জঙ্গলের স্মৃতি কেউ ভুলতে পারে না। ( ক্রমশ)

বাঘের মাসী
দেবজাত

শেয়াল যখন খেয়াল শোনায়
বেড়াল বাজায় বাজনা
ম্যাও ম্যাও ম্যাও মিঁয়াও মিঁয়াও
শুনতে লাগে কান্না । 

সেই না শুনে ব্যাঘ্রমামা
দিলেন জোরে হালুম
বাদ্য, গীতি এবার থামা
হলো তোদের মালুম  ? 

ঘুমের সময় এসব আপদ
কোথ্ থেকে যে আসে ? 
এইনা বলে পাশ ফিরে এক
নিদ্রা দিলেন ঘাসে । 

শেয়াল দেখে লেজ গুটিয়ে
দৌড় দিলো কশে
বিল্লি ঘুরে খিল্লি খেয়ে
ভাবলো বসে বসে । 

বললো গিয়ে বাঘের কানে
মুখটা নিয়ে আসি
শেয়াল তোমায় ডরায় ডরাক
আমি কিন্তু মাসী ! 

সেই না শুনে ব্যাঘ্রমামার
বেজায় পেলো হাসি
বললো হেসে, একটু কেশে
তোমায় ভালোবাসি।

দীপাঞ্জন ইন এ স্যুপ
তপশ্রী পাল

ভারী মুশকিলে পড়েছে দীপাঞ্জন । এমনিতে সে মায়ের আদরের গোপাল । মোটাসোটা নধরকান্তি চেহারা। সকাল বিকেল দুবেলা মায়ের রান্না ডাল, বেগুন ভাজা, কচি পাঁঠার ঝোল অথবা মাছের মুড়ো দিয়ে ভাত না খেলে তার চলে না । এতোবড়ো ছেলেকে এখনো মা গরাস করে খাইয়ে দেন প্রায়ই । কারণ মায়ের মতে না খেয়ে খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। তারপর এমন পড়ার খাটনী, বাছা কি সহ্য করতে পারে? ঘুমোতেও ভারী ভালোবাসে দীপাঞ্জন। তার নিজের ঘরের নরম বিছানায় শুয়ে রাতের ঘুম তার প্রিয় । হায়ার সেকন্ডারী পড়লে কি হবে? মায়ের আদরে আদরে তার মনটা শিশুই রয়ে গেছে । শোয়ার আগে এখনো হাঁদাভোদা, কিংবা ফেলুদা, অথবা বাংলা ছোটদের ম্যাগাজিনের গল্প না পড়লে খালি খালি মনে হয় কেমন। দীপাঞ্জন যে পেটুক এ কথা তো বলাই বাহুল্য। সব ভালো খাবারের মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় হলো চাইনীজ খাবার! তাই দীপাঞ্জনের বাবা প্রায়ই নিয়ে আসেন জিভে জল আনা নুডল বা ফ্রায়েড রাইস, ওয়ান্টন স্যুপ আর চিলি চিকেন বড়ো দোকান থেকে। এ বাদে টুকটাক পাড়ার দোকানের মোমো, চাউমিনও চলে দীপাঞ্জনের। ওঃ পাড়ার সৌরভস-এর দোকানে ঝাল ঝাল চাউমিনটা যা করে না – এক ঘর!  
এ সব নিয়ে তো জীবনটা বেশ চলছিলো । মুশকিলটা হোল ক্লাস টুয়েলভে ওঠার পর। বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো সব বন্ধুদের মধ্যে । যেন যে করে হোক বিদেশী কোন একটা ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পেলে আর জাতে ওঠা যাচ্ছে না । কেন বাপু আমাদের যাদবপুর, শিবপুর – নিদেন ভালো কোন প্রাইভেট ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ কি দোষ করলো? আর কলকাতা পছন্দ না হয় বম্বে দিল্লী মায় হাতের কাছে ভুবনেশ্বরে তো ভালো ভালো কলেজ খুলেছে! আর সবাইকে যে ইঞ্জিনীয়ার ডাক্তারই হতে হবে তাই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে শুনি? তা সে সব কথা বন্ধুরা শুনলে তো!
অতএব সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে অ্যাপ্লিকেশন পাঠানো শুরু হলো বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে! পড়তে টাকা লাগবে প্রচুর! তাই স্কলারশিপ না পেলে সেখানে যাওয়ার আশায় ছাই আর স্কলারশিপ পেতে হলে দিতে হবে পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ, লিখতে হবে পেপার! কম হ্যাপা? এমনিতে তো দিনের মধ্যে ছ ঘন্টা ক্লাস আর ছ ঘন্টা টিউশন আছেই! দীপাঞ্জনের বাপু কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ মোটে ভালো লাগে না! গাদা গাদা ফরমুলা আর রিঅ্যাকশন দেখলেই মাথা ঘোরে কেমন! রাতে আজকাল ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাসের দুঃস্বপ্ন দেখছে মাঝে মাঝে! ক্যালকুলাসের এস এর মতো লিমিট সাইনগুলো যেন সাপের মতো ওর গলা পেঁচিয়ে ধরছে! জয়েন্ট-এর কোচিং-এর কুন্ডু স্যারের  অংক ক্লাস তো বিভীষিকা! এখন মানে মানে আগে টুয়েল্ভটা পাশ করতে পারলে হয়! এই সব করতে গিয়ে আসল পরীক্ষাটাই না গোল্লায় যায়! ভেবে ভেবে আজকাল মাছের মাথাও বিস্বাদ লাগতে শুরু করেছে দীপাঞ্জনের।
এই তো সেদিন, মা টিফিনে নরম নরম লুচি আর নতুন গুড়ের পায়েস দিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ রসিয়ে রসিয়ে খাচ্ছে দীপাঞ্জন, এমন সময় হৈ হৈ করতে করতে হাতে জেরক্সের গোছা নিয়ে ঢুকলো প্রান্তিক, প্রিয়ম, সাত্ত্বিক, সায়ন, মধুরা আর জয়িতা। একসঙ্গে অ্যাপ্লাই করছে অ্যামেরিকার পাঁচটা, জার্মানির দুটো, সুইডেনের তিনটে মায় রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে দুটো ইউনিভার্সিটিতে! এসেই প্রিয়মটা ওর টিফিনবক্স থেকে দুখানা লুচিতে অনেকখানি পায়েস লাগিয়ে মুখে পুরে বললো “এই যে মিস্টার গোবর গণেশ, শুধু খেলে হবে? দ্যাখ আমাদের অ্যাপ্লিকেশন গুলো দ্যাখ! ক্যারিয়ার তৈরীর কথা ভাব মোটু!” ওর হাত থেকে অ্যাপ্লিকেশনগুলো নিয়ে চোখ গোল গোল করে দেখতে দেখতে দীপাঞ্জন বলে “হ্যাঁ রে! সাইবেরিয়ায় আবার ইউনিভার্সিটি আছে নাকি! ওখানে তো শুধুই বরফের মরুভূমি! ওখানে কোন মানুষ থাকে না! শুনেছি টেম্পারেচার মাইনাস তিরিশে চলে যায়! মরে যাবি রে! আর জার্মানিতে তো কেউ ইংরাজী জানেই না! কথা বলবি কী করে!” প্রান্তিক হ্যা হ্যা করে হেসে বললো “হ্যাঁ, ঐ ভেবেই ঘরে শুয়ে থাক! বিদেশী ইউনিভারসিটিতে পড়তে হলে না, একটু কষ্ট করতে হয়! তোর লাইফে কোন এইম নেই? টার্গেট নেই?” বলেই দীপাঞ্জনের বাকি দুটো লুচি সাঁটিয়ে দিলো কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করে! 
এরা বন্ধু না শত্রু দীপাঞ্জন ভেবে পায় না। এরপর কেউ কেউ পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে আমেরিকায়, তারপর ইউরোপের নানা জায়গায় পেয়ে গেলো স্কলারশিপ! তখন টিচারদের কাছে তাদের কি কদর! যেন তারা ভগবান আর দীপাঞ্জনের মতো ছেলেরা বাণের জলে ভেসে এসেছে। আবার কয়েকজন বন্ধু, যাদের বাবারা বিগ শট, তারা স্কলারশিপ না পেয়েও বাবার টাকায় দিব্যি বিদেশী ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলো। বাকীরা হয় আই আই টি, নয় কে আই টি, নয় ভি আই টি মোদ্দা কোন একটা আই টি তে যাবে বলে ঠিক করে ফেললো। শুধু দীপাঞ্জনের মতো কয়েকজন পড়ে রইলো কলকাতায় পড়াশুনার জন্য। একদিন কুন্ডু স্যার মাথায় চাঁটি মেরে বললেন “কি রে! তুই বাইরে যেতে চাস না? শুধু ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট দিবি? জানিস কটা সিট আর কতো ছেলে পরীক্ষা দেবে? তুই যা কুঁড়ে – তোর পাওয়ার চান্স জিরো পয়েন্ট ওয়ান পারসেন্ট!” বলে মুখ মটকে হলদে দাঁত বার করে হাসলেন। দীপাঞ্জন ফিজিক্স ভারী ভালোবাসে। পারবেন স্যার ওকে ফিজিক্সের কোন প্রশ্নে হারাতে? হুঃ – ভাবে দীপাঞ্জন। যেন সবাইকে বাইরে যেতেই হবে – যেন সবাইকে ইঞ্জিনীয়ারিং-এ চান্স পেতেই হবে! এতো চাপ দীপাঞ্জনের সহ্য হয় না। পাশ টাস করে ঘরের ভাত খেয়ে কলকাতার একটা কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে পারলেই দীপাঞ্জন খুশী।
তারপর একদিন এইচ এস এর রেজাল্ট বেরুলো, জয়েন্টেরও। কোনরকমে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে দীপাঞ্জন! কিন্তু জয়েন্ট? সে গুড়ে বালি। নো চান্স। তালের বড়ার মতো মুখ করে বসেছিলো দীপাঞ্জন। মা বললেন “ভালোই হয়েছে দীপু! তুই বাপু ওদের পিছু পিছু ছুটিস নি, ভালোই হয়েছে! দ্যাখ দেখি, গরম গরম কটা বেগুনী ভাজলুম। কেমন হয়েছে!” দীপাঞ্জন বেগুনীতে কামড় দিয়ে বললো “আঃ দারুন! কিন্তু আমার ফুটুর ডুম মা!” “ফুটুর ডুম! সে আবার কি রে?” গোল গোল চোখে বলেন মা। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া বোনটা, পাশ থেকে খি খি করে হেসে বললে “দাদার ফিউচার ডুমড মা!” মা বললেন “কেন রে! কে আমার দীপুর ফিউচার নষ্ট করে দেখি! কাল থেকে তোকে রোজ মেটের চচ্চড়ি খাওয়াবো! তোর ব্রেন আরো ভালো হবে! তুই কি নিয়ে পড়তে চাস বাবা? যা তোর ভালোলাগে তাই পড়।“ সব শুনে বাবার ভুরু তো সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়েই রইলো। মাকে ধমক দিয়ে বললেন “আরো আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে ছেলেকে গোবর গণেশ বানাও! কোথাও চান্স পেলে না! এবার কি ঐ অপদার্থ বিদ্যা নইলে ইতিহাস পাতিহাস, বাংলা জংলা যত দুচ্ছাই সাব্জেক্ট নিয়ে পড়বে? চাকরী পাবে কোথাও? হয় দালালী করতে হবে নয় চপের দোকান খুলতে হবে – বলে দিলুম হ্যাঁ!”
দীপাঞ্জনের খুব রাগ হলো বাবার কথা শুনে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেললো যা থাকে কপালে – সে বাবার কাছ থেকে এক পয়সা নেবে না পড়াশোনার জন্য । দরকার হলে টিউশন করবে তাও ভালো! বাবাকে দেখিয়ে দিতে হবে কোন সাব্জেক্টই ফ্যালনা নয়!
 (ক্রমশ)

নীল বাড়ি 

শাশ্বতী কর
দ্বাদশ শ্রেণী, আশোকেনগর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়(উ: মা)

দেখতে দেখতে আটটা বছর কেটে গেলো ...তাই না? মনে পড়ে যেদিন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল?..আমার কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে- একটু মড়চে    ধরা ফিকে হয়ে যাওয়া একটা নীল গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে পাশে আম, জাম বাগানকে ফেলে রেখে  একটা দেবদারু গাছের নীচে যখন এসে দাঁড়ালাম ঠিক তখন দেবদারুর পাতাগুলো আমার চুল, হাতকে স্পর্শ করে নিচে পড়ল আর ঠিক তখনই শীতের হাওয়া ব‌ইতে লাগল, রোদ-ছায়ার মাখামাখি খেলাতে আভা আলোয় একটা সবুজ চাদরে জড়ানো  নীল ঝকঝকে রংমহলের কে সেদিন প্রথম দেখলাম। মনে হয়েছিল ভালোলাগা-ভালোবাসার একটা নতুন পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছি। সত্যিই সেদিনের সব ভাবনা গুলো ঠিক ছিল। এক মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছি ..যার দুঃখে আমার দুঃখ ,যার আঘাতে আমার আঘাত আর যার আনন্দে আমার আনন্দ।
বলা যেতে পারে,আমার জীবনের এক অধ্যায় কিংবা শুরু থেকে শেষের গল্প। আনন্দ,হাসি,কান্না, অভিমান , কষ্ট -এসব দিয়েই সময়গুলো কিভাবে যেন কাটিয়ে দিলাম..... আমার প্রথম স্টেজে উঠে আবৃত্তি করা....কাঁপা কাঁপা গলায় বক্তৃতা দেওয়া.... ধীরে ধীরে এগুলো অভ্যাসে পরিণত হতে শুরু করেছিল।
দু-চারটে কবিতা জানতাম তো তাই হয়তো একটু তাড়াতাড়ি তোমাকে আপন করতে পেরেছিলাম।

হঠাৎ একটা সুন্দর বাগান চোখে পড়ল .. পলাশ, শিমুল, রজনীগন্ধার গন্ধ ভেসে আসছে। বাগান থেকে একটা পলাশ ফুল তুলে মাথায় গুঁজেছিলাম।
..... তারপর দমকা হিমেল হাওয়ায় আকাশের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম পাখিরা ঘরে ফিরছে, 

দিনের আলোটা ক্রমশ নিভে আসছে.... সমস্ত কিছু পাল্টে যাচ্ছে..... আমার রংমহল সরে যাচ্ছে ...... ভালোবাসার হাতগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে..... দেবদারু গাছটা দাঁড়িয়ে আছে পাতা ঝরিয়ে..... এমন সময় হঠাৎ আমার ওড়নাটা কিসে যেনো টান লাগলো  পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঘাসের ছোট্ট পাতাটা চেপে ধরেছে আর সন্ধ্যার আলোয় ফিকে হয়ে যাওয়া সোনার রংমহল অর্থাৎ নীল বাড়িটা বলছে-স্মৃতি গুলোকে ব্যাগে ভরতে। ব্যাগ থেকে কাচের বোতলটা বের করে স্মৃতিগুলোকে নিয়ে আবার এগিয়ে চলি।
কখন যে সেই নীল গেটটার কাছে পৌঁছে গেছি জানিও না.... বুঝি এবার ফিরতে হবে ....একটু থেমে আবার   পিছন ফিরে তাকিয়ে বাগান কে বলি- আমার নীল বাড়ির সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্য সবুজ থেকো... বাঁচিয়ে রেখো সমস্ত কিছুকে সুন্দরভাবে.....  

অন্ধকার হয়ে আসছে সবকিছু.... ঝাপসা হচ্ছে চশমার কাঁচ.... ভালো থেকো... ভালো থেকো... গলাটা ধরে আসছে... চোখটা আজ আর বাঁধ মানতে চাইছে না.... ভালো থেকো আমার প্রিয় "নীল বাড়ি"।


[আজ আমার প্রিয় নীল বাড়ি(আদর্শ স্কুল)এর জন্মদিন তাই আমি এই লেখাটা আমার স্কুলকে  উৎসর্গ করলাম। এতো গুলো বছর তো দেখতে দেখতে কেটে গেলো।আমার স্কুল আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে...]❤️❤️



ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই ( কেরালা)
কলমে - বাসবদত্তা কদম
পর্ব ৭  

সেই দুপুরে আমাদের কেতুভল্লম পাক্কা সাড়ে তিনঘন্টা আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ালো ভেমবনাদের বুকে। ভরপেটে আর জলের হাওয়ায় আমার তখন বেজায় ঘুম পাচ্ছে।
বসে বসে ঢুলছি দেখে মাঝিদাদা বললেন, ওনাদের কফি দে
কফি খেয়ে একটু চাঙ্গা হতে দেখি, দূরে দূরে সব দ্বীপ। 
-এই হ্রদের আশেপাশে অজস্র দ্বীপ গড়ে উঠেছে, যেভাবে দ্বীপ তৈরী হয় নদীর মোহনায়। 
তা ঠিক। আমাদের সুন্দরবনের আশেপাশেও তো এভাবেই গড়ে উঠেছে অজস্র দ্বীপ আর আজো তৈরী হয়েই চলেছে। এখানেও তাই। ঐ যে সেই নারকেল দ্বীপ, সে হলো কুট্টি দ্বীপ। মানে ছোট বা শিশু দ্বীপ, যে এখনো বসবাসের উপযুক্ত হয় নি। 
-বন্দর শহর কোচি, সেও কিন্তু ভেম্বনাদেরই দুখানা দ্বীপ জুড়ে গড়ে উঠেছিল বহু বহু বছর আগে। 
গল্প শুনতে থাকি আমি আর ভাবতে থাকি আমাদের সুন্দরবনের সাথে কত মিল এই অঞ্চলের। সুন্দরবনেরই মত বিশাল জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ অঞ্চল এই লেকের আশপাশের অঞ্চলে। অজস্র ছোট বড় প্রানীর বাসভূমি এই বিশাল জলাভূমি, কত যে মাছ পাখি এই অঞ্চলে। প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে এইসব অঞ্চল, তা তোমরা জানবে ভূগোলের বইয়ে। ম্যানগ্রোভ গড়ে ওঠে মিষ্টি আর নোনতা জলের মিশেলে। আর ম্যানগ্রোভ রক্ষা করে সেই অঞ্চলের জমি মাটি এবং আবহাওয়াকে। এ জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য আয়তনে আমাদের সুন্দরবনের থেকে ছোট অবশ্যই কিন্তু নেহাত ছোটও নয়।
মাঝিদাদা আর তার স্যাঙাৎদের সাথে গল্প করতে করতেই দেখি আমরা ঢুকে পড়ছি খালে। এরকম কত যে অজস্র খাল জুড়ে বইছে ভেম্বনাদের জল। তবে কষ্টের কথা এটাই দেখলাম ভেম্বনাদ হ্রদেরও জায়গায় জায়গায় শহুরে নোংরা প্লাস্টিক, জল আর কোল্ডড্রিংক্সের বোতল ইত্যাদি জমে দূষণ তৈরী করে চলেছে। প্রকৃতি আমাদের এত সুন্দর সুন্দর উপহার দেয় আর আমরা মানুষরা নোংরা বর্জ্যটুকুকেও সামলে রাখতে পারিনা। কি লজ্জার কথা তাই না?
এসময় দেখলাম মাঝিদাদারা সব স্যাঙাৎ মিলে ঐ বিশাল নৌকাখানাকে বেঁধে ফেললে পাড়ের সঙ্গে। শুনলাম আমাদের নৌকা সারারাত এখানেই থাকবে। আমরা নেমে গ্রাম দেখতে যেতেই পারি। সন্ধের পর নৌকায় উঠে পড়তে হবে। বাইরে নাকি ভয়ঙ্কর মশা।
আমরা বেরিয়ে পড়লাম গ্রামে। একটু আধটু যা দেখা যায়।
কি আর বেশি দেখব, কথা তো বলতে পারছি না গ্রামের লোকেদের সঙ্গে। যা যতটুকু ইশারায় বা ভাঙা ইংরেজিতে। দক্ষিণ ভারতের গ্রামের মানুষ হিন্দি একেবারেই বোঝেন না। আলাপুZhআর বাড়িগুলোর ধরণ খালের পথে চলতে কিছুটা দেখেছিলাম তবে গ্রামের ভেতরের বাড়ি দেখলাম। বেশ অন্যরকম। ঠিক যেন টুকরো টুকরো ঢালু টিনের ছাদ। সম্ভবত কেরালার অতিবৃষ্টির জন্যেই এই ব্যবস্থা। পুরো ভারতবর্ষের বৃষ্টির সিংহ দরজা হোল কেরালা। মৌসুমী হাওয়া এখান দিয়ে ঢুকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতবর্ষে।
এবারে কেরালার ব্যাক ওয়াটারে সূর্যাস্ত শুরু হলো। চারপাশ আগুনে রঙে ভরে উঠলো। রঙ ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিনমনি যখন ক্লান্ত হলেন তখন অন্ধকার এসে তার আঁচল পেতে দিল। 
আমরা তো সন্ধের আগেই ঢুকে পড়েছি হাউসবোটে। একদফা চা মাছভাজার পর অন্ধকার রাত্রিতে বার বার আমাদের হাউসবোটের পাশ দিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম লঞ্চের শব্দ। শুনলাম ওগুলো সব শাটল। বোঝো ঠ্যালা, শাটল ট্যাক্সি আর অটোর মত শাটল লঞ্চ। লোকজন বাড়ি ফিরছে। কালকে আবার সবার অফিস ইস্কুল আছে তো। আমরা রাত্রে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম খুব তাড়াতাড়ি। রাত্রে কিছু দেখাও যায় না, আর কারুর কি হাউসবোটে বসে টিভি দেখতে ইচ্ছা করে নাকি। পরদিন সকালের ব্রেকফাস্ট হলো ঐ গ্রামের পাশে বসেই। তারপর রওনা দিল হাউসবোট।
আবার ফিরে এলাম সেই যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেখানে।
না না কেরালার গল্প মোটেই ফুরিয়ে গেল না, কেরালা মানে কি শুধুই হাউসবোট আর আমাদের দেশের ভেনিস আলাপুZhআ নাকি? এরপর আরো ক-ত কিছু দেখার আছে। তবে হাউসবোটের বেড়ানোটা শেষ হলো।

স্মরণীয়
(লীলা মজুমদার)

কলমে - পীযূষ প্রতিহার

কলকাতার গড়পাড় রোডের বিখ্যাত রায়বাড়িটি আমরা সবাই চিনি। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ তো আছেনই, এছাড়াও আছেন সুখলতা, পূন্যলতা এবং লীলা রায়। লীলা রায়কে আমরা লীলা মজুমদার (বিয়ের পরের পদবী) নামে চিনি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই প্রমদারঞ্জন এর কন্যা এই লীলা মজুমদার। তাঁর মা ছিলেন সুরমা দেবী। লীলা মজুমদারের জন্ম হয় ১৯০৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। ছোটোবেলায় লীলার পড়াশোনা হয় শিলং এর লরেটো কনভেন্টে। পরবর্তী শিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। লীলার কর্মজীবন শুরু হয় দার্জিলিঙে 'মহারানী গার্লস স্কুল' এর শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে শান্তিনিকেতনে কিছুদিন শিক্ষিকা হিসেবে কাটিয়েছিলেন। তারপর কলকাতার আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন।
 ১৯৩৩সালে ডা: সুবীর মজুমদারকে বিয়ে করলে বাবার বিরাগভাজন হন ও পিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয় যদিও বাবার বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ অটুট ছিল। বিবাহিত জীবনে দুই সন্তানের জননী লীলাকে লেখালেখিতে উৎসাহ প্রদান করতেন তাঁর স্বামী। বহু বিচিত্র গামী তাঁর লেখালেখির জগত। ছোটদের জন্য বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অসীম। ছোটদের দেখা অদ্ভুত সব স্বপ্নের কথা, ভূতের গল্প, কল্পনার গল্প প্রভৃতি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে থামা যায় না। ছোটদের জন্য তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি রচনা হল 'হলদে পাখির পালক', 'পদিপিসির বর্মি বাক্স', 'সব ভুতুড়ে', 'টং লিং', 'গুপীর গুপ্তখাতা', 'মাকু' প্রভৃতি। যদিও হাতেখড়ি হয়েছিল যখন তুতো দাদা সুকুমার ১২ বছর বয়সী লীলাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন জীবনের প্রথম গল্প 'লক্ষীছেলে', 'সন্দেশ' পত্রিকার জন্য ১৯২২ সালে। তিনি লিখেছেন 'জ্যাঠামশাইরা, জ্যাঠামশাইয়ের ছেলেমেয়েরা সবাই গল্প লিখতেন, চমৎকার ছবি আঁকতেন। সুখলতাদির পরিদের গল্প পড়ে মুগ্ধ হতাম। ছোটো জ্যাঠা কুলদারঞ্জনের রবিনহুড পড়ে তো প্রায় অজ্ঞান!' তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জন রায়ও শিশুদের জন্য 'সন্দেশ' এর পাতায় ধারাবাহিক লিখতেন 'বনের কথা'। বড়দের জন্য প্রথম গল্প 'সোনালি রুপালি' লিখেছিলেন বন্ধু বুদ্ধদেব বসুর উৎসাহে 'বৈশাখী' পত্রিকায়। ছোটদের জন্য লিখতেন 'মৌচাক', 'রামধনু' ও 'রংমশাল' পত্রিকায়। বড়দের জন্য লিখতেন 'বৈশাখী' ও 'পরিচয়' পত্রিকাতে। ১৯৫৬ সালে তিনি যোগ দেন কলকাতা বেতারের চাকুরিতে। বেতার কেন্দ্রের সাত বছরের চাকুরি জীবনে তিনি লিখেছেন অসংখ্য কালজয়ী লেখা। 'ঠাকুমার চিঠি', 'ইষ্ট কুটুম', 'টাকার গাছ', 'বক বধ পালা', 'লঙ্কা দহন পালা' প্রভৃতি লিখেছিলেন নানা অনুষ্ঠানে প্রচারের জন্য। ১৯৬১সালে সত্যজিৎ রায় পুনরায় 'সন্দেশ' প্রকাশ করলে লীলা মজুমদারকে যৌথ সম্পাদক করেন। তারপর সেখানে ক্রমশ লিখেছেন 'টং লিং', 'হট্টমেলার দেশে', 'বালী-সুগ্রীব কথন', 'নেপোর বই' প্রভৃতি। এছাড়াও লিখেছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্রের পরামর্শে আত্মজীবনী 'আর কোনখানে' ও ১৯৭৭ এ মনীন্দ্র রায়ের অনুরোধে 'অমৃত' পত্রিকার জন্য লিখেছেন 'পাকদন্ডী'। তিনি অনেক শিক্ষামূলক ও রম্যরচনা ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর সব লেখা হয়তো এখনও পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি।
    তিনি পুরস্কার পেয়েছেন অঢেল। ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে 'বক বধ পালা' নাটকের জন্য সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে 'আর কোনখানে' এর জন্য পান রবীন্দ্র পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভুবনমোহিনী সুবর্ণপদক, ভুবনেশ্বরী পদক, দেশিকোত্তম, ডি লিট প্রভৃতি।
     ২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল দীর্ঘ রোগভোগের পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


পাঠপ্রতিক্রয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৭০ পড়ে রাইলি সেনগুপ্ত যা লিখেছে) 

"ফিরিয়ে দাও ছেলেবেলা!"- আমাদের অনেকেরই হয়তো একটাই আকুতি। আর তাই রোব্বারের সকাল বেলায় অপেক্ষায় থাকি লেখিকা মৌসুমী ঘোষ এর ছোটবেলা সংখ্যার- খুব যত্নে তৈরি ছেলেবেলায় পৌঁছে যাওয়ার এক চাবিকাঠি। আন্তরিক ধন্যবাদ ও অফুরান শুভেচ্ছা জানাই ছেলেবেলার কারীগর তথা সম্পাদিকা কে। আজ আবার ইচ্ছে হল ছেলেবেলার সাথে কথা বলার, অপেক্ষার বিকেল ও আনন্দের সকালকে নিয়ে বসলাম ছোটবেলার কাছে-

 কাশের বনে ঘুমিয়ে আছে, প্রিয় ছেলেবেলা-
প্রদীপ্তময়ের ছবিতে সেথা, ফিরে যাওয়ার পালা।
শৈশবের সেই ক্যানভাসে, রঙ দিয়েছে তুলি,
শ্রীপর্ণা, ঋদ্ধিত ও প্রবাহনীলের অঙ্গুলি।
রঙের পরশে পিছু হাঁটি যখন, 'ঐ শুকনো গাছটায়',
শামুকা দেয় আশ্বাস তখন, উদ্বাস্তু মনের কিনারায়।
গোঁড়ামিদের মুক্তি দিয়ে, আলোর ঝর্ণাধারায়,
তৃষ্ণা আনে নবজাগরণ,'জয়াবতীর জয়যাত্রা'য়।
বাকদেবীর ছবিতে ভাসে বসন্ত পঞ্চমী,
'বাণী বন্দনায় আমার বিদ্যালয়' ফিরিয়ে দেয় মৌসুমী।
'মা সরস্বতীকে' চুপি চুপি বলেই দিল মলয়,
জ্ঞানের আলো আসুক ভরে, হোক বর্ণ পরিচয়।
আদর্শ ধারণ করে,সংগ্রামী'র 'আকাশপ্রদীপ জ্বলে',
'বহুদূর দূর যেতে হবে', সে প্রত্যয়ী হলে।
বিষাদ মেখে অবসরে, মনকেমন হয় যখন,
বাসবদত্তা'র লেখনীতে, করছি কেরালা ভ্রমণ।
হারিয়ে গেল সুরের যাদু, অকস্মাৎ ইন্দ্রপতনে,
পীযূষের শব্দবন্ধে, লতাজিকে, হারায়ে খুঁজি যতনে।
বানীয়া'র অনুভূতিতে, ফিরে দেখি ছোটবেলা-
খুশির সব পসরা নিয়ে, হারিয়ে যাবার পালা।

ছোটবেলাটা বড্ড প্রিয়, হাতছানি দেয় আবার,
দক্ষিণের দুয়ার খুলে, সাধ হয় ফিরে যাবার!

আরও পড়ুন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments