জ্বলদর্চি

আনন্দরূপ নায়েক


আ ন ন্দ রূ প  না য়ে ক


বিনির্মাণ প্রকল্প  

বহুবার ভেবে দেখেছি শোওয়ার ঘরে ঘোড়ার ছবি টাঙানোর কোন‌ও যথার্থতা নেই। কলেজ এক্সকারশনে দীঘা গিয়ে যে ঘোড়াটির ওপর বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম, ময়দানের শখের গাড়ির ঘোড়াদুটির মতোই তার রঙ ছিল কালো। ইদানীং কালো ঘোড়াই বেশি চোখে পড়ে। অথচ আমার বিছানার পাশে রয়েছে মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা একটি ছবি। ভেঙেপড়া অট্টালিকা পেছনে ফেলে গভীর নীলের ভেতর দিয়ে তারা দৌড়োচ্ছে সামনের দিকে। প্রতিরাত্রে শোওয়ার আগে যতবার‌ই এই ছবিটির দিকে তাকাই, ঘোড়াগুলির রূপান্তর ঘটে ধূসর হতে হতে একসময় কালো হয়ে যায়। আকুল স্বরে বান্ধবীকে ডাকি। হঠাৎ‌ই রাতভোরে মনে হলো মেয়েলি নিতম্ব বদলে ফেলে ঘোড়াগুলি পুরোপুরি পুরুষালি হয়ে গেছে। ফিদা হুসেন নতুন তুলিতে নামকরণ করছেন, দ্য রেপ অফ ইয়োরোপা। 

ভুবন রমণী  

জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, হ্যালি বেরি বিষয়ে তাঁর কোন‌ও কাব্যগ্রন্থ নেই। কারণটা এই নয় যে হ্যালি বেরি তাঁর সময় জন্মাননি অথবা শ্রাবস্তীর কারুকাজ কেবল একক নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বস্তুত কৃষ্ণাঙ্গীকে যখন‌ই আমি সিনেমার পর্দায় দেখি, ডালিম দানার কথা মনে পড়ে। পার্থিব রোগ উপশমকারী যৌনশক্তি বৃদ্ধিকারক এক মাল্টিমিডিয়া প্রোডাক্ট, যা প্রত্য‌হ সেবন করলে সকালবেলা ঘুম ভেঙে খিদে খিদে ভাব থাকে, দুপুরবেলা টেলিফোনের ইচ্ছে জাগে, ইত্যাদি। অথবা দুরন্ত রোদচিল তার রূপপালকের শেকড় থেকে খসিয়ে দেয় শ্রাবণের ধারাবর্ষণ। 

এসব কথা শুনে আমার এক বামপন্থী বন্ধু বলেছিল, আচমকা মারা যাওয়ার আগে জীবনানন্দ একটি কবিতা লিখেছিলেন, কেউ কখন‌ও তার হদিশ পায়নি। হ্যালি বেরির ঠোঁট যেখানে রূপোলি আঁশে ঢাকা। মৎস্যকন্যার মতো ডুবসাঁতার কাটতে কাটতে একদিন সে সত্যিই মাছ হয়ে যাবে। অথচ আমার মনে হয়, এক সামুদ্রিক স্ত্রী ইলিশ ভালোবেসে ডিম পাড়তে আসবে বাংলার‌ই জলাভূমিতে। 


অন্ধকারের নাও ২৩ 

বোল উঠছে ধামসা-মাদলে। পাহাড় কাঁপছে থরো-থরো...। আশু ধানের গন্ধে ভেজা একদল হাওয়া এসে আমাকে বলল, চল-চল, গাছে গাছে জোড় বাঁধবে, আমনের বীজ ফুটবে, ওদের পাড়ায় আজ করম উৎসব...

সন্ধের ভেতর, আঁধারের ভেতর উজান বাইছে শ্যামলকথা। রূপসা নাচছে তার ব‌উদিদির হাত জড়িয়ে, ...রিমঝিম পাহাড় ঝাঁটি কা চলে, কিয়া দষে দাদা ভহজি মারিলে...

মুখিয়া এগিয়ে এসে হাতে ধরে নিয়ে গেল দুয়ারে, পেতে দিল খাটিয়া, চা এল, বিড়ি-দেশলাই..., মাথায় ময়ূর পালক গেঁথে, হলদে শালু বেঁধে ছেলেরা, মেয়েদের নতুন শাড়ি, ...নাচ চলল, বোল উঠল রাত গভীরে...

উঠে আসার সময় মুখিয়া এগিয়ে দিল পথ, আবার আসবে বটে মাস্টার, আজ থিক্যে তুমি নূতন কুটুম গ...


অন্ধকারের নাও ৩৩ 

ঝাড়বাগদা পাহাড়ের ভেতর থেকে বনমর্মর ভেসে এলে রাধিকা বোষ্টমী গেয়ে উঠে বলে, খাঁচার ভেতর যে পাখিটিকে ধরে রাখা এতকাল, দরোজা খুলে দিলেম যদি আজ, ডানা ঝাপটে পরাণ খোঁজে সে...। ...বলতে-বলতে চোখের পাতা তার ভারী হয়ে ওঠে শ্রাবণ মেঘের মতো। ওর কথার মানে বুঝি না, ...তবু দেখতে পাই, পাহাড়ের কোল ছাপিয়ে, কুসুম মহুলের দিগন্ত ছাপিয়ে বৃষ্টি নামছে চরাচরে...

ইস্কুল যাওয়ার পথে মানবাজার বাসস্ট্যান্ডে ফাগুর সাথে দেখা হয়। আমার হাতে একটা বিড়ি দিয়ে বলে, মাস্টার, একটা গান লিখ ন ক্যানো আমার আর বোষ্টমীর তরে...

বিড়িতে টান দিয়ে মনে-মনে বলি, ওই পাখি, তুই উড়ে যা..., বৃষ্টি-মেঘের ভেতর দিয়ে উড়ে যা..., গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে তুই উড়ে যা..., বনমর্মর ডানায় মেখে তুই উড়ে যা...

 শ্রমণ, তুই কবিতা লিখিস না 

কতকাল কবিতা লিখিনি। জল চেয়েছি শুধু..., জল। মেঘদহ পেরিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একাকী হারিয়ে গেল শ্রাবণ-পূর্নিমায় নিঃসঙ্গ শ্রমণ। ভিক্ষাঝুলি উপুড় করি ধুলোয়। এ জনমের খুদগুঁড়ো..., এসব কী হবে বলো, ...এই আলোটান, মায়ালতা, ভৈরবী গান? কর্কট রোগে শায়িত আমার মা, কপালে ছুঁইয়ে নিল শুশ্রূষা হাত, ...ভালো থাকিস তোরা। ভালো রাখিস, ভালো রাখিস...

শ্রাবণ নামছে জানালার ওপারে। সেবিকার পায়ের মোজায় বাঁধা হলুদ গার্ডার..., শহর জুড়ে বিছিয়ে থাকা বৃষ্টি শেষের হলুদ আলো...

নাম না জানা পাখি ডেকে উঠছে উঠোনে। খড় ধোওয়া জল ঝরছে চালা গড়িয়ে...। চারিদিকে জল নামছে..., শুধু জল... 

 শ্রমণ, তুই কবিতা লিখিস না...

-------

Post a Comment

1 Comments

  1. এক নতুন স্বাদের কবিতা।

    ReplyDelete