জ্বলদর্চি

সন্দীপ কাঞ্জিলাল || পর্ব-৪


অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল  
পর্ব - ৪

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

আঁতেল মানুষ 

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি! একজন চাকুরে তার বাড়ীর কাছে ট্রান্সফারের জন্য, অফিসে দরখাস্ত করেন। একদিন রাস্তার ধারে এক বট গাছের তলায় সিঁদুর মাখানো পাথরে দরখাস্তকারী প্রণাম করছিলেন। তখনই ঐ রাস্তা দিয়ে বড় বাবু যাচ্ছিলেন। বড়বাবু ঐ চাকুরেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? কিছু না স্যার আমার ট্রান্সফারটা যাতে হয়, তাই ঠাকুরকে বলছিলাম। বড়বাবু চুপ করে চলে গেলেন। অফিসে এসে তার দরখাস্ত নাকচ করে দিলেন। ঐ চাকুরে জিজ্ঞাসা করাতে ঐ বড়বাবু বললেন, - আরে মশাই আপনি নিজেকে চালাক ভাবেন। যে আপনার ট্রান্সফার অর্ডার করবে, তাকে না বলে তৃতীয় পক্ষের কাছে তদ্বির করছেন। তাই আপনার দরখাস্ত  বাতিল করলাম। 
এরাই হচ্ছে আঁতেল, যারা নিজেকে চালাক ভাবেন। গায়ে বেশ ফুল ফুল জামা। চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা, ডান হাতে ঘড়ি। কয়েকদিন হল ঘুর ঘুর করছেন এক নেতার পেছনে। নেতাটি মাধ্যমিক। ছেলেটি এম.এ। চা বয়ে দিচ্ছে, মাথায় ছাতা ধরছে, ব্যাপারটা গুরুতর-- একটা চাকরী! নিজস্ব উদ্যোগে বাঙালির গভীর এবং আজন্ম অনীহা! মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের 'বঙ্গমাতা' কবিতা - " শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে / দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া ক'রে।" এরা এমনিতে গৃহছাড়া রাত্রে একটু শোয়ার সময় যায়। আর লক্ষী তাও সব চলে গেছে ঐ নেতার পকেটে। এরা যখন বিকেলে পার্কে জটলা করে, সবাই একমত, ব্যবসা মানে দুনম্বরি, ব্যবসায়ী মানে চোর। ব্যস খেল খতম, যেভাবে হোক একটা চাকরী চাই। এবার হাঁটতে হাঁটতে চলে আসুন পাড়ার ভেতরে, রকে। এখানে দেখবেন প্রত্যেকের গায়ে রংবেরঙের পাঞ্জাবি, নয়তো গেঞ্জি, ফুল ফুল জামা পাবেন। কারোর ডান হাত কি বাঁ হাতে যে কোনো ধাতুর একটি করে বালা। কারোর আবার এক কানে বা দু কানে সোনার বোতাম। এবার দোকান থেকে অর্ডার দেওয়া হবে লাল চা। ছয় জন থাকলে তিন কাপ চা, আর এক্সট্রা গ্লাস তিনটি। সেই তিনকাপ চাকে ছ'কাপ চা করা হবে। আর সিগারেট কেনা হবে তিনটি। জ্বলন্ত সিগারেট প্রত্যেকের হাতে একবার করে ঘুরবে। যদি সে সময় ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ চলে, তবে ভারত জিতলে একরকম আলোচনা,  আবার ভারত হারলে আর একরকম। ধরুন ভারত জিতছে তবে কথা হবে এরকম - দ্যাখ ম্যাচটা ভারত পকেটে পুরলো ঐ হার্দিক পান্ডিয়ার জন্য, শট কি রকম নিল দেখলি, আবার কেউ বলবে বুমরার বোলিংয়ের জন্য, আবার কেউ দাঁড়িয়ে তার বল ছোঁড়াটা দেখাবে। আবার কেউ কেউ পাকিস্তানের কোন ব্যাটসম্যানের নকল করবে। তারপর চলবে ভারতের দল সম্পর্কে তারিফ সূচক নানা রকম শব্দ। ভারত হারলে, এদের চলবে ভারতের দল সম্পর্কে নানা রকমের খানাতল্লাশি। আবার কেউ বলবে ঐ ক্লাবের ঐ ছেলেটা অমুকের থেকে অনেক ভালো খেলে। আবার কেউ কেউ দুহাতের কব্জিতে মোচড় লাগিয়ে তেণ্ডুলকরকে শেখাবে ঐ শট্ টা এভাবে খেলা উচিত ছিল। তবে এসব আলোচনার ভিতর কোথাও লুকানো থাকবে একটা হতাশার ছাপ! নানারকম আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত হবে, চল আজকের তিনটা বাইক নিয়ে আমরা ছ'জন রাতের কলকাতা দেখি। মিথ্যা বলছি কিনা পাঠকরা বুঝবেন। 

এবার আসুন, রাম বাজার থেকে মাছ কিনে ফিরছে। শ্যাম বাজারে যাচ্ছে। শ্যাম যদি জিজ্ঞেস করে কি রাম বাবু  বাজার থেকে এলেন? রাম 'হ্যাঁ' তো বলবেই। সঙ্গে সঙ্গে এও বলবে, এই মাছ আনলাম ২০০ টাকা করে কাটা পোনা। হয়তো রাম এনেছে ২৫০ টাকা করে। এই কথাটা বলার মধ্যে রামের নিজেকে জয়ী হওয়ার ভাব লুকিয়ে আছে। তারপর ধরুন পাড়ার একজনের একটা মেয়ে দেখতে সুন্দরী। পাড়ার অন্যান্য বৌয়েরা দুপুরে একটা গোল টেবিলে বসে ঐ মেয়েটার কাঁটাছেড়া করবে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হবে ঐ মেয়েটা বংশের মুখে কালি দিয়ে পালাবে। আসলে নিজেদের মেয়ে দেখতে ততটা সুন্দরী নয়, সেই আক্ষেপ এই কথাবার্তায় ঢাকা হবে। 
কেউ কেউ আবার ব্যাগে জায়গা থাকা সত্ত্বেও বড় একটা মাছ কিনে সাইকেলে ঝুলিয়ে ক্রিং ক্রিং বেল বাজাতে বাজাতে ফিরবে। তা দেখে কেউ বলবে ব্যাটার পয়সা হয়েছে, তাই দেখাচ্ছে। বেটার পয়সা হওয়ার ইতিহাস জানি। সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, " পরচর্চা আর পরনিন্দা শক্তিরস সালসা। দুর্বলকে সবল করে। অসুস্থকে সাময়িক সুস্থ করে তোলে।" বর্তমান কবি ও লেখকদের  মধ্যে আঁতেল  দেখতে পাবেন। এদের কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, নয়তো একটা ডায়েরি বুকের কাছে ধরা। চোখে মুখে আবার কারোর চশমার ভেতর এক বৈদগ্ধ্য। এরা কোনো কিছু পেলে জ্ঞান দিতে শুরু করে। এদের লেখায় কামুর আ্যবসার্ডিটি আর বিশ্ব মন্থন করে আনা অমৃত সুধা। কারোর আবার কবিতা অণু ছেড়ে পরমাণু। এক লাইন থেকে কবে যে একটি শব্দে কবিতা দেবী অধিষ্ঠান করবে, সে দিনের অপেক্ষায় আছি। আবার এই উঠতি কবিকুলের অনেকে কবিতাকে জটিল করে লেখে।তাদের ধারণা কবিতা যদি সবাই বুঝতে পারে, তবে কবিতা হলো না। জটিল করে না লিখলে জ্ঞানী বলে তারা প্রমাণিত হবে না।এরা আবার বলে জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' আসলে 'সুচিত্রা সেন'। এখন দেখবেন অধিকাংশ কবিতা লেখক চাকুরীজীবি। এটা সাধনা নয় অবসর বিনোদন। আজকাল দেখছি ফেসবুকে কোনো পোষ্ট করা লেখায় বানান ভুল, বানান ভুল হতেই পারে। কিন্তু সেখানে যখন ১০০র বেশি লাইক পড়ে, অথচ সেই বানান ভুল যথারীতি থেকে যায়,  যারা লাইক দেন তারা কি সত্যি পড়ে? না লাইক খাতিরে দেয়? যারা লাইক দেন তাদের কি নামকরণ করা যেতে পারে পাঠক ভাবুন। আমরা জানি অনেক রোগ দুরারোগ্য। তার মধ্যে কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধি হলো, স্ত্রী থাকতে থাকতে অন্য মহিলার প্রেমে পড়া। স্যরি প্রেম নয়, লাম্পট্য। এরা প্রথমে কথায়  বশীভূত করে। এখন সবচেয়ে সুবিধা ফোনে। দুঃখে সমব্যথী হয়। বিশেষ করে কবিতা সংশোধন আর ছাপানোর ব্যাপারে। ফোনের কথা শেষ হলে,এবার কথা বলবে বিছানা। ইংরেজ লেখক কলিন উইলসন বলেছেন, "সেক্স ইজ লাইক রাইডিং এ বাইসাইকেল।" অনেকে যারা সাইকেল একবার চালাতে শিখেছে, তারা সাইকেল দেখলে চালাতে চায়। এরা দৃষ্টি দিয়ে একটা মেয়েকে উলঙ্গ করে দেয়। এরা সব থেকে ঘোড়েল আঁতেল। এবার একটি গল্প বলি।
সেখানে দুই আঁতেলের আলোচনা মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন এই বাংলার এক মনীষী। আলোচনার বিষয় ছিল 'ব্রহ্মজ্ঞান'। দু'জনেই দাপুটে বক্তা। শীতের সন্ধে নেমেছে সবে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। তাদের ব্রহ্মজ্ঞানের ব্যাখ্যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘেমেনেয়ে উঠলেন সেই মনীষী। দু'জনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, 'এতক্ষণ যা শুনলাম তাতে আমি তৃপ্ত, মহাতৃপ্ত। আর তাই তোমাদের পুরস্কার দেব। জ্ঞানের বিচারে তোমরা দু'জনেই সমতুল্য। আকাশে ভেসে থাকা পূর্ণচন্দ্রটিই তোমাদের উপযুক্ত পুরস্কার বলে আমি মনে করি। কিন্তু যেহেতু তোমরা দু'জন, আর চাঁদ একটি - তাই আমি অর্ধচন্দ্র দিতে চাই।' এই বলে সেই মনীষী গলাধাক্কা দিলেন তাদের। এই মনীষী আর কেউ নন- বিদ্যাসাগর।
এই আঁতেলরা কোনটা যে ঠিক বোঝেন না, সেটা বুঝতে পারা মিলিয়ন ডলার ইস্যু। এরা সারা বিশ্বের থার্ড আম্পায়ার। এরা মঙ্গলযান কিভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো, সাইকেলের ব্রেক কষে তা বুঝিয়ে দেবে। 'jack of all trades'এর জ্যাকদের মধ্যে আঁতেলের গন্ধ আছে।
------

Post a Comment

0 Comments