জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন


বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন ||
পর্ব -২ 

পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞ্যা

 প্রথম তিন মিনিট ও তারপর...

সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মূর্ত না বিমূর্ত, এমন অবান্তর প্রশ্ন ― ব্রম্ভাণ্ডের উল্লেখযোগ্য মূর্খামি ব্যতীত আর কী ? কারণ তাঁর সঙ্গে কারও সশরীরে পার্থিব সাক্ষাৎ আজ পর্যন্ত ঘটেনি। অথচ পৌরাণিক লোকগাথায় তাঁর মাহাত্ম্যের যে নিদর্শন মানুষের মুখে মুখে এতকাল প্রচার হয়ে আসছে , তা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিপন্ন হয় না। ন্যূনতম একজনের সঙ্গেও তাঁর আত্মপ্রকৃতির সরাসরি সাক্ষাতের ফলে যা দৃষ্ট নয়, তা মানতে অপারগ পণ্ডিতগণ। বরং তা পূর্ব থেকে পূর্বত‍র ধর্মভীরু ব্যক্তিবর্গের আধিবাস্তব অর্ধসত্য বা অসত্য মুচমুচে খবর পরিবেশনের নমুনামাত্র।

সুতরাং সরাসরি ঈশ্বরের সংজ্ঞায় না গিয়ে কোন পরিস্থিতিতে তাঁর ভাবনা আমাদের কোমল চিত্তকে অস্থির করে তোলে অথবা কখন তাঁর অলৌকিক শক্তির স্মরণাপন্ন হয় মানুষ, সে-বিষয় বিশ্লেষণ করি। তারপর না-হয়, 'ঈশ্বর কী বা কে '- র উপসংহারে পৌঁছব।

অধিকাংশ বিজ্ঞানীই জীবনভর প্রায় নাস্তিক। কিন্তু কখনো-কখনো ক্ষণিকের জন্য মুখ ফস্কে তাঁরা ঈশ্বর সম্বন্ধে এমন সব বেফাঁস মন্তব্য করেছেন, হয়তো ভ্যাটিকানের পোপ থেকে মন্দিরের পুরোহিত― ধর্মের সব ব্যবসায়ীদের হাতে তা ঈশ্বরের প্রতিরূপ তুলে দিয়েছে। আইনস্টাইন (1879-1955) -এর কথাই ধরুন। একদা তিনি বলেছিলেন, " আমি জানতে চাই, ইচ্ছে করলেই ভগবান পারতেন কি-না বিশ্বটাকে অন্যরকম (অর্থাৎ গনিত না-মেনে, বা অন্য কোনও গনিত মেনে) ভাবে গড়তে। বিজ্ঞানী হয়েছি এই উদ্দেশ্যে। না হলে পথের ধারে মুচি কিংবা ভাটিখানার বেয়ারা হতাম।" বুঝুন ব্যাপার ! একসময় আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর অনুরক্ত নীলস বোর-এর যে বিরোধ শ্রোডিংগার, হাইজেনবার্গ আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর সূত্র ধরে ভগবানকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল, দু'জনের অবশিষ্ট জীবদ্দশায় তা আর মেটেনি। দ্বন্দ্বের কারণ কী ছিল ? ফিজিক্সের নতুন শাখা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এ অংশে কোন‌ও ঘটনা ঘটার নিশ্চয়তা নেই, কেবল সম্ভাবনা রয়েছে। এমন আজব নীতি না-পসন্দ আইনস্টাইনের। তীব্র বিরক্তিতে তিনি বলে বসলেন, " ঈশ্বর পাশা খেলেন না।" ব্যাস, তৎক্ষণাৎ জোরালো প্রতিবাদ শানালেন বিজ্ঞানী বোর (1885-1962)। জবাবে মোক্ষম শ্লেষ দিলেন আইনস্টাইনকে, " আপনাকে বলে দিতে হবে না ঈশ্বর কী করবেন, আর কী করবেন না।" শুধু এরা দু'জন নন, আরও বহু বিজ্ঞানী-জ্যোতির্বিজ্ঞানী-দার্শনিকের বক্তব্য  ধর্মভীরু মানুষের মনে ঈশ্বরের প্রতিরূপ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহস জুগিয়েছে।

খটকা লাগে, এমন কথা বারবার কেন বলেন পণ্ডিতরা? চিরাচরিত গণিতের সীমাবদ্ধতা কিংবা অন্য গণিত (যা কাঙ্ক্ষিত সমাধানের পথ দেখাবে )-এর সন্ধান না পাওয়া যদি এর কারণ হয়, তাহলে ভাবনার পরিধি অবরুদ্ধ হওয়া ও ক্ষুদ্র ক্ষমতার নিঃস্ব হয়ে যাওয়াও সম্ভাব্য অন্য কারণ। মহাভারতে অগ্নি-জাত পাঞ্চালি হস্তিনাপুরের ভরা রাজ-সভায় বস্ত্র হরণের প্রাক্কালে অনেক অনুনয় বিনয়ের শেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ নিয়েছিলেন। অর্থাৎ দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে, নিজের সমস্ত শক্তি-ষড়যন্ত্র ফুরিয়ে গেলে অসীম শক্তি (পড়ুন ঈশ্বর)-কে স্মরণ করে সকলে, সে বিজ্ঞানী হোক কিংবা মুচি।

এমনই এক বিপুল শক্তির ব্যুৎপত্তি ঘটেছিল 1370 কোটি বছর আগে, এক বিন্দুর হাত ধরে। যা 'সিঙ্গুলারিটি' নামে পরিচিত। সোজা ভাষায়, 'বিগ-ব্যাঙ' - অসীম ঘনত্ব ও উষ্ণতার একটি বিন্দু , যা একটি প্রোটনের চেয়েও ক্ষুদ্র।
এ হেন বিগ-ব্যাঙের বিস্ফোরণে এই মহাজাগতিক বিশ্বের জন্ম বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। কিন্তু ওই 'সিঙ্গুলারিটি' কীভাবে সৃষ্টি হল, কোথা থেকে এল, কতটুকু সময় সে পরিব্যাপ্ত ছিল― এমন হাজারো প্রশ্নের আজও কোন‌ও উত্তর নেই। তার একটি বড় কারণ মনে হয় : যে নিয়মে, অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, এই মহাবিশ্বের পথ চলা শুরু কিংবা যে-গণিতের সাহায্যে এর সৃষ্টিলগ্নে পৌঁছতে চায় পণ্ডিতবর্গ, সেই নিয়ম বা গণিত কোনওটাই মহাবিস্ফোরণ ক্ষণে ও তার আগে কার্যকর নয়। বিস্ফোরণের ক্ষণিক পরে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল অবস্থা তখন ব্রম্ভাণ্ডের। লক্ষ নিযূত কোটি বিকিরণের সমাহার শুধু। কোনও গনিত মানে না, নিয়মের তোয়াক্কা নেই। তাই ওই সময়কার ঘটনা-দিগন্ত অজানা থেকে যায়।
ব‍রং মহাবিস্ফোরণ ক্ষণের এক সেকেন্ডের একশো ভাগের মাত্র এক ভাগ সময় ( যখন থেকে মহাবিশ্বে গণিতের বর্তমান নিয়ম শুরু হয় বলে কনাবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গ (জন্ম - 3 May,1933)-এর ধারণা ) -এরপর থেকে ব্রম্ভাণ্ডের নাড়িনক্ষত্রের খোঁজখবর শুরু করে মানুষ। এই 0.01 সেকেন্ড সময়কে শূন্য ধরে ( কারণ এর আগে দেশ-কালের অ-গানিতিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ) মহাবিশ্বের প্রথম ধাপের পথ চলা শুরু। 
প্রথম ধাপ থেকে পরের পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত তিন মিনিট দু'সেকেন্ড সময়ে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে নবজাতক বিশ্বের। ততক্ষণে সে পদার্থ-শক্তির ঘন তরলায়িত স্যুপ-এর অবস্থা থেকে প্রথমে হালকা, পরে ভারী কণিকার জন্ম দিতে চলেছে ; তার আয়তন অবিশ্বাস্য হারে ( বিজ্ঞানী অ্যালান গুথ (জন্ম: 27 Feb,1947)-এর মতানুসারে - এক সেকেন্ডের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ 10^30 গুন ) বেড়েছে, তাপমাত্রা আয়তনের ব্যস্ত অনুপাতে দ্রুত গতিতে ( মহাবিস্ফোরণ ক্ষনের 10^(-43) সেকেন্ড পরে সর্বোচ্চ উষ্ণতা 10^32 °K ধরলে পরের 3 মিনিট 2.01 সেকেন্ড সময়ে তাপমাত্রা কমে হয়েছে 10^9 ডিগ্রি কেলভিন) কমছে। ঐ প্রথম তিন মিনিটে ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি রহস্যের নেপথ্যে থাকা গণিতকে নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী বিবর্তনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন― যে গণিতের সূত্র ধরে পণ্ডিতগণ মহাবিস্ফোরণের আদি লগ্নে পৌঁছনোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, মাইক্রোত‍রঙ্গ পটভূমি বিকিরণের পশ্চাদ-গণনার মাধ্যমে ; এমনই ধারণা মহাকাশ বিজ্ঞানী, তাত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং (1942-2018)-এর।
সুতরাং, মহাবিস্ফোরণই কি বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় চিহ্ন , যা থেকে ব্রম্ভাণ্ডের সমস্ত শক্তির উৎপত্তি এবং তাকেই মানুষ মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায়-ধর্মস্থানে শক্তিরূপে আরাধনা করে ? প্রিয় পাঠক, বিচার করুন ।
----------

Post a Comment

2 Comments

  1. আমি পড়বার জন্য অপেক্ষায় রইলাম l

    ReplyDelete
  2. মহাবিস্ফোরণের ক্ষণিক পরবর্তী বিশৃঙ্খল আবহ, বিকীর্ণ কণা যা নাকি অগাণিতিক,তার ক্রমাগত পর্যায়ক্রমিক স্হিতিশীলতা, সর্বোপরি বিস্ফোরণের কারন, আর সেখানেই হয়তো সৃষ্টির তথা ঈশ্বরের অস্তিত্ব। আজও এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি স্হিতিশীল? বিজ্ঞান অথবা ঈশ্বর, কি বা কে দেবে এর উত্তর?

    ReplyDelete