জ্বলদর্চি

দেবব্রত ভট্টাচার্য || পর্ব- ২


হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || পর্ব - ২

দেবব্রত ভট্টাচার্য্য 

কেদারনাথ দর্শন 

এদিকে সন্ধ্যা নামছে। পাশে গর্জনরত মন্দাকিনী পাহাড়ের পায়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছে তার বরফ শীতল জলধারা নিয়ে। ছোট বড় অসংখ্য গাছের দীর্ঘ ছায়ায় পাহাড়গুলো যেন কোন অশরীরী মোহময়তায় ডুবে যাচ্ছে। পাতলা মেঘের ওড়না জড়িয়ে অনেক উঁচু শিখরগুলো দু হাত জড়ো করে দিবাকর কে শেষ প্রণাম জানাচ্ছে। 
ট্রেকার খুব তাড়াতাড়িই গৌরীকুণ্ডে পৌঁছে গেলো। মালপত্তর নামায়ে হাঁটা দিলাম। এখন একটা মাথা গোঁজার স্থান দরকার। ভবেশদা দায়িত্ব নিলেন। আমি লটবহর নিয়ে বসলাম মন্দাকিনীর কিনারায়। চোখে পড়ল কিছুটা নীচে সাদা রঙের একটি ছোট্ট মন্দির। মন্দাকিনীর কোল ঘেঁষে। 
ভবেশদা ফিরে আসছেন দেখলাম। মুখে হাসি। অর্থাৎ যুদ্ধ জয়ের বার্তা এনেছেন ঠিক। আমরা দীপক লজের একটি ঘরের অধিকার পেলাম। দোতলার বার নম্বর ঘর। উঠতে গিয়ে দেখলাম এতো পাঁচ তলায় ওঠা। পাহাড় কেটে ধাপ করা। যেমন খাড়া তেমনি উঁচু! 
      জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললাম, 
  -নীচে নদীর একেবারে প্রান্তে একটি মন্দির আছে দেখেছি। চলুন দেখে আসি। তা ছাড়া ওপরে ওঠার সময় দেখে এসেছি সিঁড়ির পাশেই একটি চায়ের দোকান ।আর জানেন তো দেবুদা একটু বেশী চা ভক্ত। 
   সাদা রঙের মন্দিরটির সামনে একটা বেশ বড় বাঁধানো চাতাল। মন্দিরের মাথায় হিন্দিতে লেখা "শ্রী গৌরী মাঈ মন্দির "।এ মন্দিরের বিশেষত্ব হল এর দেওয়াল কেটে কেটে খুপরি করা। একটিতে গনপতির অবস্থান, আবার অন্যটিতে শিব লিঙ্গ। মাতৃ দর্শনে যাওয়ার পথে দরজার দু পাশে দুটি বড় বাক্স রাখা। প্রণামী পাত্র। দুটোই শ্রী বদ্রীনাথ ও শ্রী কেদারনাথ ধাম মন্দির রক্ষা সমিতির তরফ থেকে রাখা আছে। এক  পাশে একটি ছাইদান। ধূপ ও দীপ জ্বালানোর স্থান। অনেক ধূপ জ্বলছে দেখলাম। বাইরে সন্ধ্যা নামছে। আকাশের আচ্ছন্নতায় মন্দিরের ভেতরের পরিবেশটা আরও মোহময় করে তুলেছে। গৌরী মায়ের একটি নাতিদীর্ঘ মূর্তি রক্ত জবার মালায় শোভিত। গাওয়া ঘি এর প্রদীপ জ্বলছে। সে আলোয় ভেজা মেঝেতে বসলাম। মায়ের সামনে নতজানু হ'য়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়ে নিলাম ,আমাদের কেদারনাথ যাত্রা যেন নির্বিঘ্নে হয় মা। অনুমতি দাও ।তোমার আদেশ না পেলে পৃথিবীর ঘূর্ণন ও সম্পূর্ণ হয় না। 
    বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম, মন্দিরের পুরোহিত মশাই পদ্মাসনে বসে আছেন। সামনে গিয়ে বসলাম। 
 -এ মন্দির সম্পর্কে কিছু বলুন। 
   জানতে চাইলাম তাঁর কাছে। আশীর্বাদ জানিয়ে গোস্বামীজী বললেন -
 -এই স্থানে গৌরী মাতা কঠোর তপস্যায় বসেন শিব কে পতি রূপে পাওয়ার জন্য। এ স্থানেই মাতা প্রথম ঋতুস্নাতা হন। আবার এই খানেই বাবা গনপতির জন্ম হয়। বাবা কেদারেশ্বরের বড়ই প্রিয় স্থান এটি। তিনি এখানে সদা বিরাজমান। এ তীর্থ কে গৌরিতীর্থ বলে। মহেশ্বর এখানে গৌরীশঙ্কর নামে পরিচিত। 
  পুরহিত মহাশয় কে প্রণাম জানিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চাতাল থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। একেবারে মন্দাকিনীর স্রোতের কিনারায়। দেখলাম জল প্রবাহের প্রান্ত ঘেঁষে পাথর দিয়ে ঘেরা একটা গহ্বর। অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন। পায়ে পায়ে আমরাও এগিয়ে গেলাম। এটি তপ্তকুণ্ড। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উত্তপ্ত বারিধারা ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসছে। এ কুণ্ডটি দেখে দু চোখ জলে ভরে গেল। অত্যন্ত নোংরা এবং অগভীর একটি ডোবাকৃতি কুণ্ড। বহু মানুষ সেই নোংরা জলেই কুকুর কুণ্ডলীর মত গাদাগাদি করে মগে জল নিয়ে মাথায় ঢালছে। হাত দিয়ে দেখলাম, জল বেশ গরম। তবে পাশ থেকে অন্য একটা পাইপে বরফ শীতল জলধারা এসে কুণ্ডের জলে মিশছে। 
    মনে পড়ছে, হিমালয় পরিব্রাজক শ্রদ্ধেয় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর লেখা বিবরণ। উনি লিখেছেন -
  -গৌরীকুণ্ডে দুটি পৃথক স্নানাগার আছে। একটি পুরুষ ও অপরটি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট। প্রতিটিতে বড় বড় চৌবাচ্চায় গরম জল ও ঠান্ডা জলের দুটি করে নল লাগানো। পুন্যার্থীরা সেই জলে শরীর ও মনের সব মলিনতা ধুয়ে নেয়। 
   এ লেখা বিংশশতকের মাঝামাঝি সময়ের। আর আজ! 2013 এর মহাপ্রলয় তার ধংস লীলার আর এক চিহ্ন রেখে গেছে। 
   সন্ধ্যার অন্ধকার আরও ঘনীভূত। বৈদ্যুতিক বাতির অনুজ্বল আলোয় আমরা ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলাম। মন্দাকিনীর বক্ষ থেকে জলকনা কুয়াশার মত উঠে আসছে। দূরে অন্ধকার পর্বত শৃঙ্গগুলির অশরীরী উপস্থিতি মনে করিয়ে দিল এ হ'ল "-হিমালয়োনামঃ নগাধিরাজ"।
(ক্রমশ) 
-----------

Post a Comment

0 Comments