জ্বলদর্চি

সুদর্শন নন্দী || পর্ব -১


হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা || পর্ব -১

সু দ র্শ ন  ন ন্দী


ঐ যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা আইরি ক্ষেতের আড়ে-
প্রান্তটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়া ঝাড়ে,
পূবের দিকে আম কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা-
জটলা করে যাহার তলে রাখাল বালকেরা,
ঐটি আমার গ্রাম, আমার স্বর্গপুরী,
ঐখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি।

 কবিই পারেন প্রকৃতির প্রকৃতভাব হৃদয়ঙ্গম করতে। তাই গ্রামের বর্ণনা বিভিন্ন কবি মহাকবির কলমে ফুটে ওঠে সূর্যের কিরণ থেকে জ্যোৎস্নার ফুটফুটে আলোর মতো। যিনি সেই ভাব উপলব্ধি করেন তিনি হারিয়ে যান ফেলে আসা গ্রামের সেই দিনগুলিতে। এই লেখা এক হারিয়ে যাওয়া গ্রামের কথা বলার আনাড়ি প্রচেষ্টা। বলা ভাল হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথাও । হারিয়ে যাওয়া বলতে গ্রাম রয়েছে গ্রামেই, নেই স্মৃতিতে আটকে থাকা সেই সময়, সেই গ্রাম, সেই গ্রাম্যতা। সেও নয় নয় করে আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা। আমার গ্রাম, হারিয়ে যাওয়া আমার গ্রাম। গ্রামের চারিদিকে ছিল ঘন শাল, পিয়াল, মহুয়ার ঘন জঙ্গল। আম, জাম, বেল কাঁঠালও পথে প্রান্তরে কম ছিল না। হেথা হোথা সারি সারি তালগাছের পরিবার। ছোটবড় পুকুর পাড়ে খেজুর গাছ।
পুকুরের জলে গাছের ছায়ার আনন্দ নৃত্য।  শীতের সময় সেসব গাছে থাকত রস পাড়ার ব্যস্ততা। খেজুর শালে খেজুর গুড়ের ম ম গন্ধে ছেয়ে যেত আকাশ বাতাস। গ্রামে ছিল ছোট বড়  অনেক পুকুর। তবে বড় বাঁধ ছিল দুটি। গরমকালে সে বাঁধেই বাঁধা থাকত আমাদের মুক্ত-বিহঙ্গী শৈশব। কটা ছেলে পাড়ের চন্দ্রবিন্দু আকৃতির  বাঁকা খেজুর গাছে উঠে পাড় থেকে গামছা পরে  সেই খেজুর গাছ থেকে ঝপাং ঝপাং ঝাঁপ দিয়ে সটান জলে পড়ছে। কারো কারো গামছা গাছের খোঁচে বা হাওয়ায় খুলে গেলে সে আরেক আনন্দ। ছিল ডুব সাঁতারে জলের তল থেকে মাটি তুলে আনার প্রতিযোগিতা। জায়গায় জায়গায় জলে ঘন শালুক ফুলের নৈস্বর্গিক শোভা, পাড়ে কাক-বকের ব্যস্ততা। বাঁধের একপাড়ে বিশাল অশ্বত্থ গাছ। নীচে হাতি, ঘোড়ার দেবদেবী। জাঁকজমক করে এখানে মনসা পুজোও হত। অনেকে গাজনের ভক্তাদের মত মানত রাখতেন। তারা ঢাকের আওয়াজে মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যেতেন। বলা হত ভরম এসেছে। এই ভরম আসাটা মনে বেশ ধরত। মনসা পূজার পর বেশ কিছুদিন বাঁশ তলায় চলত এই ভরম খেলা। ঢাক বাজাতাম বাঁশের গাঁট থেকে ছাড়ানো বড় পাতার মতো খোলসকে বালির উপর রেখে।  বাগদি মেয়েরা ছোট্ট জাল দিয়ে চিংড়ি ধরছে। কেউ বা ছিপ নিয়ে বসেছে ঘাটে। 
আঙ্গুলে টোপ, গলায় গামছা, পাশে মাছ রাখার খালুই। অন্য ঘাটে মা কাকিমাদের কাপড় কাচা, গতকালের ঘটনা রিট্রিভ করা, শেষে সিনান সেরে ভিজে কাপড়ে ঘরে ফেরা। ঠিক যেমন চিত্রকরের “গাঁয়ের বধু” ছবিতে দেখা যায়। স্নান শেষে পদ্মপাতা তুলে নিয়ে গিয়ে সেই পাতায় ভাত খাবার আনন্দ সেও তো কম ছিল না।  তারই মাঝে দেখেছি প্রেম-অপ্রেমের ঠাই হৃদয়ে হৃদয়ে। ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’ এই সুরের বাঁধনে দেখেছি মন বিনিময় করতে। ঐ বয়সে আমিও বুঝতে শিখেছি সে সব। হয়তো প্রবেশনারি পিরিয়ড। দেখেছি পঞ্চদশী  পিসিমার সাথে হবু পিসেমশায়ের প্রেম। গোয়াল ঘরের ভেতর পিসি ঘুলঘুলি দিয়ে গোয়ালের ওপাশের সরু রাস্তায় দাঁড়ানো তাঁর প্রাণের মানুষটির সাথে হৃদয় বিনিময় করছে। ঘর বাঁধার জীবনস্বপ্ন। ওদিকে কত্তামা চেঁচাতেন- ও লক্ষ্মী, কতক্ষণ গুয়ালে গরুগুলাকে ছানি দিতে গেছু, এবার আয় মা। গলার নরম স্বর শুনে মনে হত কত্তামা বোধ হয় মেয়ের প্রেমের ব্যাপারে সব জানেন। হলই বা গ্রামের গেঁয়ো মানুষ, কিন্তু আর যা হোক মা তো!
(চলবে)

-----

Post a Comment

3 Comments

  1. বেশ সুন্দর লেখা। অকপট স্মৃতি চিত্র।

    ReplyDelete
  2. স্মৃতির ঝাঁপি নেড়ে চেড়ে যা উঠে এলো পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।এবারে পরবর্তীর প্রতীক্ষায় রইলাম। অভিনন্দন রইলো।

    ReplyDelete