জ্বলদর্চি

তুলসীদাস মাইতি || পর্ব - ৩


হাজার বছরের বাংলা গান  ।।  পর্ব ৩

তু ল সী দা স  মা ই তি

বাংলা প্রেমগানের নিবিড় সূচনা ::
বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি



"বিদ্যাপতি চন্ডীদাস শ্রীগীতগোবিন্দ।
এই তিন গীতে করে প্রভুর আনন্দ।।"

কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত', জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল' গ্রন্থে বারবার এই কথাগুলি উল্লিখিত। অর্থাৎ নদীয়ার নিমাই সন্ন্যাসী হয়ে তাঁর পূর্ববর্তী যুগের তিন গীতিকারের বৈষ্ণব গান আস্বাদন করেই আনন্দ পেতেন। জয়দেবের পর বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস বাঙালির আদরের মানুষ। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দুজনের হাতেই বিশুদ্ধ বাংলাগানের আবহের নির্মাণ। চণ্ডীদাস কে ছিলেন, কতজন ছিলেন, বড়ু চণ্ডীদাস, পদাবলীর চণ্ডীদাস প্রমুখ ভিন্ন ব্যক্তি কিনা গবেষকদের এই বিতর্কে না গিয়েও গান নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব। বিদ্যাপতির ভাষা বাংলা নয়, ব্রজবুলি, তিনি মিথিলার কবি-এই বৃহৎ গভীরে না গিয়েও গান নিয়ে কথা হতে পারে।  বাঙালি হৃদয়ে বৈষ্ণব গানের ভাবাবেগ তৈরি তাঁদের গানের ভিতর দিয়েই যে সূচিত হয়েছিল তা বলাই যায়।

 চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতির সময় সর্বভারতীয় গানে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক চেতনা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলা বৈষ্ণব সংগীতেও রাধাকৃষ্ণ। তবে অধ্যাত্ম ভাবনায় কিছু তফাৎ এলো। দার্শনিক তত্ব ও মানবিক প্রেমের সাথে কৃষ্ণগীতি যুক্ত হয়ে মৃত্তিকামুখী হলো বাংলা গান। আসলে একটা সহজিয়া বৈষ্ণব ভাবনা তো সমসময়ে ছিলই। কেউ কেউ বলেন বাংলা বৈষ্ণবসহজিয়া ধর্ম, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে এসেছে, যা বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের রূপবদল মাত্র। সেন আমলের শেষ পর্বে হিন্দুসংষ্কৃতির দাপটে ভিন্ন মতগুলি ক্রমশই প্রচ্ছন্ন বা অবলুপ্ত হতে থাকে। তবে বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের মূল আদর্শ প্রেম। বৌদ্ধে যা ছিল মহাসুখ। কঠিন প্রেমসাধনার দ্বারা এক নিবিড় পবিত্র আত্মবোধে পৌঁছানো লক্ষ্য। চন্ডীদাসের গানে জীবনের এই সাধনা আছে। তবে বড়ু চন্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' অন্য কিছু বলার দাবি রাখে। এই সঙ্গীতগ্রন্থটির বিষয়ভিত্তি ও আঙ্গিক একটু অন্যরকমের। 
জয়দেবের কাব্যের অনুকরণে 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'র বিন্যাস - একথা অতি আলোচিত। সংলাপের মধ্যদিয়ে গানের বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আখ্যানগীতি পরিবেশন। প্রসঙ্গত বলা জরুরি, দীর্ঘকাল ধরেই বালকসঙ্গীত, কৃষ্ণযাত্রার ঢঙে সঙ্গীত পরিবেশন করার নিয়মকানুন ছিলই। হরিবংশ থেকে গীতগোবিন্দ পরিবেশনের রীতি অনেকটাই এই ধাঁচে। তবে কোথাও নিটোল মার্গসঙ্গীত ও প্রবন্ধগীতের নিয়ম শক্ত করে, কোথাও বা দেশি ও লৌকিক ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে। তাছাড়া সম্পূর্ণ সংগীত মানেই গীত, বাদ্য ও নৃত্য সহযোগ। "গীতং বাদ‍্যং তথা নৃত্যং যতস্তালে প্রতিষ্ঠিতং"। এই ধারাতেই সংগীত প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়েছে। প্রাচীন মার্কন্ডেয় পুরাণ, বায়ুপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ - সর্বত্র সংগীত সম্পর্কে যে ধারণা বা উপাদান চলে আসছিল তার ছায়াই ছিল নানান ভঙ্গিতে এই সময়েও। অর্থাৎ, "যথা নৃত্যে তথা গীতে, যথা গীতে তথা বাদ্যে।"-এই ভাবনা বহমান। আর্যভাষার নানান স্তর পেরিয়ে এলেও প্রাচীন এই সংগীত কাঠামো থেকেই গেল। এই ধারাতেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কিশোরী রাধার নারী হয়ে ওঠার কাহিনি পরিবেশন করতে গিয়ে কবি নাট - গীতি - পাঁচালী বৈশিষ্ট্য নিয়ে এলেন। গানের কথা যাই হোক ,অধ্যাত্ম ভাবনা সর্বদা রক্ষিত হয়েছে কিনা বা কাহিনির বিন্যাসে কতটা অশ্লীলতা এসেছে সে কথা বলবে ইতিহাস। তবে একথা সত্যি বাংলা ভাষার আদি পর্বের সংগীত আলোচনায় এর গুরুত্ব অনেকখানি। জয়দেবের কাব্যের অনুসরণে প্রবন্ধ সংগীতের রীতির মতোই এখানেও অনেকগুলি রাগ ও তাল গানগুলির শীর্ষ অংশেউল্লেখিত। মালব, রামগিরি, বড়ারি, দেশাগ, কোড়া, মল্লার, গুর্জরি, শ্রী, কেদার, বসন্ত, পটমঞ্জরি, বিভাস, বাগেশ্রী, ধানুষী, আহের প্রভৃতি রাগরাগিনীর সঙ্গে রূপক, দণ্ডক, ক্রীড়া, যতি, লগনি, চিত্রক, লঘুশেখর, কুড়ুক্কু, রূপকম্পা, একতালি, আটতালি প্রভৃতি তাল যুক্ত হয়ে বাংলা সংগীতের ঐতিহ্যকে গম্ভীর করে তুলেছে। আধুনিক কালে অবশ্য কেউ কেউ বড়ুর গীতমালাকে 'কৃষ্ণধামালি' নামক এক শ্রেনির চটুল ঝুমুর গানের অনুসারীও বলে থাকেন। 

পদাবলীর চণ্ডীদাস তো বাংলা গানের জনপ্রিয়তম মহাজন। অনেকের মতে সহজিয়া সাধক তিনিও ছিলেন। রামীর প্রসঙ্গ এই সূত্রেই আসে। রামীর লেখা বৈষ্ণবীয় প্রেমগানও পাওয়া গিয়েছে। জয়দেব পদ্মাবতীর মতো চণ্ডীদাস রামীরও সাধন সম্পর্ক রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কিত সংগীতকে এতটা মানবীয় করে তুলেছে। তবে চন্ডীদাসের রাধা সাধিকা। কৃষ্ণপ্রাপ্তির আরাধনায় তাঁর সমর্পন বাঙালি হৃদয়কে মথিত করেছে। প্রেমের পূর্বরাগ অনুরাগ মিলন পর্যায়ে চণ্ডীদাস যে চিরন্তন অনুভূতি সঞ্চারিত করে গেছেন তা আজও অমলিন। মৃদঙ্গ সহ নানান বাদ্য সহযোগে এই সঙ্গীত আজও মুগ্ধ করে চলেছে বাঙালি মননকে। মরমী বাউল সহ পরবর্তী সব সহজিয়া সংগীতসাধককে প্রভাবিত করেছেন চণ্ডীদাস। সহজ সরল ভাষা ও আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছে শুধু বৈষ্ণব রসভাবনাই নয়, বাংলা গানের গভীর হৃদয়টিও।

বিদ্যাপতিও চন্ডীদাসের সঙ্গেই সংযোজিত বৈষ্ণব গানের নির্মাতা। বাংলা সংগীত জগতের প্রায় সকলেই বিদ্যাপতির কাছে ঋণী। মিথিলার কবি ব্রজবুলি ভাষায় গান রচনা করলেও তিনি বাঙালির হৃদয়ের কাছের মানুষ। বৈষ্ণব প্রেম পর্যায়ের মাথুরকে এক নিবিড় অনুভূতির রসে নিয়ে সর্বহৃদয়সংবেদী করে তুলেছেন।
তিনি নানান গ্রন্থ রচনা রচনা করেছেন কিন্তু তাঁর বৈষ্ণব গান আমাদের কাছে আদরণীয়। তাঁর গানে বৈষ্ণব গানের প্রেম, মিলন, প্রেমবৈচিত্ত‍্য, প্রার্থনা সবার হয়ে উঠেছে।।রবীন্দ্রনাথের 'ভানুসিংহের পদাবলী' বিদ্যাপতির গানেরই প্রভাব।
'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'এ দেখি কৃষ্ণ মথুরায় যাওয়ার পর রাধার বিরহ হাহাকারে পরিণত হয়েছে। এই ধারাতেই চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি সহ পরবর্তী গীতিকারগণ রাধার আনন্দ-দুঃখ-বেদনার আবহ এনেছেন। পরবর্তী বাংলা গানে প্রেমের মরমী বীজ তো তখনই রোপিত হয়ে গেছে।
(ক্রমশ...)

Post a Comment

2 Comments

  1. তথ্য সমৃদ্ধ লেখনী। অনেক নতুন বিষয় জানতে পারছি। ভালো লাগছে। লেখককে অশেষ ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো। চলতে থাকুক।

    ReplyDelete