জ্বলদর্চি

নববর্ষ ১৪২৭


প্রচ্ছদ - প্রশান্ত খাটুয়া  




নববর্ষ

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"হে নূতন এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করে/ব্যর্থতায় গ্লানি ভুলে,ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা,পুড়িয়ে ফেলে, বাজুক/প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা' - রবীন্দ্রনাথ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা জাতি নানা ভাবে নববর্ষ উদযাপন করে। বাঙালি, ইরানি, চিনা, ইংরেজ ও ফরাসি, সবাই পালন করে নববর্ষ উৎসব। যেমন খ্রিস্টান জগতে পয়লা জানুয়ারি, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দুনিয়ায় নববর্ষ মুহরমের আশুরা থেকে, ইরানের নওরোজা , ইহুদিদের নববর্ষ হচ্ছে 'রাশ হাসানা' ভিয়েতনামীদের 'তেত' । উদযাপনের রীতি প্রকৃতি ও পদ্ধতি-প্রকরণের মধ্যে তারতম্য আছে। তবু সব ক্ষেত্রে একটি মৌলিক ঐক্য আমাদের চোখে পড়ে। তা হলো নবজন্ম বা পুনর্জন্ম বা তাঁর ধারণা। পুরনো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে সতেজ সজীব নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভুতি। 
তাই টেনিসন যখন বলেন - "রিং আউট দি ওল্ড,রিং ইন দা নিউ/রিং হাপি বেলস ,এক্রস দি স্লো/ দি ইয়ার ইজ গোয়িং, লেট হিম গো/ রিং আউট দি ফলস, রিং দি ট্রু"। 
এই কথাটি আবার রবীন্দ্রনাথের মধ্যে লক্ষ্য করি। কবি যখন বলেন - "এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপসনিঃশ্বাসবায়ে/ মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।" একজন বলছেন পয়লা জানুয়ারিকে উদ্দেশ্য করে, আর একজন লিখেছেন পয়লা বৈশাখকে লক্ষ্য করে। কিন্তু মূল সুর দুজনের এক।
বাংলা সন ও নববর্ষের উদযাপনের কথা কোথাও সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতেরা মনে করেন মোঘল সম্রাট আকবর চন্দ্র হিজরী সনের সঙ্গে ভারতবর্ষের সৌর সনের সমন্বয় সাধন করে ১৫৫৬ সালে বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন চালু করেন। আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন সম্রাট আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহি সন প্রবর্তন করেন তার ভিত্তিতে বাংলায় এই নববর্ষ চালু হয়। তাই একে সন বা সাল বলে। 'সন' কথাটি আরবি আর 'সাল' হলো ফরাসি। তবে কেউ কেউ একে বঙ্গাব্দও বলে। এই পয়লা বৈশাখে নবাব এবং জমিদারেরা 'পুণ্যাহ' অনুষ্ঠান চালু করে। প্রজারা এই দিনে নবাব বা জমিদারদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন। মিষ্টিমুখ করানো হতো তাদের। মূল উদ্দেশ্য ছিল বকেয়া খাজনা আদায়। আধুনিককালে নব আঙ্গিকের বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা হয় কলকাতার ঠাকুর পরিবারে এবং শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে।
আবশ্য কালের যাত্রাপথ ধরে এর উদ্যাপন রীতিতে নানা পালাবদল ঘটেছে। এক সময় গ্রাম-নগর নির্বিশেষে বাংলার সব মানুষ, সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান হোক,বাংলা নববর্ষের উৎসবে সোৎসাহে যোগ দিতো। পরস্পরের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নানা রকম খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব, মেলা ও প্রর্দশনী  মিলে সারা বছরের অন্যান্য দিনগুলি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে এই দিনটি গৌরবমণ্ডিত হয়ে উঠতো। সাড়ে তিন’শ বছরেরও বেশি আগে বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে বাংলা নববর্ষকে এদেশের জনগণের 'নওরোজ' বলে উলেখ করেছেন।
নববর্ষ, এই দিনটি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা ও মিঠাই বিতরণের অনুষ্ঠান তো আছেই। তার পাশাপাশি আছে নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী ও মেলার আসর,সঙ্গীতানুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি, আলোচনা সভা, বক্তৃতা-ভাষণ ইত্যাদি। তবে যে গ্রামবাংলা ছিলো পয়লা বৈশাখের আনন্দানুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র আজ অর্থনৈতিক কারণে শহরে, পয়লা বৈশাখকে উপলক্ষ্য করে এখন যে চাঞ্চল্য ও আনন্দ-উৎসব দেখা যায় তা নিতান্তই মেকি একথা বলা যাবে না, কিন্তু তার মধ্যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নাগরিকের বুর্জোয়া বিলাস ও ফ্যাশনের একটি বড় অংশ কাজ করছে, সেকথা মানতেই হবে। পয়লা বৈশাখকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের অন্তরসত্তার সঙ্গে এর রাখীবন্ধনকে আবার নতুন করে বাঁধতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমাদের আজ বাংলা নববর্ষের মধ্যে সচেতনভাবে নতুন মাত্রিকতা যোগ করতে হবে।বাংলা নববর্ষের উৎসব যে বিশেষভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত, শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে, সাধারণ মানুষের উৎসব, এর একান্ত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র যে অত্যন্ত তাৎপর্যময় আজ সেকথাটা আবার জোরের সঙ্গে বলা চাই। নিজেকে একবার একজন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বাংলার মানুষ হিসেবে ভেবে দেখুন, তাহলেই এর শভিনিস্টিক দিকটি বুঝতে পারবেন । অথচ এ অঞ্চলের ঐতিহ্য তো তা নয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া শক্তির সামনে স্বাধীন বাংলার সূর্য ডুবে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সিরাজদ্দৌলা শেষবারের মতো লড়াই করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান উভয়কে। আমাদের ঐতিহ্য তো মীরমদন ও মোহন লালের, তিতুমীর ও মঙ্গল পাণ্ডের, গোবিন্দ দেব ও মুনীর চৌধুরীর। তবে কেন এখন এরকম ঘটছে? বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপন আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অপরাজেয় শক্তি ও মহিমায় পূর্ণ করুক, এক হোক আমাদের শুভ কামনা। জয় নব নববর্ষ।





আড্ডা ভিডিও ঃ