জ্বলদর্চি

অচিন্ত মারিক বিশেষ ক্রোড়পত্র।

কাছের মানুষ অচিন্ত
হরিপদ মণ্ডল
-------------
অচিন্ত মারিক আমার খুব কাছের মানুষ। মেদিনীপুর শহরে যাঁরা জ্ঞানচর্চা করছেন অচিন্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ওর গ্রন্থগুলির মৌলিকতা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। সেই আকর্ষণ থেকেই ওর বাড়িতে আমার যাতায়াত শুরু হয়। পারিবারিক দিক থেকেও সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে ক্রমশ। অচিন্তের অনুসন্ধিৎসা আমাকে মুগ্ধ করে। ওর অনুসন্ধিৎসাকে জানার জন‍্য একটা কথা বলতেই হয়---সুবল চন্দ্র মিত্রের লেখা 'ISVAR CHANDRA VIDYASAGAR : A STORY OF HIS LIFE AND WORK'  দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থখানির সন্ধান ও তার একটি  কপি অচিন্ত আমাকে দিয়েছিল। একটা সময় শারীরিক-মানসিক কারনে আমি লেখাপড়ার জগৎ থেকে অনেকটা সরে এসেছিলাম। অচিন্ত-ই আমাকে আবার ফিরিয়ে আনে। ও বলতো স‍্যার কিছু করুন আমি আছি। ওর আগ্রহ আন্তরিকতা-ই আমাকে সচল করেছিল। ওর প্রকাশনা থেকে আমার কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মেদিনীপুরে বিদ‍্যাসাগর স্মৃতি মন্দির সমিতি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রবীণ সদস্যরা নানাবিধ কারনে যখন সরে যাচ্ছেন আমি অচিন্তকে তখন এর সঙ্গে যুক্ত করি। কঠিন সময়ে অচিন্তের ওপর আমি আস্থা খুঁজে পেয়েছিলাম।অল্পকথায় অচিন্ত সম্পর্কে লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। শেষে একটি কথায় বলি অচিন্ত আজীবন কর্মমুখর থাকুক।

-----------------
একজন সত‍্যিকারের মহৎ শিল্পী
  জয়ন্ত সাহা

অচিন্ত মারিক, আমি তার ডাক নামটাই ব‍্যবহার করি----রবি। রবির সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তার শৈশবের কথাই চলে আসে। রবি খুব ভালো ছবি আঁকত। পরবর্তীকালে সাহিত‍্যের প্রতি তার অসীম ভালবাসায় একের পর এক বই আমরা পাই। ইতিমধ্যে মুদ্রণ-এর ব‍্যাপারেও তার ব‍্যুৎপত্তির কথা জানতে পারি। ক্রমে ক্রমে আমি তার একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে পড়ি। রবি যখন কোনো নতুন বই লেখে তখন আমরাও একটি কপি জুটে যায় অবশ্যই সৌজন্য সংখ্যা। কলকাতার রবীন্দ্রসদনে মেদিনীপুরের অন‍্যতম বংশীবাদক রঞ্জন জানার একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চ অলংকরণ করে রবি। দর্শকদের তা খুব ভালো লাগে। রবির আরেকটি মহৎগুন যে কোনো শিল্পী ও কবির পাশে তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সবিশেষ জানাই রবির মা ও আমার মা এরা ছিলেন শৈশবের বন্ধু। শুধু তাই নয় আমি মাসিমাকে সই মা বলতাম। খুব গর্ব অনুভব করি আমার সইমা'র ছেলে আজ একজন সত্যিকারের মহৎশিল্পী, লেখক হয়েছে। অনেক শুভেচ্ছা রইল রবিকে।

--------------

অচিন্ত প্রসঙ্গে দু'কথা
  অনুত্তম ভট্টাচার্য

ছোটবেলায় পড়েছিলাম--'প্রতিভা যাহাকে স্পর্শ করে, তাহাকে সজীব করিয়া তোলে'। এই প্রতিভার স্পর্শেই মানুষ অমরত্ব অর্জন করে। এই প্রতিভা কারো কারো ক্ষেত্রে বাল‍্যেই বিকশিত হয়, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে বয়সকালে। শিক্ষাদান কার্যে নিযুক্ত থাকার সময় আমার অনেক ছাত্রের মধ্যে এই ধারা প্রত‍্যক্ষ করেছিলাম।
      স্নেহাস্পদ অচিন্ত মারিক আমার প্রাক্তন ছাত্র। ছাত্রজীবনে সে আমার ততখানি দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও কর্মজীবনে প্রবেশ করে সে আমার লুব্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অচিন্ত যখন 'অমিত্রাক্ষর' পত্রিকা প্রকাশ করে, তখন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই পত্রিকার লক্ষ্য ছিল সাহিত্য ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুনত্ব সৃষ্টি করা। সেদিনই তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ লক্ষ্য করেছিলাম।
      আমার চোখে অচিন্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বৃহৎ বৃহৎ তিনখণ্ডে প্রকাশিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ--মেদিনীপুর শাখার ইতিবৃত্ত প্রকাশ। এছাড়াও স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুরবাসীদের অবদান নিয়ে তার নানা প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তার লেখনী সুবর্ণমণ্ডিত হোক- এই কামনা করি।
       এবার একটু নিজের কথা বলি। বাংলাসাহিত‍্যের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক বীতশোক ভট্টাচার্য স্বল্পায়ু হয়ে পরলোকগত হলে তার স্মরণসভার যে আয়োজন অচিন্ত করেছিল, সেখানে উপস্থিত ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ‍্যামলকান্তি দাশ প্রমুখ সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক-কবিবৃন্দ। ঐ সভায় প্রয়াত সাহিত‍্যিকের স্মরণে নানা স্মারকদ্রব‍্য অচিন্ত যখন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার হাতে তুলে দিল, তখন আমার দু'চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম।
-------------
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
সুধাংশুশেখর মুখোপাধ্যায়

সুরধনি ও ব্রজকিশোরের আত্মজ অচিন্ত মারিক। জন্ম মেদিনীপুরে, সময় ১৯৫৮ র ডিসেম্বর মাস। প্রথাগত লেখাপড়া মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল, মেদিনীপুর কলেজ, তারপর ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজ, পাঠগ্রহন অসমাপ্ত। পেশায় প্রকাশক ও মুদ্রাকর।
     অচিন্ত মারিক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনায়  লীন। 'অমিত্রাক্ষর' পত্রিকা তাঁর প্রাণের সম্পদ, সারস্বত সমাজের দীপশিখা। 'চড়াই'কে তিনি মলাট বন্দি করেছেন, 'শ্মশান' দেখতে শিখিয়েছেন , বহুবিধ 'আড্ডা'য় বসিয়েছেন, 'ছদ্মবেশে'র কাল থেকে কালান্তর চিনিয়েছেন। তাঁর 'কাঠবেড়ালি' ও নানা কথায় স্বচ্ছন্দ 'পোস্টকার্ড' ও স্মৃতিমেদুর 'পরদা'র আব্রু বড়ো নিটোল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-মেদিনীপুর শাখার তথ্য ও তত্ত্বে তিনি যথার্থ মল্লিনাথ। গান্ধি-অালোচনায় নির্মোহ। শিক্ষিত সমাজের ভদ্রতার স্খলনে, বিকৃত কথনে তিনি প্রতিবাদ মুখর। 'অমৃতলোক'পত্রিকার সম্পাদকের দারিদ্র্য দোষের প্রতিকারে তিনি নিভৃতচারী আত্মনিবেদিত প্রাণ।মানুষের ধর্মকে শ্রেয় ও প্রেয়জ্ঞানে অমিত্রাক্ষরের এবারের ভাবনা ' গীতা ও কোরান'।
      তাঁর নির্মাণ ও সৃষ্টিতে আমি আনত।
---------

সাক্ষাৎকার

অনুপ মাহাত: সাহিত্য জগতের কারা আপনার প্রিয় ?

অচিন্ত মারিক : কৈশোরে শরৎচন্দ্র, প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথ, হতাশার যৌবনে সুনীল গাঙ্গুলী, এখন আর প্রিয় একজন কেউ নেই।

প্রশ্ন: কোন সাহিত্য পত্রিকা আপনার ভালো লাগে ?

অচিন্ত মারিক : 'বিভাব' ভালো লাগত,'উৎস মানুষ' ভালো লাগত। 'দেশ'ও ভালো লাগত, এখন 'কবি সম্মেলন' ভালো লাগে। তবে, প্রিয় বলব কি?

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় গ্রন্থের তালিকায় কোন গ্রন্থগুলো স্থান পাবে?

অচিন্ত মারিক : এক নিঃশ্বাসে দশটি বই আমার অত্যন্ত প্রিয়-- গোরা, শ্রীকান্ত, প্রথম প্রতিশ্রুতি, গণদেবতা, গঙ্গা, ঢোঁড়াই চরিত মানস, পুতুল নাচের ইতিকথা, অন্তর্জলী যাত্রা, লাল সালু এবং পথের পাঁচালী।

 প্রশ্ন: বেড়াতে গেলে কোথায় যেতে চাইবেন?

অচিন্ত মারিক : বার বার অজন্তা আর ইলোরা। গোয়ার কালাঙ্গুট বিচ-ও আমার প্রিয়।

প্রশ্ন: আপনার পছন্দের রঙ?

অচিন্ত মারিক : লাল, একদম টকটকে লাল।

প্রশ্ন: কী ধরনের পোশাক পরতে ভালোবাসেন?

অচিন্ত মারিক : কলার তোলা ফোর স্কোয়ার টি সার্ট, সঙ্গে গ‍্যাবার্ডিনের বেল বটম।

 প্রশ্ন: প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী কারা?

অচিন্ত মারিক : বাঘবন্দী খেলার উত্তম, শোলের অমিতাভ। দাদার কীর্তির দেবশ্রী, শুধু ঐ গাছতলার ঘোমটা দেওয়া দেবশ্রী।

প্রশ্ন: কোন সিনেমা বার বার দেখতে ইচ্ছা করে?

অচিন্ত মারিক : সাড়ে চুয়াত্তর অথবা শোলে। টস্ করলে কয়েন দাঁড়িয়ে থাকবে।

প্রশ্ন: কী কী খেতে ভালোবাসেন?

অচিন্ত মারিক : দুধ-আলুভাতে-ভাত--সঙ্গে পোস্ত বড়া।

প্রশ্ন: সখের কথা যদি বলেন।

অচিন্ত মারিক : উপরের সব প্রিয় জিনিসগুলি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা।

প্রশ্ন: আপনার বহুমুখী স্বভাব (হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, ব‍্যাঙ্ককর্মী, আর্টকলেজে ভর্তি, প্রেস স্থাপন, ডিজাইনার, লিটল ম‍্যাগাজিন সম্পাদনা, লেখক সত্তা ) কি আপনার অস্থিরতা নাকি বৈচিত্র‍্যের সুখ?

অচিন্ত মারিক: আমাদের সময়ে জে ই কোর্সে অ্যালোপ্যথি বা হোমিয়ো বা ডেন্টাল ইত্যাদি যে কোনো একটিতে পাঁচ বছর পড়তে হোত। আমি দুবছর কম পড়ে বেশি আড্ডা দিয়ে কোর্সটা ত্যাগ করি। পরিবারে অর্থের খুব অভাব থাকায় হাঃ সেঃ যোগ্যতার চাকরির পরীক্ষাগুলো দিতাম। এই সময়টা প্রচুর পড়াশুনা করেছি। ডিগ্রি ছাত্রদেরও পড়িয়েছি। টিউসনির টাকায় নিজের খরচ যুগিয়েছি -- সেসময় ওয়াল সাইন বোর্ড লিখে, হাইরোডে মাইলস্টোন লিখে, ফুট টেনিসে খেপ খেটে -- হরেকরফমে রোজগার করে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের নাইটে চান্স পেলাম। প্রিলিমিনারির পর আর খরচ তোলা যাচ্ছিল না। এটাও মাঝপথে দলছুট। ওই সময়ে ব্যাঙ্কে চাকরি। কুড়ি বছর পরে চাকরি ছেড়ে প্রেস তৈরি। গতানুগতিক ডিজাইন ভেঙে অন্যরকম নির্মাণ। মানুষ সেটা গ্রহণ করলেন। এই সময় জ্বলদর্চি পদবীধারী জনাকয়েক সাহিত্যকর্মী আমাকে লিটল ম্যাগে যুক্ত করে নেয়। এই সন্ধিক্ষণে বাবার ছোট পত্রিকা 'অমিত্রাক্ষর' কে নবরূপে প্রকাশ করলাম। অনেকের ভালো লাগল, আমিও নির্মাণ করে যেতে লাগলাম। দুঃখের কথা লেখকেরা কেউ পরিশ্রম করে গবেষণা করে লেখা দিচ্ছিলেন না,  ফাঁকি দিয়ে লেখার মান যা হয় আর কী! তখন নিজেই গবেষণা করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মেদিনীপুর সংখ্যা বের করলাম। তিন খণ্ডে চোদ্দশ পৃষ্ঠার ওই কাজটি আমার স্বপ্নের নির্মাণ। তারপর থেকে ভিন্নধর্মী বিষয় নিয়ে অনুশীলন -- ফসল 'পোস্টকার্ড', 'পরদা পরিকথা', 'ইতর ভাষা' প্রভৃতি। তবে হোমিয়ো থেকে অমিত্রাক্ষর পর্যন্ত বিস্তারে আমার কোনো অস্থিরতা বা বৈচিত্র্য-সুখ নেই। আছে শুধু সংকল্প।

অনুপ মাহাত: অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
---------