জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭০

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৭০
সম্পাদকীয়,
এবারের সংখ্যার বিশেষত্ব, প্রদীপ্তময় পালের পাঠানো প্রচ্ছদ চিত্রটি সাদা কালো। শুধু তাই নয়, এবারের সংখ্যার খুদে চিত্র শিল্পীরাও প্রত্যেকে সাদা কালো ছবি এঁকে পাঠিয়েছে। হবে না কেন? সরস্বতী পুজো হয়ে গেল, সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর সরস্বতী ঠাকুরের হাত ধরে সুর লোকে ফিরে গেলেন। তাই তো সংগ্রামী আন্টি আর পীযূষ আঙ্কেল তাদের লেখায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন লতাজীকে। মন খারাপের কি আর শেষ আছে? তোমাদের বন্ধু শামুকা একটা শুকনো গাছের গল্প লিখেছে। এদিকে জয়াবতীর মা বাবার খুব জ্বর।এত মন খারাপ সত্বেও আনন্দের খবর তোমাদের স্কুলগুলো খুলছে। সেই স্কুলের সরস্বতী পুজো নিয়ে লিখেছে মৌসুমী আন্টি আর মলয় জেঠু। উৎসবের কথা এখানে শেষ ভেব না।কেরালার ওমান উৎসব নিয়ে লিখেছে তোমাদের প্রিয় বাসবদত্তা আন্টি। আর হ্যাঁ, একটা কথা বলি, সাদা কালো ছবি আঁকা কিন্তু খুব সহজ নয়। এই কঠিন কাজটা শ্রীপর্ণা, প্রবাহনীল, তুলি আর ঋদ্ধিত করেছে আর জয়াবতী কি করেছে জানো? জ্বরের ওষুধ বানিয়ে মা বাবাকে সুস্থ করবে বলে জয়াবতী....  না বাবা আগে ভাগে বলব না, তাহলে তৃষ্ণা আন্টি আমাকে বকবে। তোমরা পড়ে জানিও, জয়াবতীর জয়যাত্রা কেমন লাগছে। শুধু ভাল বললেই হবে না কিন্তু সংখ্যাটি পড়ে প্রতিক্রিয়া পাঠাও।  -- মৌসুমী ঘোষ।




ধারাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
(দ্বিতীয় পর্ব)
তৃষ্ণা বসাক


নতুন রাঁধনি আসার পর সব বেশ সুশৃংখলভাবেই  চলছিল। তাঁর স্ত্রী দুর্গাগতির কাছে কাছেই থাকতে পারেন  সর্বক্ষণ, তিনি পুথি নিয়ে থাকেন আর জয়া নিজের মতো থাকে। সে কখনো কালি তৈরি করে, কখনো তাঁর পুথিগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করে, কখনো ভাইয়ের জন্যে পাতা দিয়ে বাঁশি কিংবা কাঠের খেলনা বানায়, অথবা বনে জংগলে ঘুরে বেড়ায়। ওর মা বারণ করে করে হেরে গেছেন, মেয়ে বেরোলে তিনি পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলেন ‘কি ডাকাতে মেয়ে রে বাবা! একা একা ওই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে ঘোরে, আপনি কালই যদুনাথ ঘটককে খবর দিন। ওরে,  চুলে অন্তত একটা গিঁট দিয়ে যা’
জয়া যেতে যেতে বলে ‘ঠিক দুক্কুর বেলা। ভূতে মারে ঠেলা। ভূতের নাম রসি। হাঁটু গেড়ে বসি। চিন্তা করো না মা, পুণ্যিতে আমাতে মিলে যাই। একা যাই না’
পুণ্যি পাশের বাড়িতেই থাকে, জ্ঞাতির মেয়ে, বেচারি বালবিধবা। জয়ার সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়েছে।
 
মাঘ মাস গিয়ে ফাল্গুন পড়ল। কচি কচি আম্রপল্লবে সকালের রোদ পড়ে কি অপরূপ  দেখায়। এখনো যদিও হাওয়ায় শীতের টান রয়ে গেছে। সেদিন টোলের ছেলেরা চলে যেতে হাত পা ধুয়ে খেতে বসলেন কালীগতি। স্নান, পূজা তো সেই সকালেই সারা হয়ে যায়।তাঁরা নৈয়ায়িক, তাঁদের বংশে মূর্তিপূজার বিধান নেই। স্ত্রী তবু লক্ষ্মীর পট পেতেছেন, সকালে সেখানে জল বাতাসা দিতে হয় আজকাল।   রান্নাঘরের দাওয়ায় সুতোর কাজ করা আসন পাতা। ঝকঝকে কাঁসার থালায় চূড়া করে সাজানো ধোঁয়া ওঠা ভাত, নিম  বেগুন, বড়ি দিয়ে লাউ আর মৌরলা মাছের ঝোল। চমৎকার রান্না।রাঁধনির খুব ঝালের হাত, বলে বলে কম করা হয়েছে। আবার শেষ পাতে এক বাটি গরম দুধ, তাতে নতুন গুড়ের পাটালি। 
এই অঞ্চলে নলেন গুড়ের পাটালির খুব নাম। এত অপূর্ব রান্না, তার ওপর পাটালি গুড়, তবু তাঁর মুখে সব বিস্বাদ লাগছে কেন? উঠোনে এক কোণে একঘটি জল রাখা। আঁচাতে গিয়ে গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। এত শীত করছে কেন তাঁর? জ্বর আসছে নাকি? জ্বর এলে ভারি মুশকিল। ছাত্ররা এসে ফিরে যাবে। দর্শনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলেন।কালমেঘার পাতা দিয়ে বড়ি বানানো আছে। কাল ভোরে উঠে খালিপেটে  খাবেন ঠিক করেন, একটা খেলেই সেরে যাবে।
 
জয়া রোজ বিকেলে পুণ্যির সঙ্গে পাত্রপুকুরে নেয়ে বটগাছের তলায় যেমন গল্পগাছা করে, তেমনি করে বাড়ি এসে আশ্চর্য হয়ে গেল। পড়ার ঘরে পিতাঠাকুর, বড় ঘরে মা আর রান্নাঘরের পাশের কুঠুরিতে রাঁধনি জ্বরে বেহোঁশ। ছোট্ট ভাইটি কিন্তু দিব্যি এর মধ্যে হাতপা ছুঁড়ে খেলে যাচ্ছে। জয়াবতী তাড়াতাড়ি শুখনো কাপড় পরে পিতাঠাকুরের কপালে হাত দিয়ে দেখে। জয়ার স্পর্শ পেয়ে কালীগতি অস্ফুট স্বরে বলেন ‘মা জয়া, এ খুব খারাপ রকমের জ্বর, এর কথা ওই পুথিটিতে পড়েছি, যদি কোনভাবে আমার বন্ধু দীননাথের কাছে পুথিটি পাঠাতে পারতাম, তবে ঔষধ বানিয়ে দিত সে।’
তারপর পিতাঠাকুরের স্বর জড়িয়ে আসে।কালীগতি প্রাথমিক কিছু কিছু ঔষধ নিজে নিজেই তৈয়ারি করে নিতে পারেন, সেসব তিনি নিশ্চয় নিজে খেয়েছেন, মা আর রাঁধনিকেও খাইয়েছেন। তাতে যে কিছু উপকার হয়নি, সে তো দেখাই যাচ্ছে। এই গ্রামে বৈদ্য বলতে রামতারণ গুপ্ত। তিনি অতি বৃদ্ধ, তার ওপর নিজেই অসুস্থ।তাহলে কী হবে? পিতাঠাকুরের বন্ধু দীননাথ সেন মশাই থাকেন তিনটি গ্রাম পেরিয়ে সোনাটিকুরি। সে গ্রামে পৌঁছে পুথি দিয়ে তার থেকে ঔষধ তৈরি করে আবার নিয়ে আসা- সে তো এক থেকে দুদিনের ধাক্কা। যদি  ঘোড়া পাওয়া যেত, তাও কথা ছিল।  এ গ্রামে ঘোড়া কার আছে? জমিদার মশাইদের একটা বেতো ঘোড়া কবেই মরে গেছে। তাহলে উপায়? এসব কথা মোটেই গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছিল না জয়া। সে উঠোনে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁখ বাজাল, ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল, একটি পাশবালিশে মায়ের একটা পরা শাড়ি জড়িয়ে নিল, তারপর ছোট ঘরে নিজের বিছানায় সেই বালিশটি রেখে ভাইকে এনে শোয়াল। রোগীর পাশে ছোট শিশুদের রাখতে হয় নাকি? বালিশে মায়ের গন্ধ পেয়ে দুর্গাগতি তাই জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
এরপর সে সেই ভিষক পুঁথিটি বাবার ঘর থেকে চুপিসারে নিজের ঘরে নিয়ে প্রদীপের আলোর সামনে বসে খুলল। এতক্ষণ সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কাজ করছিল, এখন তার চোখ ফেটে জল এল। পিতাঠাকুর তাকে পড়াশোনা না শেখালেও, সে পুণ্যির কাছে দিব্যি বাংলা পড়তে লিখতে শিখে গেছে। কিন্তু এ পুঁথিটি যে আগাগোড়া সংস্কৃতে লেখা, যার একবর্ণ সে জানে না।মাঝে মাঝে কিছু গাছ গাছালির চিত্র করা, এর কিছু তার চেনা, জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে এমন গাছ লতা সে দেখেছে। কিন্তু কোন রোগে কোন গাছের পাতা বা শিকড় লাগবে- এসব তো সে না পড়ে বুঝতেই পারবে না। তাহলে কি তার চোখের সামনে... কথাটা মনে হওয়া মাত্রই সে পুঁথিটা আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে পুণ্যিদের বাড়ি ছুটল। পুণ্যি বিধবা হয়ে ফিরে আসার পরে  তার কাকার কাছে সংস্কৃত শিখেছে মন দিয়ে, সে নিশ্চয় কিছু উপায় বার করতে পারবে। ( ক্রমশ)


বাণী বন্দনায় আমার বিদ্যালয় 
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

আমাদের ছেলেবেলায় শীত শেষ হয়ে আসলেই মনে জেগে উঠতো একটা অদ্ভুত আনন্দ৷ মনে হত, পুজো আসছে৷ সরস্বতী পুজো৷ তোমরা হয়ত ভাবছো এতে আর আনন্দর কী আছে! দুর্গা পুজোর মতো আনন্দ কি আর সরস্বতী পুজোতে হয়!
তা হলে তোমরা কিন্তু ডাঁহা ফেল৷ আসলে আমার ছোটবেলাটা আর বড়বেলার বেশিটাই কেটেছে বর্ধমানের কালনা মহকুমা শহরে৷ আর সেখানে দুগ্গাপুজোর থেকে সরস্বতী পুজোর জাঁক অনেক বেশি৷ বহু বছর ধরে মা মহিষমর্দ্দিনী আর সরস্বতী এই দুটি পুজোর দরুণ কালনার খ্যাতি৷ মহিষমর্দ্দিনীর গল্প পরে কখনও শোনাবো৷ আপাতত শীত আর না শীত হাওয়া গায়ে মেখে আমার শহরের সরস্বতী পুজোর কথা কিছু শোনাই তোমাদের৷
সরস্বতী পুজোর আমেজ আসতে শুরু করতো যখন পাড়ার আশেপাশে বাঁশ পোতা শুরু হত৷ বলতে গেলে ডিসেম্বরের ছুটি কাটলেই ক্লাবের দাদাদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত৷ আর ছোটদের মধ্যে তার ঢেউ আসতো ধীরে ধীরে৷ 
সরস্বতী পুজো আর স্কুল — না ছেঁড়া সম্পর্কে জোড়া৷ আমাদের স্কুলে পুজোর কাজ শুরু হতো চাঁদার টাকা থেকে কিছু অর্থ সারদা মঠে মানি অর্ডার করে দিয়ে৷ সারদার পুজোতে আরেক সারদাকেও অঞ্জলি দান যেন৷ আসলে এই রীতি যে বড়দি শুরু করেছিলেন তিনি আজীবন নিজেকে রেখেছিলেন ঠাকুরের পদপ্রান্তে৷ আজও সে প্রথা চলে আসছে৷ আমরা ছাত্রীরা অবশ্য এ কথা জানবো কেমন করে! আমি এই রীতির কথা জেনে ছিলাম যখন আমি এই স্কুলেই এলাম শিক্ষিকা হয়ে৷ পেলাম পুজোর অনেক দায়িত্ব৷ তার মধ্যে একটা গূরু দায়িত্ব ছিল কার্ডের বয়ান তৈরি, যেটা ছন্দবদ্ধ করে লিখতেন আমার এক প্রণম্য দিদিমণি৷ আমাকে বইতে হয়েছে সেই ধারা৷
আমরা পুজোর গন্ধ পেতাম যখন পুজোর ঘরের পার্টিশান খোলা হতো, আসলে দুটো তিনটে ক্লাসরুমে ভাগ করা থাকতো পুজোর বিরাট ঘরটা৷ বেঞ্চগুলো ভিড় করতো পুজোর ঘরের পেছনে, স্কুলের পাঁচিলের গায়ে৷ আমরা যে যে ক্লাসেই পড়ি না কেন, আর মন বসতো না পড়ায়৷ নাইন আর ইলেভেনের মেয়েদের নিয়ে প্রেয়ার গ্রাউন্ডে দিদিমণিদের সভা বসতো৷ পুজোর কাজ ভাগ হতো, খাবার মেনু ঠিক হতো৷ সকলে নিজের নিজের ক্লাসরুম পরিস্কার করতাম৷ অবাক হয়ে ভাবছো, এ আবার কেমন কথা! স্কুলে কি সুইপার ছিল না! 
হ্যাঁ বন্ধুগণ, ছিল৷ কিন্তু তাও আমাদের রোজ রোল নং অনুযায়ী টিফিনের পর যেমন ঘর ঝাঁটাতে হত তেমনি পুজোর আগে ঝুল ঝেড়ে, মুছে ঝকঝকে করতে হতো অত বড় স্কুলবাড়ি৷ আমাদের কিন্তু খুব আনন্দ হতো৷ 
এরপর ছিল আল্পনা দেবার পালা৷ যাদের আঁকার হাত ভালো তাদের দিদিমণিরা ডেকে নিতেন, আল্পনার নক্সা দিতেন৷ আর কয়েকদিন ধরে চলতো ঘরে বারান্দায় সুবিশাল আল্পনার অপূর্ব কারুকাজ৷ শান্তিনিকেতনী ঘরানার সে সব আল্পনার ছবি কেই বা সে যুগে তুলেছে বলো! তবু কিছু কিছু আজও আছে স্কুলের হলদে অ্যালবামে৷
পুজোর আগে আমাদের স্কুলে নেমত্তন্নর কার্ড ছাপানো হতো৷ পদ্যে লেখা সে সব কার্ড বিশিষ্ট মানুষদের ডাকে বা হাতে পৌঁছে দেওয়া হতো৷ পুজোর দু তিন দিন আগে থেকে সেই কার্ড নিয়ে নেমত্তন্ন করতে দিদিমণিরা কাদের পাঠাবেন, কারা হবে সৌভাগ্যবান, তার অপেক্ষার অন্য আনন্দ ছিল৷ কারণ অনেক বাড়িতে রীতিমত টিফিন টিফিনও জুটতো৷
তারপর পুজোর আগের দিন ঠাকুর আনা, পুজোর দিন জোগাড়, ভোগ বিতরণ, সন্ধ্যা আরতি, পরের দিন দধিকর্মা, ভাসান সব কিছুর দায়িত্ব ভাগ করা থাকত দিদিমণিদের সাথে মেয়েদেরও৷
পুজোর দিন বাইরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বড় বড় প্রতিমার সামনে চলছে মাইক, নাচ গান৷ কিন্তু আমাদের হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা নিষ্ঠা ভরে স্কুলের পোশাকে আসছে স্কুলের কাজে, এ দৃশ্য বিরল ছিল না৷
দিন পাল্টালো৷ আধুনিতার ছোঁয়াতে মেয়েরা একটু অন্য রকম হল বই কি! তারা পুজোর আগের দিন হলুদ শাড়ি, আর পুজোর দিন দারুণ দারুণ পোশাকে আসতে চায়৷ আসুক গে৷ কিন্তু আসল কথা পুজোর ট্র্যাডিশন৷ তা বজায় থাকল অনন্য আল্পনায়, দেওয়াল জোড়া মেয়েদের হাতের কাজে আর নানা অলংকরণে৷
আমরা মানে আমাদের সমসাময়িক নতুন শিক্ষিকারা আবার একটু অন্য রকম ভাবলাম পুজো নিয়ে৷ এই স্কুলেই পড়তাম বলে একটা নস্টালজিয়ার ঘোর নিয়ে যেমন পুরোনো সব ভালো লাগতো তেমন বাইরের পুজোর থিম মন টানলো৷ তাই অলংকরণ বা মন্ডপ সজ্জার সময় এক একটা থিম আমরা মেয়েদের বেছে দিতাম৷ যেমন একবার হল 'শাড়ি'৷ মেয়েরা ভারতীয় নানা ধরণের শাড়ির পরিধান রীতির ছবি আঁকল, শাড়ি নিয়ে নানা তথ্য লিখে সাজালো৷ এই সব আর কি! আর চালু করলাম সরস্বতী পুজোর লেখা আঁকা নিয়ে দেওয়াল পত্রিকা 'হাতে কলম'৷ 
আমাদের পুজোর ঘরের দেওয়াল জুড়ে নানা মনীষীর ছবির আছে৷ ছবির তলায় তলায় সুন্দর হস্তাক্ষরে তাঁদের বাণী লিখে দেওয়ার প্রথা বহু বছর ধরে আজও চলে আসছে৷ দিদিমণিদের কাজ বাণীর জোগান দেওয়া, মেয়েরা লিখতে থাকে খুশিতে৷
আর যে কথাটি না বললে অপূর্ণ থাকে আমার স্কুলের পুজো তা হল আমাদের ছাত্রাবস্হায় মহা সমারোহে প্রতিমা বিসর্জন৷
দধিকর্মা খেয়ে বাড়ি ফিরে আমরা আবার দুপুর গড়াতেই স্কুলে আসতাম৷ বিজোড় সংখ্যার মেয়েরা লাল পাড় সাদা শাড়ির আঁচলে আঁচল বেঁধে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর বরণ করতাম দিদিমণিদের তত্বাবধানে৷ বড় কোনো দিদিমণি কনকাঞ্জলি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালে প্রতিমাকে লরিতে তোলা হতো৷ আমরা ছাত্রীরা টুল বেয়ে কষ্টে সৃষ্টে লরি চেপে সারি দিয়ে বসে পড়তাম৷ লরির সামনে টাঙানো থাকতো স্কুলের ব্যানার৷ শহর প্রদক্ষিণ করে গঙ্গার দিকে যেতাম আমরা৷ পর পর গাইতাম সব রবি ঠাকুরের প্রার্থনা সঙ্গীত৷ এই যাত্রা দেখার জন্য শহরের বাসিন্দারা ভিড় করত ছাতে, বারান্দায়৷ আমাদের গানে চাপা পড়ে যেত ক্লাবের মাইকের শব্দ৷ আর মাঝে মাঝে সমস্বরে সরস্বতীর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে আবার আসার প্রার্থনা জানাতাম৷
আজকাল শহরের থিমের পুজোর জাঁক জমকের ঠেলায় ভাসানের দিন ছাত্রীদের দেখা মেলা ভার৷ কারণ কালনার পুজো একদিনে দেখা সম্ভব নয়৷ বাড়ি বাড়ি আত্মীয় সমাগমও হয় ভালোই৷ এ তো জোর করার বিষয় নয়, তাই স্কুলের পুজোর আর সব জমক বজায় থাকলেও ভাসান আজ ম্লান৷
বিসর্জনের পর, মনে পরে, আমরা শূণ্য বেদীর সামনে এসে বসেছি আবার৷ বড়দি ছেটাচ্ছেন ঘটে ভরে আনা গঙ্গাজল৷ আমরা নত শির৷ তারপর মিষ্টিমুখ শেষে বাড়ি৷  মোবাইলহীন সে যুগে বাবা মায়েরা ভরসা করে শীতের সন্ধ্যা ঘনানোর ভয় না করে ছেড়ে দিত মেয়েদের শুধু স্কুলের কাজকে গুরুত্ব দিতে হয় বলে৷ আজ ক'জন অভিভাবক এমন উৎসাহ দেন সন্তানকে স্কুলের অঙ্গ হয়ে ওঠার!
আমার স্কুল ছেড়ে নতুন স্কুলে কাজে যোগদান করেছি। কিন্তু আজও মনে হয়, সরস্বতী পুজো আমাকে শুধু অপার আনন্দই দেয় নি, শিখিয়েছে দায়িত্ববোধ, শিখিয়েছে নতুন কিছু ভাবতে৷ আর এই সব কাজ করতে করতে বন্ধুদের পার করে এসে ছাত্রীদের পেয়েছি বন্ধুর মতো৷ সরস্বতী পুজো তাই তো শুধু ধর্মাচার নয়, এক মিলন-কবিতাও বটে৷


আকাশপ্রদীপ জ্বলে

সংগ্রামী লাহিড়ী

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে আজকাল রিকির বেশ দেরি হচ্ছে। পড়াশোনার পর তার কয়্যারের রিহার্সাল থাকে। হাইস্কুল কয়্যার। ক্যালিফোর্নিয়ার গ্লেনফিল্ডের এই হাইস্কুলের কয়্যার বেশ নামকরা। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন কম্পোজারের গান গায়। স্কুলের প্রোগ্র্যাম হয়, বাইরেও গাইবার আমন্ত্রণ পায়। সুনাম আছে এদের। 
রিকির এবছর সদ্য হাইস্কুল। এদেশের নিয়মমত এইটথ গ্রেড পর্যন্ত মিডল স্কুলে গেছে। নতুন হাইস্কুলে পা দিয়েই কয়্যারে যোগ দিয়েছে। গানপাগল সে। গলাও ভালো। ছেলেদের মধ্যে যথেষ্ট উঁচু স্কেলে গায়। তাই স্কুলের কয়্যারে সে 'টেনর'। মা বলে, "তোর দিম্মার জিন পেয়েছিস।" 
সত্যি, কী যে সুন্দর গায় রিকির দিম্মা, এই বয়েসেও যেন বাঁশির মত গলা! অথচ মাকে দেখ, গানবাজনার ধার দিয়েও গেল না। দিম্মার মনে একটু একটু দুঃখ, বোঝে রিকি। তাই দিম্মার সঙ্গে তার একটা আলাদা প্রাণের টান। সেখানে আর কেউ নেই। মা-ও নয়। সুরের বাঁধনে কলকাতা আর ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাণ বাঁধা পড়েছে, ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু  দিম্মা আর রিকি। 
অনেকদিন পর দিম্মা এসেছে কলকাতা থেকে, তাদের সঙ্গে থাকতে। মাঝখানে তো মহামারীর দাপটে যাতায়াত বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। তাই রিকি বড্ড খুশি।  
ফেব্রুয়ারি মাস পড়ে গেছে, ক্লাস চলছে পুরোদমে। আজ স্কুল থেকে ফিরে বসেছে ডাইনিং টেবিলে। সামনে দিম্মা। 
"জানো দিম্মা, ভাবছি কয়্যার ছেড়ে দেব।" বলব না বলব না করেও বলেই ফেলে রিকি। 
"কেন রে? কী হল?" 
"হাইস্কুলের কয়্যার যে এত শক্ত হবে কে জানত? জানো, আমাদের সব গানগুলো হয় ল্যাটিন, নয় ইতালিয়ান ভাষায় লেখা।"
"আর তুই দুটো ভাষার একটাও জানিস না, তাই তো?" 
"সে তো বটেই!" রিকি ঘাড় ঝাঁকায়। "উচ্চারণই ঠিকমত হচ্ছে না। তারপর ডক্টর বিশপ যে কী কড়া কন্ডাকটর, সে আর কী বলি! একই গান রিহার্সাল করিয়েই যাচ্ছেন আর করিয়েই যাচ্ছেন। কিছুতেই আর পছন্দ হয় না! সব্বাই ক্লান্ত। ধুৎ, এ আর পারা যাচ্ছে না!"
"আচ্ছা, ডক্টর বিশপের কথায় না হয় পরে আসব, আগে উচ্চারণের ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলি?"
"তুমি? উচ্চারণ নিয়ে বলবে? তুমি না জানো ল্যাটিন, না জানো..."
"আমি তোকে একটা গল্প শোনাব,” দিম্মা কথা শেষ করতে দেয় না, “গল্প হলেও সত্যি। তারপর দেখ তো, তুই নিজের রাস্তা নিজেই খুঁজে পাস কিনা?" 
"গল্প? বল, বল দিম্মা!" রিকি গুছিয়ে বসেছে।      
"এক সাধারণ মেয়ের গল্প। গানের বাড়ির মেয়ে। বাবা শাস্ত্রীয় সংগীতের শিল্পী, থিয়েটার করেন। মেয়েটাও খুব ছোট্ট থেকেই বাবার থিয়েটারে গান গায়, অভিনয় করে। বাবার কাছেই গান শেখে। তেরো বছর যখন বয়স, বাবা চলে গেলেন পরপারে। চারটে ছোট ছোট ভাইবোন আর মা আছে বাড়িতে। তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে তো?  তেরো বছুরে মেয়ের কাঁধে পুরো সংসারের দায়িত্ব।"
"হুম, বলে যাও, বলে যাও, চেনা চেনা মনে হয় যেন।" 
"চেনাই তো উচিত! নাহলে আর এতদিন কী শেখালাম তোকে? যাই হোক, সেই মেয়ে বম্বে শহরে রোজগারের সন্ধানে ঘোরে। সিনেমার প্লেব্যাক গান গেয়ে সামান্য রোজগার। ভাড়া বাড়িতে থাকে আর ট্রেনে চেপে যাতায়াত করে এখান থেকে ওখানে, এক স্টুডিও থেকে আরেক স্টুডিও।" দিম্মা একটু থামে। পরক্ষণেই আবার গল্পে ফেরত এসেছে। 
"সেই ট্রেনের কপার্টমেন্টেই দিলীপকুমারের সঙ্গে আলাপ। দিলীপকুমারও ট্রেনেই যাতায়াত করেন, তখনো তত বিখ্যাত নন।  সুরকার অনিল বিশ্বাস আলাপ করিয়ে দিলেন, 'মেয়েটি ভালো গায়।' দিলীপকুমার পরিচয় জিজ্ঞেস করে জানলেন, মারাঠী মেয়ে।" 
"আমি জানি, আমি জানি তিনি কে। ভারতের নাইটিঙ্গেল, লতা মঙ্গেশকর। তাই না দিম্মা?" রিকি হাততালি দিয়ে ওঠে। দিম্মার কাছে সে এঁর জীবনের কথা বেশ কয়েকবার শুনেছে। চিনতে অসুবিধে হয় না। 
"ঠিক। তবে তাঁর এই গল্পটা আগে বলিনি।" দিম্মা হাসে।
"বল, বল!" রিকি দুগুণ উৎসাহে চেয়ার এগিয়ে নিয়ে বসে। 
"সেই দিলীপকুমার প্রথম দেখায় লতার পরিচয় জেনে বলে বসলেন, 'মারাঠি মেয়ে? গান গাইলে তো ডাল-ভাতের গন্ধ বেরোবে! মারাঠিদের জিভে উর্দু উচ্চারণ আসবেই না!" 
"বললেন এমন কথা? দিম্মা?" 
"বললেন তো। লতার বুকে গিয়ে শেলের মত বিঁধল কথাগুলো। ভেবে দেখল, সত্যিই তো, তার উর্দু উচ্চারণ ভালো নয়! মুখে কিচ্ছুটি বলল না, কিন্তু মেয়ের জিদ সাংঘাতিক। মনে মনে ঠিক করে নিল, উর্দু শিখবে। বুঝে দেখ একবার, যে মেয়ে স্কুলে যায়নি, যেটুকু পড়াশোনা বাড়িতেই, পরিচারিকা তাকে অক্ষর চিনিয়েছে, পড়তে আর লিখতে শিখিয়েছে, সেই মেয়ের সংকল্প, উর্দু ভাষা শিখে নিজের উচ্চারণ শুধরে নেবে।" 
"আমি একটু একটু বুঝতে পারছি দিম্মা, কেন তুমি আমায় এ গল্প শোনাচ্ছ। তারপর কী হল?" রিকি আস্তে জিজ্ঞেস করে।
"ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। একে ওকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে গেল মেহবুব নামের এক মৌলানার কাছে। ভালো উর্দু জানেন। তাঁর কাছেই যত্ন করে উর্দু শিখল, হিন্দি শিখল। নিষ্ঠায় কোনো ফাঁকি নেই। পরে লতা নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো উর্দু খুব ভালো বলতে পারি না, কিন্তু যখন গান গাই, প্রতিটি কথা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করার চেষ্টা করি।’ একজন গাইয়ের কাছে ঐটাই আসল।" দিম্মা থেমেছে। 
"তাহলে তুমি বলছ, ইতালিয়ান আর ল্যাটিন ভাষাদুটো আমার শেখা উচিত, তাই তো?" রিকি আলো দেখতে পাচ্ছে। 
"নিশ্চয়ই! সেইসঙ্গে বারবার করে গানের কথাগুলো বলে বলে অভ্যাস করা। যেমনটি তিনি করেন, নিখুঁত উচ্চারণের জন্যে।"      
"খুব নিষ্ঠা তাঁর, তাই না দিম্মা?" রিকির সাধ হচ্ছে আরো শোনে তাঁর কথা। নাইটিঙ্গেল কেমন করে কথার সঙ্গে সুরের মালা গাঁথেন। 
"অভ্যাস, অভ্যাস আর অভ্যাস। তাঁর গলা হয়ত ঈশ্বরের দান। ঠিকঠাক তালিমও পেয়েছেন। কিন্তু উচ্চারণ? শব্দের ঠিকঠাক জায়গায় জোর দেওয়া? যাকে আমরা বলি অ্যাকসেন্ট - সেটা পুরোটাই তাঁর নিজের কৃতিত্ব। যে দিলীপকুমার মারাঠিদের উর্দু উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করলেন, তিনিই পরে লতা মঙ্গেশকরের গজল গানে উর্দু উচ্চারণ শুনে মুগ্ধ। বলেছিলেন, "My ears tingled in shame।" ভাবা যায়? কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেলেন নিজেকে?  শুধু উর্দুই বা কেন, কতগুলো ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন, একবার ভেবে দেখ দেখি?" 
"দাঁড়াও, দাঁড়াও, এই স্ট্যাটিসটিক্সটা আমি জানি। লতা মঙ্গেশকর মোট চোদ্দটি ভাষায় গান গেয়েছেন।" রিকি খুব উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে।
"সত্যিকারের সংখ্যাটা কেউ জানে না, আরও বেশিও হতে পারে।" দিম্মা হাসে। " লতা নিজেই বলেছেন এক ইন্টারভিউতে। প্রতিটি ভাষায় গান গাইবার আগে যত্ন করে তার উচ্চারণ শিখে নিতেন, অ্যাকসেন্ট রপ্ত করতেন। বাংলা গানই তো আছে প্রায় দুশো। প্রত্যেক পুজোয় এইচ এম ভি থেকে তাঁর গানের রেকর্ড বেরোত, সলিল চৌধুরীর সুরে, হেমন্ত মুখার্জির সুরে। এইচ এম ভির পুজোর গানের বই শারদ অর্ঘ্যে থাকত তাঁর ছবি, গানের কথা। সেই বইটি হাতে নিয়ে আমরা চাতকপাখির মত অপেক্ষায় থাকতাম, কবে রেডিওতে বাজবে সেসব গান। শুনে শুনে তুলে নিতে হবে। মাস্টারপিস একেকটা। কই, কোনোদিন তো মনেই হয়নি যে লতা মঙ্গেশকর বাঙালি নন? যেন পাশের বাড়ির মেয়েটি!" 
"সত্যিই তো দিম্মা? 'ও মোর ময়না গো', 'সাত ভাই চম্পা', 'পা মা গা রে সা' - ঠিক যেন তোমার-আমার মতই বাংলা উচ্চারণ, তাই না? আর আমি কিনা দুটো ল্যাঙ্গুয়েজে গাইতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছি?" 
"এবার পারবি। শুনলি তো, অভ্যাসে কী না হয়?" 
"আচ্ছা দিম্মা, ডক্টর বিশপকে নিয়ে তুমি যেন কী বলবে বলছিলে?" 
"ভালো মনে করিয়েছিস। ডক্টর বিশপ তোদের কয়্যারের কনডাক্টর। খুব কড়া। রিহার্সাল করিয়েই যাচ্ছেন, করিয়েই যাচ্ছেন, কিন্তু সন্তুষ্ট নন। এই তো অভিযোগ?" 
"হ্যাঁ গো..." রিকি ঠোঁট ফোলায়।               
"আবার তাহলে লতা মঙ্গেশকরেই ফেরত যাই। তাঁর নিয়ম হল, যে কোনো গান গাইবার আগে অন্তত দু'সপ্তাহ রিহার্সাল। স্টুডিওতে গিয়ে বার বার রেকর্ডিং। ক্লান্তি নেই। যতক্ষণ না মনোমত হচ্ছে গান, নিখুঁত হচ্ছে পরিবেশনা, থামবেন না।" 
"তাঁর মত এতবড় শিল্পী বারবার একই গান গেয়ে রেকর্ডিং করেন?" রিকির যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। 
"কত গল্প শুনতে চাস? ‘বন্দেমাতরম’ গানের কথা শোনাই তোকে। শশধর মুখার্জির ফিল্মিস্তান স্টুডিও থেকে ‘আনন্দমঠ‍’‍ ছবি হচ্ছে। হেমন্ত মুখার্জির অনুরোধে প্লেব্যাক গাইতে এলেন লতা। পারিশ্রমিকও নেবেন না। তাঁর 'হেমন্তদা' ডেকেছেন, ব্যাস, এর ওপর আর কোনো কথা নেই। সেই ছবিতেই দুজনে গাইবেন 'বন্দেমাতরম' গান।"
"ওয়েট আ মিনিট দিম্মা, আনন্দমঠ বইতেই তো বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম গান লিখলেন, তাই না?" রিকির প্রশ্ন।
"হ্যাঁ, বইটা পড়বি তুই। আমি আনিয়ে দেব। হয়তো একটু শক্ত লাগতে পারে, তাও পড়বি।"
"নিশ্চয়ই পড়ব। তো সেই গানের কী হল?" রিকি হাল ধরতে চেষ্টা করে। দিম্মা অন্য কথায় চলে যাচ্ছে, পছন্দ নয় তার!  
"বেশ কিছুদিন প্র্যাক্টিস করলেন লতা। তারপর স্টুডিওতে এলেন। সেদিন গুনে গুনে একুশ বার রেকর্ডিং হয়েছিল। তারপর পাওয়া গেল সেই বন্দেমাতরম গান, যা আমরা আজ শুনে মুগ্ধ হই। সুপারহিট গান। ভারতবাসী আবেগে ভেসে গিয়েছিল।" 
"বল কী দিম্মা? একুশ বার রেকর্ডিং?" রিকি অবাক। 
"আরেকটা গানের কথা শোন, আরো অবাক হবি। পরিচালক রাজ কাপুরের ছবি ‘আওয়ারা’, তাতে লতা মঙ্গেশকর প্লেব্যাক করবেন। মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রাজ কাপুর নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান, বলব তোকে কোনো একদিন তাঁর কথা।" 
"তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না? ভারতের চার্লি চ্যাপলিন, সারা দুনিয়া জানে তাঁর নাম।" রিকি হাসছে। 
"ঠিক!" দিম্মাও খুশি। "লেজেন্ড হয়ে গেছেন। তাঁরই ছবি ‘আওয়ারা’তে সুর দিয়েছেন শঙ্কর-জয়কিষেণ জুটি। ভৈরবী রাগে বাঁধা গান 'ঘর আয়া মেরা পরদেসি' গাইবেন লতা মঙ্গেশকর আর মান্না দে। সঙ্গে দেড়শো জন মিউজিশিয়ান। পঞ্চাশজন সহশিল্পী কোরাসে গলা মেলাবে।"
"বাব্বা, এ তো আমাদের কয়্যারের থেকেও বড় হয়ে গেল গো দিম্মা!" রিকি অবাক।  
"সে তো বটেই, বিরাট দল! স্টুডিওতে পৌঁছলেন লতা। রেকর্ডিং শুরু হল। রাজ কাপুর নিজে গান ভালোই বোঝেন। এ গানের সুর, রিদম, মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট কিছুতেই তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। বার বার রেকর্ডিং হচ্ছে,  কিন্তু যা চাইছেন, তা পাচ্ছেন না। খুব খুঁতখুঁতে। সম্ভবত ডক্টর বিশপের চেয়েও বেশি!" দিম্মা মুচকি হাসে। 
"ডক্টর বিশপও তো এমন খুঁতখুঁতে লোক!"  রিকি হাঁ হয়ে গেছে।    
"বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যে নামল। দেড়শো মিউজিশিয়ান,পঞ্চাশ সহশিল্পী নিয়ে লতা ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেয়ে যাচ্ছেন।" 
"দাঁড়িয়ে কেন গো দিম্মা?" 
"গান গাইবার সময় কখনোই বসেন না যে! জুতো খুলে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান করেন। গান তাঁর কাছে পুজোর সমান। সারাদিন গেল, সন্ধে নামল, সন্ধে থেকে রাত। অবিশ্রান্ত কাজ চলছে। পারফেকশন চাই, পারফেকশন! রাজ সাহেব রেগেমেগে বললেন, 'I don't want a popatiya song!’ তারপর গানটাকে আগাগোড়া বদলে দিলেন। ভৈরবী রাগে ছোট্ট একটু আলাপও জুড়ে দিলেন। রাত তিনটের সময় যে রেকর্ডিংটি হল, শুনে সন্তুষ্ট হলেন। বললেন, 'চল, এবার তাহলে কিছু খাওয়া যাক!' সবার জন্যে পেটভরা খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।" 
"বল কী দিম্মা? সকাল ন'টা থেকে রাত তিনটে? সত্যি?" 
"লতা মঙ্গেশকর নিজেই লিখে গেছেন এ ঘটনা। রাজ কাপুরের স্মরণে তাঁর ছেলেমেয়েরা একটা বই বার করেছিলেন, ‘Raj Kapoor: The One And Only Showman’. সেই বইতেই লতা লিখেছেন। এবার বল তো, ডক্টর বিশপের নামে আর কমপ্লেন করবি?"
"গানটা আমায় শুনিও তো দিম্মা।" রিকি বলে। "এমন পরিশ্রমে তৈরী হয় যে গান, তা নিশ্চয়ই অসাধারণ!" 
"ভারতবাসীর মন জিতে নিয়েছিল এ গান। ভৈরবীর মনকাড়া সুর, তার সঙ্গে তালফেরতা। কতরকম তালবাদ্য বাজে গানের মাঝে। ছন্দ, লয় বদলে বদলে যায়। লগ্গি আসে দ্রুততালে। এ গান গাওয়া সহজ নয়। ধৈর্য আর নিষ্ঠা কোন স্তরে পৌঁছলে তবে এমন একটা রেকর্ডিং করা যায়?" 
"না গো দিম্মা,আমার আর দুঃখ নেই।” রিকি বলে, “কয়্যার ছাড়ার কথা আর কক্ষনো বলব না।"
"সোনা ছেলে আমার।" দিম্মা আদর করে চুলটা ঘেঁটে দেয়। 
দুজনেই উঠে পড়ে। সামনের শনিবার সরস্বতী পুজো। জোগাড়যন্ত্র করতে হবে। এবার সরস্বতী পুজো উইকএন্ডে। তার ওপর দিম্মা আছে এখানে। রিকির আনন্দের শেষ নেই। আগের রাত থেকে নাড়ু পাকানো হবে। পুজোর দিন খিচুড়ি-বাঁধাকপি। পরের দিন বাড়িতে তৈরী দই দিয়ে দিম্মা দধিকর্মা মাখবে। ভাবতেই জিভে জল! 
সরস্বতী পুজো আসে। ভক্তিভরে দোয়াত-কলম সাজিয়ে দেবীর আরাধনা করে রিকি। সে-ই পুজোর পুরোহিত। দিম্মা সারাক্ষণ পাশে বসে দেখিয়ে দিল। বাবা-মা হলুদ পোশাক পরে অঞ্জলি দিল। সব মিটতে মিটতে রাত হয়েছে। একটু ফুরসৎ পেয়ে লিভিং রুমে বসে দিম্মা চোখ রেখেছে নিজের ফোনে। নিউজ অ্যালার্ট, ওয়েদার, এটা সেটা দেখবে। রিকি পাশটিতে। দিম্মার ঘরেই শোবে আজ, ভাবছে মনে মনে।  
হঠাৎ খেয়াল করে দিম্মা কেমন চুপচাপ। মূর্তির মত স্থির। চোখে দু’ফোঁটা জল মুক্তো হয়ে গড়িয়ে নামছে। জিজ্ঞেস করার আগেই ফোনটা বাড়িয়ে দিল। দেখছে রিকি। 
লতা মঙ্গেশকর আর নেই। অসুস্থতা, বয়েসের ভার কেড়ে নিল তাঁকে।  
"সরস্বতীর বিসর্জন হয়ে গেল? দিম্মা?" রিকির চোখেও জল। এই তো দুদিন আগেই তাঁকে নিয়ে কত গল্প হল, তাঁর জীবনের গল্প। তিনি যেন একটা লাইটহাউস, রিকিকে পথ দেখিয়ে দিলেন। আজই সব শেষ?
"কে বলল শেষ?" দিম্মার চোখে জল, কিন্তু প্রত্যয়ী গলা। "তাঁর কণ্ঠ, সুর আর গানেই তিনি রইলেন। তোর মত কোটি ছেলেমেয়ের অন্তরে রইলেন আকাশপ্রদীপ হয়ে। সেই প্রদীপটির আলোয় উদ্ভাসিত হবে চলার পথ। ভুলিস না রিকি। তাঁর নিষ্ঠা, ধৈর্য, অধ্যবসায়, পরিশ্রম হোক তোর আদর্শ।"
না, রিকি ভুলবে না। তাকেও যে 'বহুদূর দূর যেতে হবে'।


ঐ শুকনো গাছটা
শামুকা ঘোষ
অষ্টম শ্রেণী, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়


অনেক কাল পরে আজ চন্দ্র বাবু গ্ৰামের বাড়ি এসেছেন। ছোট বেলাটা তার অবশ্য এখানেই কেটেছে , কিন্তু তিনি এখন থাকেন কলকাতায় ।
   তার গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে ! আর এখন তো তার সাক্ষাৎ দর্শন হবে ভেবে খুব ভালো লাগছে ; কিন্তু শুনেছি তিনি কারোর সাথে বিশেষ মেলামেশা করেন না , সে যাই হোক তাঁর দেখা তো পাবো সেটাই অনেক ! ঐ যে অমল চন্দ্র বাবুর জন্য মনে হয় খাবার নিয়ে যাচ্ছে ; খাসা রাঁধেন কিন্তু অমলের মা, একবার খেলে আর ভোলা যায় না !
বিকেল বেলা শুনেছি চন্দ্র বাবু গ্ৰামের বোড়ো পুকুর পারে গান লিখতে যাবেন , তখন তার সঙ্গে দেখা করতে যাব । 
দুপুরের খাবার খেয়ে আর যে ঘুম আসে না, অপেক্ষাও সয় না, শুধু মনে হয় কখন বিকাল হয় আর কখন যাই ! 
ঐ যে অমল আসছে চন্দ্র বাবুর বাড়ি থেকে  ওকে  জিজ্ঞেস করি  চন্দ্র বাবু কী করছেন ।
 -অমল  কী চন্দ্র বাবুর বাড়ি থেকে আসছ ?
অমল - " হ্যা গো, বাবু তো পুকুর পাড়ে গেছেন তাই ঘর তালা দিয়া খেতে যাচ্ছি । "
আমি - "কী! চলে গেছেন পুকুর পাড়ে ?"
অমল -" হ্যা !"
তাড়াতাড়ি নিচে নেমে পুকুরের দিকে দৌড়ালাম , পৌঁছে দেখি চন্দ্র বাবু এক শুকনো গাছে হেলান দিয়ে বসে আছেন  ।
মনে প্রশ্ন জাগল এত গুলো ছায়া ভরা গাছ থাকতে ঐ শুকনো গাছে হেলান দিয়ে কেন বসে আছেন ? 
  কিন্তু কিছু না জিজ্ঞেস করে পরিচয় না দিয়ে সেদিন চলে এলাম , মনে প্রশ্ন নিয়ে। এরপর আরও দুদিন গিয়ে দেখি চন্দ্র বাবু ওখানেই ঐ শুকনো গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকেন ! 
 কিন্ত আজ, জিজ্ঞেস করেই ছাড়ব এত গুলো ছায়া ভরা গাছ থাকতে ঐ শুকনো গাছটাই কেন ওনার পছন্দ ? 

গিয়ে দেখি তিনি আবার ঐ গাছেই হেলান দিয়ে বসে আছেন। 
সত্যি সত্যি ওনার কাছে গিয়ে উৎসাহের সাথে বললুম " আমি জলধর এই গ্ৰামেই থাকি , আপনার গান আমার খুব ভালো লাগে !" 
উনি কৃতজ্ঞতার সাথে বললেন - " ধন্যবাদ !"
আমি জিজ্ঞেস করলাম - " আপনার সাথে কথা বলতে পারি ?" 
চন্দ্র বাবু-" হ্যা বলুন ।" 
" আসলে আমি  আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই !" 
চন্দ্র বাবু- " করুন।"
"আমি আপনাকে অনেক দিন থেকেই দেখছি ; এখানে এত গুলো ছায়া দেওয়া গাছ আছে , ওগুলো কে ছেড়ে আপনি এই শুকনো গাছের নিচে কেন এসে বসেন ? "
চন্দ্র বাবু - " ধরে নাও কোনো অজানা আত্মীয়তার জন্য!"
বলে তিনি উঠে ওখান থেকে চলে গেলেন , কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ;
কেমন আত্মীয়তা, কীসের আত্মীয়তার কথা বলে গেলেন চন্দ্র বাবু ? 
বাড়ি এসে মনে মনে সেদিন ঠিক করলুম কাল আবার গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করব , জানি তিনি নিজের কথা কাউকে বলেন না ! কিন্তু তবুও আমি জিজ্ঞেস করব ।
পরের দিন আবার পুকুর পাড়ে গেলাম , আবার দেখি তিনি ওই গাছের নিচে বসে আছেন।
গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম -
" কেমন আত্মীয়তার কথা বলেলেন আপনি কাল? আসলে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না।"
তিনি উঠে দাঁড়ালেন আর বললেন - আজ আমার একটু কাজ আছে ! এই বলে চলে গেলেন ।
আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে কথাটা বলবেন না বলেই কাজ আছে বলে চলে গেলেন ।
সেদিন রাতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। রাত হতেই সবাই বট তলায় জড়ো হলাম আমি , যতিন , প্রদীপ , দেব ও মানিক।
 সেদিন আড্ডার বিষয় ছিলেন চন্দ্র বাবু ; 
আমাদের পাঁচ জনের সবার ছোট  যতিন বলল - "তোমরা জানো আমার ঠাকুরদা বললেন চন্দ্র বাবু নাকি ছোটবেলাতেই নিজের মা-বাবা কে হারিয়ে ছিলেন ! "
প্রদীপ ঠাট্টা করে বলল - " আর জানিস তাদের আত্মা এই বট গাছে থাকে ! " 
যতিন আমার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । যা দেখে সবাই হাসতে লাগলাম ,
আমি কিন্তু গাছটার বিষয়ে কিছু বললাম না ।
 হঠাৎ একটা লোক আমাদের ওপর টর্চ লাইট মেরে বলল - " কারা ওখানে ?" ধীরে ধীরে ওই  টর্চ এর আলোটা আমাদের দিকে এগিয়ে এলো 
"আরে এ তো চন্দ্র বাবু ! " প্রদীপ চেঁচিয়ে উঠলো, 
চন্দ্র বাবুও আমাদের কাছে এসে বললেন -" এত রাতে কী করছো তোমরা এখানে ?" 
আমি বললাম - " কিছু না এমনি গল্প করছিলাম ।" 
উনি বললেন - " আমি এখানে বসতে পারি ?"
সবাই ওনার জন্য জায়গা করে দিলাম। 
উৎসাহের সাথে প্রচুর কথা হল ;
এই যেমন - আগের গানটা চন্দ্র বাবুর খুব ভালো লাগলো! এবার কী গান গাইবেন ?
এ বছর তিনি দুর্গাপূজায় এখানে থাকবেন কী না!
বেশীক্ষণ হল না ১০ টার আগেই সবাই বাড়ি চলে গেল।  চন্দ্র বাবুও চলে গেলেন। আমি ওনার সাথে ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গেলাম পথে আবার আমি ওনাকে ওই গাছ আর তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম ; 
তিনি হেসে বললেন-" তুমি ছাড়বেনা‌ দেখছি ! কাল আমি আবার কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি ।" 
আমি যা করেই হোক ঐ গাছ টার বিষয়ে জানতে বার বার জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু তিনি কিছু না বলে চলে গেলেন বাড়ির ভিতরে ! 
পর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলাম উনি সত্যি চলে যাচ্ছেন। 
দৌড়ে ওনার বাড়ির সামনে এসে দেখি তিনি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন
এমন সময় আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে একটা কাগজ অমল কে দিয়ে গাড়িতে বসে পড়লেন ও চলে গেলেন । আমার চোখে জল এসে গেল , ওখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম তখনই অমল পিছন থেকে ডাকল - " জলধর,  চন্দ্র বাবু আপনার জন্য এই ছিঠি টা দিতে বললেন । "  আর আমার হাতে চিঠিটা দিয়ে চলে গেল
 আশ্চর্য চোখে চিঠিটা খুলে দেখলাম , লেখা ছিল -  

জলধর
আজ পর্যন্ত আমায় একটা প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করে কেউ এত বিরক্ত করেনি ! ঠাট্টা করছি না,
আসলে আজ পর্যন্ত আমি কারোর সাথে ভালো ভাবে কথা বলিনি , কাউকে নিজের মনের কথাও বলিনা , ঐ গাছ টার বিষয়ে কোনো দিন কেউ কিছু জানতে চায়নি ; তুমিই প্রথম।  ঐ গাছ টার বিষয়ে আমি তোমায় প্রথম বলছি -  আসলে ওই গাছটা লাগিয়েছিলেন আমার মা বাবা যখন আমি জন্মেছিলাম। ছোটবেলা থেকে ওই গাছটার আমি খুব ভালো বন্ধু 
বাবা মা চলে যাওয়ার পর ওই গাছ টাকেই আমি নিজের মনের সব কথা বলেছি ।
যখন মা বাবার কথা মনে পড়ত ঐ গাছটার নিচে গিয়ে বসতাম ওই গাছটার নিচে গিয়ে বসলেই মনে হয় আমি মা-বাবার কোলে বসে আছি । আজ অবশ্যই এই গাছটা শুকিয়ে গেছে , কিন্তু এখনো ও আমার বন্ধু , এখনো আমার বলা সব কথা ও শুনে, নতুন নতুন গান জাগিয়ে দিয়ে যায় আমার মনে। 
আমি এসব কথা তোমাকে জানালাম কারণ আমার হৃদয় আমাকে বলেছিল  কথাটা জানাতে। কিন্তু দয়া করে তুমি এই গাছ টাকে একটু দেখো যেন কেউ ওকে কেটে না ফেলে । 
                                   
                                      - ইতি 
                                চন্দ্রনাথ দত্ত



চিঠিটা পড়ে একটু আশ্চর্য হয়ে ছিলাম আমার আইডল স্বয়ং আমাকে চিঠি লিখেছেন নিজের মনের কথা জানিয়েছেন, এটা আমার জন্য একটা অনেক বড় পাওয়া । 
               


মা সরস্বতীকে
মলয় সরকার

সরস্বতী, সরস্বতী, আজকে নাকি শ্রী পঞ্চমী-
আজকে নাকি বিদ্যে পূজায় এই মাটিতে আসছ নামি'!
তা ভাল বেশ, দেশের লোকের খবর কিছু নিয়েছ কি?
বিদ্যে কিছু হচ্ছে নাকি, ভেতর বাহির শুধুই ফাঁকি!
পরীক্ষা পাশ হচ্ছে সবাই ছাপের জোরে, দাপের জোরে,
খোঁজ নিয়েছ, সবাই কি তার নিজের নামটি লিখতে পারে।
বছর বছর আসছ তুমি হাঁসের পিঠে নিচ্ছ পুজো,
দেখছ কি মা, চোখটি মেলে, ঋণের দায়ে সবাই কুঁজো।
যে পাশে মা, দেশের লোকের জোটে না তো পেটের ভাত-
সে পড়া আর পরীক্ষা কি? এমন পাশের নেই তো জাত।
সামনে বছর আসোই যদি, দোহাই মাগো, তোমায় বলি-
এমন পড়া, পাশ করা ছাপ, চিরতরেই যাক না চলি'।
সত্যি জ্ঞানের আলোক জ্বেলো, বুকটি দিও বীর্যে ভরে,
পেটের ভাত, ভিক্ষায় নয়, জোগাড় করুক নিজের জোরে।
স্বপ্ন দিও চোখ ভরে মা, জ্ঞানের প্রদীপ জ্বলুক মনে,
ধনী যেন হয় গো সবাই, অর্থে না হোক হৃদয় ধনে।


স্মরণীয়
( লতা মঙ্গেশকর)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

   ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন মারাঠি ও কোঙ্কনী সঙ্গীতজ্ঞ ও মঞ্চাভিনেতা। মা ছিলেন সেবন্তী(পরবর্তীতে সুধামতি হয়েছিলেন)। বড় মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল 'হেমা', পরে তাঁর বাবার একটি নাটকে 'লতিকা' চরিত্রে অভিনয় করার পরে লতা নামটি পরিচিতি লাভ করে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আশা ছিল লতার খুব কাছের, দুজনের কেউ কাউকে ছেড়ে থাকত না শৈশবে। লতা স্কুল গেলেও সঙ্গে নিয়ে যেত আশাকে। শিক্ষকরা আশাকে নিয়ে আসতে বারণ করেছিলেন বলে লতা আর স্কুলে যাননি কোনোদিন। বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে শিখেছিলেন সবকিছুই।             শৈশবে বাড়িতে কুন্দনলাল  সায়গলের গান ছাড়া অন্য কোনো গান শুনতে দিতেন না বাবা। তিনি চাইতেন মেয়ে ধ্রুপদী গান নিয়েই থাকুক। বাড়িতে বাবার কাছেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় তাঁর। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই অভিনয় করেছিলেন মঞ্চে। যখন মাত্র ১৩ বছর বয়স তখন হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে জীবনের গতিপথ বদলে যায় তাঁর। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় লতার উপর দায়িত্ব এসে পড়ে সংসারের। পারিবারিক বন্ধু, নবযুগ চিত্রপট কোম্পানির মালিক বিনায়ক দামোদর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তখন। তিনিই লতাকে অভিনয় এবং গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন। ১৯৪২ সালে মারাঠি ছবি 'কিটি হাসাল' এ গান গেয়েছিলেন কিন্তু গানটি ছবিতে রাখা হয়নি। সেই বছরেই বিনায়ক দামোদরের প্রযোজিত মারাঠি ছবি 'পহেলি মঙ্গলা গৌর' এ অভিনয়ের সুযোগ দেন। ১৯৪৫ এ বিনায়কের সংস্থা মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) চলে এলে লতাকেও সঙ্গে আনেন। ঐ বছরই লতা উস্তাদ আমানত আলি খানের কাছে হিন্দুস্তানী মার্গ সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। বিনায়কের প্রথম হিন্দি ছবিতেও ছোট ছোট চরিত্রে কাজ করেছিলেন লতা ও আশা। অভিনয় ও গান গেয়ে পরিবারের অন্নসংস্থানের কাজ করতে হত তাঁকে। দেশভাগের সময় উস্তাদ আমানত আলি পাকিস্তান চলে গেলে লতা কিছুদিন তালিম নিয়েছিলেন পণ্ডিত তুলসীদাস শর্মার কাছে। ১৯৪৮ সালে বিনায়ক দামোদর মারা গেলে দ্বিতীয়বার অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন লতা। ঐ বছরই সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দারের সুরে 'মজবুর' ছবিতে 'দিল মেরা তোড়া' গানটি বলিউডে লতাকে ভীষণ পরিচিতি দিয়েছিল। এরপর টানা সাত দশক ধরে দেশে-বিদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সম্মোহিত হয়েছে তাঁর সুরেলা কন্ঠের জাদুতে। প্রায় ৩৬টি ভাষায় তিরিশ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালনা ও প্রযোজনাও করেছেন কয়েকটি ছবির। বাংলা গানের সংখ্যা প্রায় দুশোটি। 
      এই মহান শিল্পীর খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে ঝুলি ভর্তি হয়েছে দেশ বিদেশের নানা পুরস্কার ও সম্মানে। ১৯৬৯ এ পেয়েছেন পদ্মভূষণ, ১৯৮৯ এ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ১৯৯৯ এ পদ্মবিভূষণ। ২০০১সালে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'ভারতরত্ন' পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৭ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'দেশিকোত্তম' সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে। লতা মঙ্গেশকর ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'লিজিয়ঁ দ্য নর' পেয়েছিলেন ২০০৭ সালে। মহারাষ্ট্রের 'মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার' পেয়েছিলেন ১৯৯৭সালে। এছাড়াও সংগীতের জন্য তিনবার জাতীয় পুরস্কার, ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার সহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন আজীবন। ১৯৮৭ সালে আমেরিকার সাম্মানিক নাগরিকত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৯০সালে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট দেওয়া হয় এই মহান সঙ্গীত শিল্পীকে। 
      গত ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২২, বয়সজনিত অসুস্থতার সঙ্গে 'কোভিড' কেড়ে নিয়েছে তাঁকে। ভারত সরকার দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে তাঁর মৃত্যুতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর মৃত্যুর পরদিন অর্ধদিবস ছুটি ও ১৫ দিন যাবৎ  তাঁর গাওয়া গান বাজানোর ঘোষণা করে।



ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই ( কেরালা)
পর্ব ৬
কলমে - বাসবদত্তা কদম

 ওনমের এই উৎসবে কেরালার মানুষেরা তাদের রাজা মহাবলীকে আবাহন করেন প্রতিবছর। মাঝিদাদার বলা ওনমের গল্পটা তোমরাও শোন তাহলে। 
মহা শক্তিমান, মহাবলী ছিলেন কেরলের রাজা। প্রহ্লাদের তিনি নাতি, হিরণ্যকশিপুর প্রপৌত্র। হিরণ্যকশিপু যে প্রহ্লাদের বাবা তা তোমরা নিশ্চয় জানো। একদিকে বিষ্ণুর ভক্ত কিন্তু অন্যদিকে ভয়ানক অহংকারী। যুদ্ধে বা-র বা-র দেবতাদের পরাজিত করতে থাকেন তিনি। এরপর দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তারপর বিষ্ণু এক ছোট্টখাট্টো ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে রাজার সামনে এলেন। এই ব্রাহ্মণকে বলা হয় বিষ্ণুর বামন অবতার। দানবীর মহাবলি সেই ব্রাহ্মণকে জমি, অর্থ, গরু অনেক কিছুই দিতে চাইলেন কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ চাইলেন তাঁর নিজের পায়ের তিন পা জমি। রাজা হাসলেন, মাত্র তিন পা জমি! ব্রাহ্মণ কি পাগল নাকি। তিনি এতকিছু দিতে চাইছেন আর তার বদলে সে চায় মাত্র তিন পা জমি! রাজা কিন্তু ছদ্মবেশী বিষ্ণুকে চিনতে পারেন নি। সেই তিন পা জমির দুই পা’তেই মহাবলী রাজার সমগ্র রাজ্য ঢেকে গেছিল। রাজা তখন নিজের মাথা এগিয়ে দেন ব্রাহ্মণের আরেকটি পা রাখবার জন্য। তখন রাজার সামনে অবধারিত মৃত্যু। বিষ্ণু রাজার কাছে জানতে চাইলেন তিনি কি চান! প্রজাবৎসল রাজা প্রার্থনা করেছিলেন প্রত্যেক বছর একবার তিন দিনের জন্য তিনি নিজের প্রজাদের সঙ্গে মিলিত হতে চান। বিষ্ণু বললেন তথাস্তু। 
সেই বিশ্বাসে প্রতিটি কেরেলাইট বা কেরালাবাসী ওনমের সময় তাদের রাজা মহাবলীকে আহ্বান করেন এবং উৎসবে মেতে ওঠেন।
সেই যে ওনমের সাপ নৌকার বাঁইচ আর তাতে এক একখানা নৌকা একশো ফুটের ওপর লম্বা আর তাতে দাঁড় হাতে কম সে কম পঁয়ষট্টি জন মাল্লা। বড় নৌকায় একশোর ওপরেও দাঁড়ি বা মাল্লা থাকেন। প্রবল বেগে ভেমবনাদের বুকে জলের রেনু ওড়াতে ওড়াতে সে সব নৌকা ধেয়ে চলে, একজনের পিছে একজন। কখনো বা পাশাপাশি। কখনো আগেপিছে।  তখন ভেম্বনাদের পাড়ে হাজার হাজার নয়, লাখে লাখে মানুষ। সব কেতুভল্লম তখন দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে। কেতুভল্লম বুঝলে তো, এই যে নীলাম্বু দিয়ে তৈরী আরামপ্রদ সব নৌকা। হাউসবোটগুলো। যার একটাতে বাস করছি আমরা। এ তার মালয়ালাম নাম। নামের যে অনুবাদ হয় না,  তা তোমরা সবাই জানো। ঘরবাড়ি সমেত নৌকা তাই ইংরেজিতে সে হয়েছিল হাউসবোট। এই নৌকাগুলো ওনমের সময় ভরে যায় সারা পৃথিবী থেকে আসা ট্যুরিস্টে। সবাই দেখতে আসেন এমন নৌকা বাঁইচ। (ক্রমশঃ) 
কাশ্মীরের হাউসবোট একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু কেরালার হাউসবোট জলে ঘুরে বেড়ায়। তবে ভল্লমকেলির দিন এরা দাঁড়িয়ে থাকে সার বেঁধে তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়। আর ভয়ঙ্কর দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে একটার পর একটা নৌকা ‘ভল্লমকেলি’ নৌকা বাঁইচে। যে ভল্লমকেলি, সেই স্নেক বোট রেস, আবার সেই নেহেরু ট্রফি বোট রেস। 
মাঝিদাদা দেখিয়েছিল, ভেম্বনাদে ঢোকার আগে স্নেকবোট রাখবার বিরাট বিরাট ঘর খালের পাশে পাশে। এই উৎসবের আগে সেইসব নৌকাদের রীতিমতো যত্ন করে পালিশ করে তৈরী করা হয়। আর তৈরী হয় তারা, যারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবে। ওনমের এ বাঁইচের, সঙ্গে কেরালার মানুষের অন্তরের টান থাকে জড়িয়ে। জলে হয় এই বাঁইচ খেলা, এছাড়া ওনমের মাসভর কেরালা জুড়ে চলে উৎসব। নাচ গান বিভিন্ন মার্শাল আর্ট আর খাওয়া। উৎসব মানেই বিশেষ বিশেষ খাওয়া। সে অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়েই। 
কেরালার মানুষ, ফুল দিয়ে আলপনা দেন এই ওনমের সময়। বিশাল বিশাল পাত্রে জলের ওপর ফুল দিয়ে সুন্দর সব আলপনা। মাটির ওপরেও ফুলের পাপড়ি দিয়ে অপূর্ব সুন্দর সব আলপনা। নাম তার কোলম। (ক্রমশঃ)

পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ছোটোবেলা ৬৯ পড়ে জ্বলদর্চির প্রিয় পাঠক বানীয়া সাহা বি.এ. তৃতীয় বর্ষ, বেথুয়াডহরী, নদীয়া, যা লিখল) 

বেশ কিছুদিন ধরে ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্যে "জ্বলদর্চি" র পরম ছোঁয়া থেকে ক্রমশ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলাম।.....যাক!... এতদিনে সেই ব্যস্ততাকে দূরে রাখার সাহস পেলাম। ভাগ্যিস সাহসটা দেখিয়ে ছিলাম! তা না হলে এবারের "ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৬৯" এর অপরূপ উপস্থাপনাগুলি মিস হয়ে যেত। একে তো কোভিডের জন্য বাইরে বেরোনো নিষেধ তার ওপর নতুন আর এক সদস্য ওমিক্রন এসে হাজির। খেলাধূলা তো দূরে থাক বাইরে একটু পা রাখতে গেলেই কত্ত সব নিয়মকানুন! আর পারা যাচ্ছে না! তবে এই কঠিন পরিস্থিতির ভয়টা জ্বলদর্চির প্রচ্ছদে ছোট্ট বুনুটাকে দেখে বেশ কিছুটা কমেছে। মিষ্টি বোনটার হাতে স্মাইলি বলটা দেখে আমারও যে খেলতে ইচ্ছে করছে! মন চাইছে বুনুটার কাছে ছুট্টে গিয়ে বলটা নিয়ে ওর সাথে catch catch খেলি। কিন্তু বুনুটা কি খেলবে আমার সাথে? কিজানি!
শ্রদ্ধেয় চিত্রগ্রাহক মৃণাল ঘোষ মহাশয়, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই এমন ছবি উপহার দেওয়ার জন্য।
ছোটোদের সাথে সময় কাটাতে আমি বরাবরই ভালোবাসি। বাড়িতে আমার বোন থাকায় সেই ইচ্ছেটাও পূরণ হয় সময়ে সময়ে। কিন্তু সমস্যা হলো বোনের সামনেই পরীক্ষা, তাই এখন আর সেভাবে হাসি-আড্ডায় সময় কাটানো হয়ে ওঠেনা। তবে আনন্দের বিষয় হলো আমার এই মনখারাপটা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি শ্রদ্ধেয়া তৃষ্ণা বসাকের 'জয়াবতী' র মধ্যে নিজের বোনকে যেন খুঁজে পেলাম। পুরোপুরি না মিললেও কিছুটা একই। জয়াবতীর কাজের প্রতি আগ্রহ, ধৈর্য্য, এবং তার যে অদম্য জেদ,এটা আমার কাছে এক নতুন প্রেরণা হিসেবে ধরা দিয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে মেয়েদের শিক্ষার যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে কিন্তু প্রাচীন সময় গুলিতে নারীশিক্ষা সমন্ধে  মানুষের যে সংকীর্ণ চিন্তা ভাবনা তা এই ধারাবাহিক উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যায়। জয়াবতীর পুঁথির কালি তৈরী করার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের যে প্রাথমিক বিবরণ তুলে ধরেছেন লেখিকা তা সত্যিই অনবদ্য। কালীগতির, জয়াবতীকে শিক্ষিত করে তোলার ইচ্ছে সত্যিই কী পূরণ হবে তা দেখার বিষয়। উপন্যাসের নামকরণ জয়বতীর সাফল্যতাকেই ইঙ্গিত করে। এখন দেখা যাক কিভাবে লেখিকার কলমে "জয়াবতীর জয়যাত্রা" ঘোষিত হয়। সবে তো শুরু! দেখাই যাক কি ঘটতে চলেছে মেয়েটার জীবনে। এখন বরং যেটুকু জানলাম জয়াবতীর সম্পর্কে তা দিয়েই না হয় পরের টুকু কল্পনা করে রাখি আগামী পর্ব না আসা অবধি!  
জানার কি আর শেষ আছে! এই তো, এবারের সংখ্যায় পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত লেখা থেকে কত্ত সব অজানা তথ্য জানতে পারলাম। কিভাবে তিনি শিবনাথ ভট্টাচার্য থেকে ১৮৭২ সালে এম.এ. পাশ করে শিবনাথ শাস্ত্রী হলেন তা সত্যিই আমায় মুগ্ধ করলো। মাননীয় লেখক মানস শেঠ মহাশয় খুব সুন্দর ভাবেই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর শিক্ষা জীবন, তাঁর চিন্তা ভাবনা, চরিত্র সবকিছুকেই শৃঙ্খলিত ভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন লেখক। অনেক সমৃদ্ধ হলাম এমন লেখায়।
শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা 'নির্বাসিতের বিলাপ' কাব্যগ্রন্থটির একটি আলোচনা পেলাম স্নেহা মন্ডলের লেখায়। আলোচনার লেখন শৈলীটি খুব সুন্দর লাগলো, লেখার ভাষাতেও এক পরিণত হৃদয়ের সুপ্ত ভাবনা গুলো দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তবে মাঝে মাঝে লেখাটি পড়তে পড়তে কোথাও যেন একটু একঘেয়েমি ভাব এসে যাচ্ছিলো। যদিও আমি খুব বেশি অভিজ্ঞ নয় এই লেখালেখির ব্যাপারে, তবে বড়োদের কাছ থেকে যেটুকু শিখেছি সেখান থেকে বলতে পারি যে, যদি লেখার ভাষাটা আরেকটু প্রাণবন্ত এবং মসৃণ হতো তবে হয়তো লেখাটির মান আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেতো। আসলে প্রত্যেক পাঠকই হয়তো লেখায় নতুন কিছু পেতে চাই। সেই নতুনত্ব থেকেই সৃষ্টি হয় আরেকটা নতুনের। এই নতুনত্বটার একটুখানি অভাব যেন লেখাটিকে মাঝে মাঝে টলিয়ে দিচ্ছিলো। 
তবে সত্যি কথা বলতে স্নেহার লেখাটি পড়তে পড়তে কখনো কখনো সত্যিই যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম সেই সমুদ্রতটে, চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর একটা আবছা অবয়ব। অদ্ভুত একটা ঘোর লাগানো মায়াবী মায়াবী ভাব যেন চেপে ধরছিল আমায়। আশা রাখি স্নেহার লেখা আরও নতুন কিছু উপহার হিসেবে পাবো।
শিবনাথ শাস্ত্রীর কিছু জীবনকথা মাননীয় লেখক মানস শেঠ মহাশয়ের লেখায় যেমন উজ্জ্বলিত হয়েছে তেমনি সেই উজ্জ্বলতার ছটাকে আরও কিছুটা ছড়িয়ে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় পীযূষ প্রতিহার মহাশয় "স্মরণীয়" তে। লেখকের এই উপস্থাপনাটিতে মহান ব্যক্তিত্ব শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনের আরও বেশ কিছু অংশ জানতে পারলাম। শিবনাথ শাস্ত্রীর শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি তাঁর কর্মজীবন, সৃষ্টি, অবদান, আদর্শ, পত্রপত্রিকা প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে পেরে অনেকখানি সমৃদ্ধ হলাম। তাঁর মতো এমন একজন শ্রেষ্ঠ, মহৎ ব্যক্তিসত্ত্বার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম রইলো।
এত সুন্দর ভাবে পত্রিকাটি সাজানো যে, যত বলি ততই কম মনে হয়। উপন্যাস, আলোচনা, জীবনী এসবের পর যখন মাননীয় কবি মুক্তি দাশের কবিতাটি চোখে পড়ল, তখন আর কী! হাসতে হাসতে বিছানাতেই গড়িয়ে পড়ছিলাম। সত্যি সত্যি যদি সরস্বতী মায়ের বর পেয়ে রাতারাতি কবি হয়ে যেতাম তাহলে সে এক দারুণ ব্যাপার হতো। ভীষণ উপভোগ করলাম কবিতাটি। যখন কবি সরস্বতী দেবীকে বললেন,
"পড়াশোনা ব্যাপারটা মা / বেজায় রকম কষ্ট।" এটা শুনে বুকে যেন বল পেলাম। এ কষ্ট আমার একার নয় দেখচি! আমার দলে কবিও আছেন। 
ওদিকে আবার আরেক কবি কী কান্ডই না করেছেন! এতদিন "ক" এ "কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি", "খ" এ "খেকশেয়ালী পালায় ছুটি" এসব পড়ে এসেছি। আজকে ক থেকে পুরো চন্দ্রবিন্দু অবধি নতুন কিছু পড়লাম। মাননীয় কবি সুব্রত দেবের এমন সুন্দর মিষ্টি ছড়ার "নতুন ব্যঞ্জন" সারা জীবন মনে রাখবো। কী আর বলি! এ যেন এক নতুন আপডেট ভার্সন! প্রণাম কবিকে।
যেহেতু অতিমারীর পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি তাই বাইরে বেড়াতে যাওয়াও সেভাবে হয়ে উঠছে না। কিন্তু "জ্বলদর্চি" থাকতে সে ইচ্ছা পূরণ হবে না তা কি আর হয়! ওই তো, মাননীয়া লেখিকা বাসবদত্তা মহাশয়া কেরালা ভ্রমণের যে স্মৃতি আমাদের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন তাতেই তো অর্ধেক বেড়ানো হয়ে গেল আমার!
বিশাল পুন্নামাডা লেকের গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আমিও বোধহয় ওই হাউসবোট টাতেই বসে আছি ওদের সঙ্গে। "নেহেরু ট্রফি বোট রেস", "ওনম", "বল্লম কেলি" সব মিলিয়ে এই পর্বের কেরালার পরিবেশ মন ভরিয়ে দিলো। আরও অনেকটা বেড়াতে চাই। এখন পরের পর্বটা আসলেই হলো! আবার ভেসে যাব কল্পনায়, লেখিকা যেমন ভাবে আমাদের ভাবাবেন ঠিক সেইভাবে।
বিশিষ্ট লেখক অসীম হালদার মহাশয়ের "জ্বলদর্চি"র ৬৮ তম সংখ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ  পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে নতুন কিছু শেখার পাশাপাশি সম্পূর্ণ পত্রিকাটির একটা সারসংক্ষেপ ও পেলাম। 
চিত্রশিল্পী সুস্মিতা সাহার আঁকা প্রতিকৃতিতে তাঁর হাতের নিঁপুণতার ও দক্ষতার পরিচয় পেলাম। সত্যিই অসাধারণ এঁকেছেন তিনি। পেনসিল শেডের ওপর ইনক শেডের কাজ দারুণ মানিয়েছে এবং সাদাকালো ছবিটিতে নিঁখুত ও পাকা হাতের টোন সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠায় প্রতিকৃতিটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
সপ্তম শ্রেণির স্নেহাও প্যাস্টেলে খুব সুন্দর ভাবে সরস্বতী মায়ের অ্যাবস্ট্রাক্ট ইমেজটা ফুটিয়ে তুলেছে। আলোছায়ার ব্যবহার ও ব্যাকগ্রাউন্ডে লাল, হলুদ ও নীল রঙের মিক্সিংটা খুব পরিস্কার ভাবেই করেছে। সবমিলিয়ে ভীষণ সুন্দর লাগছে আঁকাটি।
লেখা, আঁকা সবকিছুকে নিয়ে শ্রদ্ধেয়া সম্পাদক মৌসুমী দিভাই যেভাবে সাজিয়ে তুলেছেন পত্রিকাটিকে তাতে তার মধ্যে দিয়ে শুধুমাত্র জ্ঞানই নয় বিভিন্ন সৃজনশীল বিকাশও শিশু সহ সকল পাঠকের মধ্যে কমবেশি বিকশিত হয়ে উঠবে এই আশা রাখি। নতুন নতুন বিষয় এভাবেই সংযোজিত হতে থাকুক পত্রিকায় এবং উঠে আসুক নতুন মেধা।


আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments