সেমিকোলনের আত্মজীবনী || পর্ব - ১
সা য় ন
একটি ক্ষুধার্ত পোড়া ভারতবর্ষের নাম : কাল্লু
একহাতে তলোয়ার নিয়ে ছুটে আসছে একটা ছেলে, রাস্তার অন্যপ্রান্তে ঘরের পর ঘর জ্বলে উঠছে দাউ দাউ করে আগুন। ওপারে দেখছি " প্রত্যেকের পরনে খাকি হাফ প্যান্ট। মাথায় বাঁধা গেরুয়া কাপড়ের হেডব্যান্ড, কিংবা কোমরে গামছার মতো বাঁধা গেরুয়া কাপড়। প্রত্যেকে অত্যাধুনিক বিস্ফোরক উপকরণ বহন করছে।" বারুদমাটিতে দাঁডিযে় আছেন অসহায় একজন কবি - হাতে খাতা নিয়ে লিখছেন বুলেটবিদ্ধ ইতিহাসের ছন্দ । আমি সেই কবিতা পড়ছি ভাইরাস ও ক্ষুধার্ত দেশে বসে। তার চোখের জল অ্যাসিড হয়ে যাচ্ছে - এক ফোঁটা এক ফোঁটা জ্বলন্ত বিন্দু থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দ - " মানুষ পোড়ানো মানুষ দেখতে আসে/ এবার যেভাবে খরচ হয়েছে তেল/ কখনো হয়নি ভারতের ইতিহাসে।" (পোড়া মানুষ)
সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সুবোধ সরকার, আমার হাতে তার কবিতার বই - 'কাল্লু'।
আমাদের ঘিরে ধরেছে একটা দল যাদের "প্রত্যেকটা মুখ আগুন, প্রত্যেকটা মুখ মদ / প্রত্যেকটা মুখ খুন।" (কাল্লু) ২০০২ সাল থেকে এই গুন্ডা র দল তাড়া করছে সংবিধান, তাড়া করছে গণতন্ত্র । ভারতবর্ষের পেট থেকে এমন একটা ভারতবর্ষ বেরিয়ে এল - যে আজ ২০২০তে ১৮ বছরের অমানবিক দুঃসহ হন্তারক হয়ে উঠেছে। তার সংক্রমণ ও হিংসাত্মক যৌবন খুরে কাটা লকডাউনের পলে অনুপলে অনুভব করছি।
একটি মেয়ে আমার কলার চেপে ধরে বলল " হিন্দু ভারত, জৈন ভারত, বৌদ্ধ ভারত,খ্রিস্টান ভারত/আপনারা বলতে পারেন আমি কী দোষ করেছি?" (আমি ফিরোজা,একটি ভারতীয় মেয়ে)
ফিরোজা তুমি!
- হ্যাঁ , আমি সেই ফিরোজা যে আজ তোমার ভারতবর্ষের রাস্তায় রাস্তায় পরিযায়ী মা হয়ে হাঁটছে - তার গর্ভে কিংবা সুটকেসের উপর ঘুমিয়ে পরেছে মৃতপ্রায় সন্তান।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, নৈঃশব্দ চিৎকার করে ওঠে " কোথায় ছুঁবি , কোথায় দিবি হাত! /আমার বুক শূন্য খাঁ খাঁ রাত।" (পোড়া ছেলের মা)
ছুটন্ত পা'য়ের কান্না :
আমি আবার ছুটতে ছুটতে এসে পৌছলাম আবার কবির সামনে। প্রশ্ন ছিটকে এল -"ভাই খুঁজে বেড়াচ্ছে ভাইকে। মা বসে আছে ভাত নিয়ে । ছেলে এই আসছে বলে বেরিয়েছিল। বাবা নদী ধরে হাঁটতে হাঁটতে গোধূলিতে পৌঁছে শুনতে পেলেন পাখির ডাক। পাখির ডাক নাকি তাঁর পুড়ে যাওয়া বালক পুত্রের কন্ঠ?" ('কাল্লু' ভূমিকা, সুবোধ সরকার)
এই কবিতাগুলো আগুন দিয়ে, পেট্রোল দিয়ে, ব্লেড দিয়ে, ধর্ষিত নারীর কান্না দিয়ে, পুড়ে যাওয়া দেহের কয়লা দিয়ে, ত্রিশূল দিয়ে, কোরান পোড়ানো, উপনিষদ পোড়ানো আগুন দিয়ে, মর্গে ঢুকে যাওয়া সনাক্তহীন লাশ, গুজরাট আমেদাবাদের শত শত নারীর কাটা স্তন দিয়ে, চোখে ঠুলি পরা মানবাধিকার কমিশন নিয়ে একটা একটা ইতিহাসের ছবি লেখা যায়! ইতিহাস বইয়ের এত সাহস হবে না একজন টেররিস্টের প্রেমপত্র ছাপার - " ওদের তো পুরোপুরি শেষ করে দেওয়া যায় না,ওরা/আবার জন্মায় ,আবার গণতন্ত্র বানায়,আবার পার্লামেন্টে /যায়। আবার প্রেস মিট করে। একটা সত্য কথা লিখি,/ ওরা গণতন্ত্র দিয়ে যা যা করায় , আমরাও AK- 47 কে/দিয়ে তাই তাই করাই। ওদেরটা দোষ নয়, আমাদেরটা দোষ।" (একজন টেররিস্টের চিঠি)
দেশ জ্বালিয়ে ওরা তখনও প্রেসমিট করেছিল , ওরা এখনও প্রেস মিট করছে যখন ভাইরাসে মরে যাচ্ছে দেশ- ক্ষুধার ভাইরাসে, কর্মসংস্থানহীন ভাইরাসে, সামাজিক দূরত্বের ভাইরাসে।
"প্রধানমন্ত্রীজি" উবাচ :
নিরাপদে যেন ঘরের মধ্যে থাকি, দূরত্ব মেনে চলতে চলতে ২০০০ থেকে ২০২০ তে চলে এলাম। কুড়ি বছর ধরে কবিতার ৬৪ পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে শুনতে পাচ্ছি মানুষের আর্ত হৃৎপিণ্ড বলছে - " যে সব ছেলেরা স্কুলে ও কলেজে পড়ে/যে সব ছেলেরা শান্তির গান গায়/বাঁচাও তাদের উপমহাদেশ জুড়ে/ লাহোরে ঢাকায় লুধিযা়না আগ্রায়।" (বাবা)
তার বিনিময়ে এমন একটা সরলরেখা তৈরি করলাম যার একপ্রান্তে দাঙ্গায় কাটা হাত পা মাথা আর অন্য প্রান্তে COVID-19 সংক্রমণ। এই সরলরেখাটার নাম জনগণ । এর কেন্দ্রে "মশারি টাঙিয়ে" উনি " বসে আছেন , হাঁটু ধরে/ হাঁটু ছাড়া আর কোথাও আপনার কোনও ব্যথা নেই।/কাটা হাত এগিয়ে এসে আপনাকে এক গ্লাস জল দিল/সঙ্গে একটা ট্যাবলেট /আপনি তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন।" (প্রধানমন্ত্রীজি)
শুকনো পেটের কান্না:
১৮ বছর এই বই হাতে কবি এ-গলি ও-গলি একটা চোঙ হাতে চিৎকার করতে করতে বলছেন - " আসলে ধর্ম এখানে একটা অজুহাত। ধর্মের কাঁধে বন্দুক রেখে পুরুষ ফায়ার করছে কার গুলি? গুলি নয় কাম ও ক্রোধভরতি একটা ক্যাপসুল,.." ('আমার কবিতা, আমার জীবন' , সুবোধ সরকার)
বন্দুকে আজ ধর্মের বুলেট শুধু নয়, ভাইরাসও এসে গেছে। সেই বুলেটের ঘাযে় রক্তাক্ত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন NRC আন্দোলন, দলিত আন্দোলন, সংগঠন, মিছিল, প্রতিবাদ। মানুষের এই দূরত্বের ভবিতব্য কাঁধে আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখছি প্রতিফলকে ভেসে উঠছে কাল্লুর দেহ , যে প্রতিটা আয়না ভাঙতে ভাঙতে আজও "... আবার দৌড়, দৌড়, দৌড়/ কাল্লু কোথায় যাবে জানে না/ কাল্লু কি খাবে, জানে না/ কাল্লু কী খাওয়াবে তাও জানে না/ শুধু জানে তাকে দৌড়তে হবে" (কাল্লু)
ইতিহাসের ছন্দ বেঁধে সুবোধ সরকার তার ব্যক্তিজীবন ও সৃষ্টিজীবনের ভিত গেঁথেছেন। এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে চলমান হাইওয়ে - সেই জীবনে অনুসন্ধিৎসাকে অক্ষুণ্ণ রাখাই মানুষের সবচেয়ে বড় দায়। ভারত সরকারের IAS অফিসার হর্ষ মান্দারের ক্ষোভ , দুঃখ কিভাবে যেন কবির দুঃখ হয়ে যায়, কবির দুঃখ হয়ে যায় পাঠকের - সর্বোপরি হয়ে ওঠে সময় ও রাষ্ট্র সংকটের দুঃখ।
গুজরাট দাঙ্গা থেকে আজকের পৃথিবীব্যাপী মানুষ হর্ষ মান্দারের মতোই ভেবেছি, ভাবছি - " রাজনৈতিক নেতাদের অভিসন্ধি যাই হোক, আইনের নির্দেশ ছিল নিরপেক্ষভাবে অকুতোভযে় পক্ষপাতহীন নির্দেশাত্মক সাহস আর সহমর্মিতার সক্রিয় ভূমিকা পালনের" কিংবা " মৃত্যুরও তো কিছু সম্ভ্রমের দাবি থাকে। শবদেহে পরিণত হবার আগে পর্যন্ত থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় , নিজের জীবন আর বেঁচে থাকার আকুতি।" ('আপনাদের শুনতেই হবে', হর্ষ মান্দার)
শব্দেরা কেঁদে ফেলে :
যে রাস্তায় একদিন জ্বলন্ত দেহগুলো পড়েছিল সেই রাস্তায় আজ পড়ে আছে না খেতে পাওয়া মানুষগুলো। রাষ্ট্র পচাকুকুরের মতো তাদের স্যনিটাইজার দিয়ে স্বচ্ছ ও স্বাস্থবান ভারত বানাচ্ছে। আর আমি , আপনি, আপনারা সবাই এক একটা মাস্ক পড়ে দরজা জানলা বন্ধ করে বারান্দায় ঘটি বাটি বাজাচ্ছি। এর মাঝে হঠাৎ এক বিপজ্জনক কবির কটা পৃষ্ঠা উড়ে এল, সেখানে লেখা - কে বা কারা ঘটায় , কারা ভাইরসের থেকেও বিষাক্ত - " পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চাযে়র কাপে চুমুক দিয়ে টেলিফোনে বললেন: / 'ইহুদিদের ইজরাইলে ঢুকতে দেবেন না' /আমি সেই লোকটাকে চিনি। / যে লোকটা গঙ্গা ও বল্লমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলেছিল: ' ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বাবরি মসজিদ ভাঙতে হবে' /আমি সেই লোকটাকে চিনি।" (সেই সাংঘাতিক লোকটা)
ভণ্ডদের ভাষণ শুনে মোমের আলো জ্বালতে বেশ ভালো লাগে , মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলে যারা তাদের প্রশ্ন করতে একদম ভালো লাগে না বলুন ? আঙুল তুলে আর বলবেন কবে - " আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারিনি বলে /এই ছেলেটাকে বাঁচাবই, বাঁচাবই/ ঘটি বাটি সব যায় যদি যাক চলে/ এই রাষ্ট্রের আমি নাগরিক নই?" (আমি হর্ষ মান্দার বলছি)
1 Comments
বেশ ভালো
ReplyDelete