ডি এল রায় : শ্রদ্ধা ও স্মরণ
রা জ র্ষি রা য়
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(১৯ জুলাই১৮৬৩-১৭ মে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ)
বাংলা সাহিত্যে যে কজন সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী হয়েও নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অন্যতম। ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে দ্বিজেন্দ্রলালের জন্ম হয়। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন কৃষ্ণনগরের মহারাজার দেওয়ান। বিভিন্ন ভাষার উপরে তাঁর ছিল দখল। তিনি নানা ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন এবং কিছু গীতি সংগ্রহ আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার চরিত্রের এইসব গুণাবলী লাভ করেছিলেন। তাঁর চরিত্রের তেজস্বিতা, রসিকতা, শিল্পানুরাগ ও পাণ্ডিত্য দ্বিজেন্দ্রলালকে নানা দিক থেকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাঁর মা ছিলেন প্রসন্নময়ী দেবী, বিখ্যাত পণ্ডিত বংশের কন্যা।ছেলেবেলা থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল মেধাবী ছাত্র বলে খ্যাত ছিলেন। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করার পর ১৮৮০ সালে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন।১৮৮৩ সালে হুগলি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করে ইংরেজি সাহিত্যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে এম এ পাস করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে।দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরাধিকার সূত্রে সাহিত্য ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দীক্ষা পেয়েছিলেন। পরিবারের অনেকেই সাহিত্য সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি পরীক্ষা গুলিতে আশানুরূপ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি কারণ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এম এ পাস করার পর বিলেত যাত্রা করেন কৃষিবিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্যে। সেই সময় তাঁর সাহিত্য সাধনা আরও বেশি অগ্রসর হয়। এই সময়ে তিনি 'সাপ্তাহিক পতাকা' পত্রিকায় 'বিলাতের পত্র' প্রকাশ করেন। এইসব পত্রে তাঁর মননশীলতা ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
এইসময়ের দুটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য-- প্রথমটি : পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষা; দ্বিতীয়টি: ইংরেজি কাব্যের প্রকাশ। সেই কবিতাগুলিকে তিনি 'লিরিকস অফ ইনড' নাম দিয়ে প্রকাশ করেন।
বিলেতে থাকার সময় দ্বিজেন্দ্রলাল এর পিতা ও মাতার মৃত্যু হয়। সেই সময় তিনি দীর্ঘ তিন বছর পাশ্চাত্য জগতের বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় দেখে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসার পর বিনা প্রায়শ্চিত্তে কেউই সমাজে তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হননি। সমাজের এই ব্যবহারে তাঁর মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাঁর সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে 'একঘরে' রচনার মধ্যে১৮৮৯ সালে।
পরবর্তী সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল সরকারি কাজে যোগদান করেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। ১৮৮৭ সালে তিনি তখনকার প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁর বিবাহিত জীবন ছিল খুবই সুখের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সুরবালা দেবী একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি রেখে যান একমাত্র পুত্র দিলীপ কুমার ও কন্যা মায়া দেবীকে। পত্নীবিয়োগে তিনি যে চরম আঘাত পেয়েছিলেন তারই ফলে ১৯০৫ সালে নিজের বাড়িতে 'পূর্ণিমা মিলন' নামে এক সম্মেলনের প্রতিষ্ঠা করেন, তাতে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি উপস্থিত থাকতেন। এই সময় দেশজুড়ে সারা বাংলাদেশে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দেখা দিয়েছিল তার ফলেই তাঁর সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে। তাঁর ঐতিহাসিক নাটক ও দেশাত্মবোধক সংগীতের মধ্যেই তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯১৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের কিছুকালের মধ্যেই তিনি 'ভারতবর্ষ' পত্রিকা প্রকাশের জন্য উদ্যোগী হন। এই বছরই তিনি জ্যৈষ্ঠ মাসে সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আর্যগাথা' ১৮৮২ সালে (প্রথম ভাগ) এবং ১৮৯২ দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়।১৮৯৯ ও১৯০০ সালে 'আষাঢ়ে' এবং 'হাসির গান'নামে দুটি হাস্যরসাত্মক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।১৯০২ সালে 'মন্দ্র' কাব্যগ্রন্থ, ১৯০৭-এ 'আলেখ্য',১৯১২ তে 'ত্রিবেণী' কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
তাঁর নাট্য সাহিত্যের জন্যই তিনি বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। 'কল্কি অবতার' প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। ইতিপূর্বে তিনি 'একঘরে' নকশা রচনা করেছিলেন। ১৯০০ সালে তিনি 'পাষানী' নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। ১৯০৩-এ প্রকাশিত হয় 'তারাবাঈ' নাটকটি। ১৯০৮-এ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত নাটক 'নূরজাহান'। এই নাটকে তিনি নায়িকার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছেন। ১৯০৮-এ তিনি রচনা করেন 'সোরার রুস্তম', 'সীতা' 'মেবার পতন'ও 'সাজাহান' নামক নাটকগুলি। ১৯১১-এ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক 'চন্দ্রগুপ্ত'। সবশেষে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে রচনা করেন 'আনন্দ বিদায়' ১৯১২ সালে। এই নাটকটি বাদ দিলেও তাঁর অন্যান্য নাটকগুলির মধ্যে মেবার পতন এবং চন্দ্রগুপ্ত উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের দাবি রাখে। তাছাড়া তাঁর স্বদেশী গান এবং কবিতা সে যুগের বাঙালিকে যে মাতিয়ে তুলেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। নাটক কবিতা ও গান রচনা মধ্য দিয়েই দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থায়ী আসন লাভ করেছেন।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস।
-------------
রাজর্ষি রায় - চিত্রপরিচালক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক
7 Comments
Valo laglo
ReplyDeleteএই অবসরে কবি নাট্যকার ডি এল রায়কে শ্রদ্ধা জানাই।
ReplyDeleteএই রচনা লেখককে অশেষ ধন্যবাদ জানাই এ রকম মনোজ্ঞ লেখা উপহার দেওয়ার জন্য। লেখকের অন্য লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ।
Deleteধন্যবাদ।
Deleteধন্যবাদ।
ReplyDeleteতথ্য সমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগলো।
ReplyDeleteপড়লাম
ReplyDeleteভালো লাগলো