শ্যা ম ল কা ন্তি দা শ
বাবার বন্ধু
রাক্ষস আমাদের বাবার বন্ধু। অনেকদিনের পুরােনাে।
সেই বন্ধুতা প্রতিদিন ঘষেমেজে
বাবা নতুন করে তােলেন।
রাক্ষস আমাদের বাবার বন্ধু, কিন্তু মায়ের সঙ্গে
একটাও কথা বলেন না।
মা বলেন, উনি দেবতা, ভুল করে মাটিতে নেমেছেন,
ওঁকে প্রণাম করাে।
মায়ের চোখে টলমল করে কান্না, ঠোঁটে রক্ত,
বুকে নখের আঁচড়।
আমরা রাক্ষসদেবতার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।
একেকদিন ঝড়বৃষ্টির রাত্রে বাবা যখন
বাড়ি ফেরেন না, আমাদের খুব ভয় করে।
আকাশের ভয়। ভূতের ভয়। নক্ষত্রের ভয়।
অনেকগুলাে ভয় সাপের মতাে আমাদের গলা পেঁচিয়ে ধরে।
সেই সময় জামগাছের মাথায় বাঁকানাে আলাে,
ভরা পুকুরের জলে বিদ্যুতের ফুলকি।
দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে রাক্ষস হাসছেন।
রাক্ষস আমাদের মায়ের সঙ্গে কথা বলেন না,
কিন্তু পাশের ঘর থেকে আমরা আমােদ-আহ্লাদের শব্দ শুনতে পাই।
দেখতে পাই ঘরের ভেতর ঘােরাফেরা করছে
আবছা নীলরঙের আলাে।
আমাদের ডালপালায় দারুণ দোলা লাগে,
তিরতির করে কাঁপতে থাকে ভাইবােনের জীবন।
আর আমাদের ভয় করে না। একা লাগে না।
বাবার বন্ধু রাক্ষস ঝড় বৃষ্টির রাত্রে একমনে
আমাদের বাড়ি পাহারা দেন!
আজ
আজ কারও সময়মতো ঘুম ভাঙছে না। স্বপ্নের মৌতাত ছেড়ে
কেউ উঠে বসছে না বিছানায়। লম্বা করে কেউ আড়মোড়া
ভাঙছে না। দীর্ঘ হাই তুলে পাড়া মাথায় করছে না। কেউ এখন
ঘাতকের মতো আলমারির পাশে দাঁড়িয়ে নেই। দরজার
আড়াল থেকে কোনো 'সুপারি' তাক করছে না অস্ত্র।
আজ চমৎকার শুরু হয়েছে একটা দিন। আজ কেউ মন্দিরের ভেতর
বোমা বাঁধছে না। আজ কেউ কারও কালো হাত ভেঙে দিচ্ছে না
গুঁড়িয়ে দিচ্ছে না। পানের বরোজে মাদ্রাসায় নবজীবন সঙ্ঘের মাঠে
ছিটকে আসছে না রক্ত। কালো মেয়ের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে না
ইটভাটা। রাস্তা রাস্তার মতো। সেতু সেতুর মতো। নদী নদীর মতো।
আজ নেতিয়ে ন্যাকড়া হয়ে আছে বন্দুক। শান্তির জলে চুবিয়ে
রাখা হয়েছে রক্তমাখা ভোজালি। আজ কেউ কারও শত্রু নয়।
কেউ কারও শত্রু নয়।
জানালার বাইরে আজ ছবির বন্যা বইছে। রং। রং। আরও রং।
ফুল বলছে আমি ধন্য অলি বলছে আমিও। চারপাশে গাছপালার
শ্যামল বনে উদ্যানে কাননে কান্তারে শ্যামল বাংলার হাওয়া। গঙ্গা--
ভাগীরথীর তীর ঘেঁষে নতুন বউ যাচ্ছে। গয়নায় আলো হয়ে আছে
শরীর। আজ কোনো ডাকাতের ভয় নেই। চকমকির ভয় নেই।
নিষ্কলঙ্ক মাঠঘাট। অকলঙ্ক শান্ত জীবন।
একটা নিরিবিলি ঠান্ডা দেশ আজ চোখে চোখ রেখেছে।
কলকল করে আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। কাঁধে হাত রাখছে।
আজ কোথাও কোনো শনি নেই। রাহু নেই। কেউ আমাদের
গ্রাস করবে না। আজ কারো পায়ে কাদা নেই। হাতে ময়লা
নেই। কী অপূর্ব পুণ্যের আলো পেয়েছি আমরা! গাছে গাছে
অনবদ্য আকাশ ঝুলছে আর অবিস্মরণীয় সূর্যাস্ত!
মাগো, কী সাদা শুভ্র পবিত্র জীবন আমাদের!
মানুষের কান্না
আপনাদের দেশে মানুষের কান্না খুব দামি,
মানুষের কান্না ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।
প্রাণভরে সেই কান্না শুনব বলে
আমরা এতগুলো গঙ্গা ভাগীরথী
কৃষ্ণা গোদাবরী পেরিয়ে এলাম।
কী বিশাল শস্যশ্যামল আপনাদের দেশ।
কী বিচিত্র আপনাদের জলধারা।
কী অপূর্ব আপনাদের প্রাকার - পরিখা।
মানুষের কান্না শুনতে শুনতে আমরা তন্ময় হয়ে গেলাম।
কোনো কুলটা আমাদের ধ্যান ভাঙাতে পারল না।
কোনো সর্পিণী আমাদের ভয় দেখাতে পারল না।
আমরা বিগ্রহের মাথা দেখলাম।
তস্করের চরণ দেখলাম।
আমরা উট দেখলাম, শকুন দেখলাম,
ভূগর্ভ দেখলাম, পয়ঃপ্রণালী দেখলাম।
কী বিশাল আপনাদের দেশ
কী অপূর্ব আপনাদের দৃশ্যাবলী।
কী চমৎকার আপনাদের অস্ত্রভাণ্ডার।
মানুষের কান্না শুনতে শুনতে
আমরা একদিন প্রদীপের চিরায়ুষ্মান আলো হয়ে গেলাম।
বাঘের সঙ্গে
বাঘের সঙ্গে কথা বলছি দেখে সকলের খুব রাগ হয়ে গেল
লোকে বুঝতে পেরে গেল, গন্ধটা বড়ো সন্দেহজনক
আমি আর আগের মতো লোকালয়ে থাকব না
এবার আমার জামাতেও রক্তের ছিটে লাগবে
আমিও এবার যখন তখন কাঠকুড়ুনি আর মউলেদের ঘাড় মটকে দেব
জাতকুল খুইয়ে আমি জঙ্গলে বাদায় লতায় কাঁটায়
পাতাপত্রে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম
বাতিঘর আমাকে নিল না
দক্ষিণ রায় আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল
জলদস্যুরা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে চাইল
ইলিশ ধরার নৌকো আমাকে দেখে হইহই করে উঠল
এমনকী নিম্নচাপ, এমনকী দমকা বাতাস,
এমনকী ঘূর্ণিঝড়ও আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল
আর কোথাও আমার দাঁড়াবার জায়গা রইল না।
তারপর দিন যায় মাস যায় বছর যায়...
স্রোতে জলে ভাসতে ভাসতে হাঙরে কুমিরে ধাক্কা খেতে খেতে
এক ঘন নিবিড় রাত্রিবেলায় আমি চিরদিনের মতো বাঘের হয়ে গেলাম।
এবার কেউ আর আমার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না
বাঘের জন্য এখন আমি ঘর মুছি, আয়না পরিষ্কার করি, ঝুল ঝাড়ি,
আলনা গোছাই।
এখন বছরে একবার ভরা কোটালের সময়
বাঘ আমাকে জীবন দিয়ে স্পর্শ করে, আমিও বাঘের গায়ে হাত রাখি,
তার মলিন মর্ম মুছিয়ে দিতে ভুলি না।
বাঘের জল পেয়ে আমার লাবণ্য ফনফন করে ওঠে।
এত উদ্দীপক, এত গমগমে, এত অশ্রুতপূর্ব সেই নিবিড়তা
যে, বনের হরিণ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে
স্তব্ধ হয়ে যায়।
বাড়ি ফেরার কোনো চাঁদে ডোবা রাস্তাই সে আর খুঁজে পায় না।
কলঙ্ক
তোমরা অামাকে কলঙ্ক দিলে কথায় কথায়।
সে কারণে অামি এতদিন ধরে লুকিয়ে ছিলাম।
জনসমক্ষে কী করে দেখাব এই পোড়ামুখ--শুধু ভাবতাম।
অাজকে তোমরা ফের সেই ভুলে অামাকে অাবার
সমতল থেকে অালোয় অানলে--
সোহাগে প্রণয়ে মুছে দিলে কালি,মুখের রক্ত,জড়িয়ে ধরলে।
একেই হয়তো সবাই বলছে পুনর্মিলন!
গাছে গাছে পাখি। মাঠে মাঠে ধান। কী যে করি অামি।
সন্ধ্যার নীচে ঢাকা পড়ে গেছে ক্ষুদ্র জীবন।
কী যে করি অামি। কী যে করি অামি। কোন দিকে যাই।
প্রাঙ্গণে অাজ ছোটো ছোটো চাঁদ,ঈশ্বরশিশু, তারকাজননী
পাশাপাশি বসে খেলা করছেন।
জোড়-বিজোড়ের অপূর্ব খেলা খেলতে খেলতে
তাঁরা দেখছেন অালোয় ধন্য নতুন পৃথিবী!
তাহলে হয়তো সব কলঙ্ক কলঙ্ক নয়।
ভাঙা মুখে অাজ লেগে অাছে যত দুঃখ দহন
অনেকটা তার অসার অলীক কুয়াশায় ঢাকা কাদা মাটি জল --
কী যে করি অামি। কী যে করি অামি। কোনদিকে যাই।
অাকাশে ছড়ানো জীবনের যত ভস্মগেরুয়া-
রাজগৃহ ছেড়ে অামিও এবার বাইরে এলাম!
-----
18 Comments
পড়লাম
ReplyDeleteভালো লাগলো
This comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDeleteঅসাধারণ সব কবিতা! প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা জানাই।
ReplyDeleteপড়লাম
ReplyDeleteভালো, বেশ ভালো।
অসম্ভব সুন্দর কবিতা গুলো। ভালো থাকুন।
ReplyDeleteকবিতাগুলি বাস্তব জীবন্ত। ভেতর নাড়িয়ে দিল। কবিকে নমস্কার জানাই।
ReplyDeleteসবাইকে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteভালো লাগলো।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল। শ্যামলদার কবিতা সময়ে বদলায় না, তবুও আশ্চর্য হতে হয়! বাক্য এতই রসস্থ যে মজে যাই, কল্পনার শুশ্রূষা পাই। সর্বদা বা কোথাও কোনো sublimation যে ঘটবেই এমনটাও নয়, শুধু এক যাত্রাপথের পাঁচালি সে পথে অনেক পথই মেশে, পথের ছলাকলা, ঠার, সুবিদ্যা কুবিদ্যা সব রান্নাশালের ঘ্রাণ নিয়ে উপস্থিত হয় রসনার সামনে। লোভী করে না, কৃতার্থ করে। জিভে জল এনে নদী-সমুদ্রকেও পিপাসু করে তোলে! এর একটি কবিতা গতকালই হবে, টিভিতে শ্যামলদা একটি চ্যানেলে পড়ছিলেন, শুনেছি। করোনাকালীন অনেক পেলাম।
ReplyDeleteআমার প্রিয় কবির কবিতা পেয়ে শুধু পড়ে গেলাম পড়ে গেলাম আর পড়ে গেলাম।
ReplyDeleteভালো লাগলো লেখাগুলো। 'বাঘের সঙ্গে' কবিতাটি বেশি ভালো লাগলো।
ReplyDeleteঅসাধারণ!
ReplyDeleteদারুণ!
ReplyDeleteশ্যামলদার কবিতায় জীবন যে ভাবে পরিলক্ষিত হয়, যেভাবে তার কলমে মানুষের কথা উঠে আসে তা অনুপম এবং অনন্য। তার কবিতায় স্যাটায়ারিক।
ReplyDeleteদারুণ ! দারুণ ৷ শ্যামলকান্তি দাস অন্য এক অভিমুখ ৷
ReplyDeleteবাঘ ও আজ অপূর্ব লাগলো।
ReplyDeleteবাঘ ও আজ অপূর্ব লাগলো।
ReplyDeleteতব কাব্যসুধারসে ডুবেছি মজেছি। মরেছিও চরণে চরণে। কবিতা তো এমনই হবার কথা ছিলো।
ReplyDelete