জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২

শ্যা ম ল  জা না


ইজম-এর জন্ম 

আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে ইম্প্রেশনিজমই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ৷ মুশকিল হচ্ছে, ইম্প্রেশনিজম বলার আগে ইজম কাকে বলে, সেই আলোচনা খানিকটা হওয়া দরকার৷ হঠাৎ করে ইজম-এর যে জন্ম হয়নি, এ কথা বলাই বাহুল্য৷ দীর্ঘ দিনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, আধুনিকতার ফলস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট অবস্থার(Condition)প্রেক্ষিতে, বাধ্যতামূলকভাবে একটি ইজম, বা পরপর এক-একটি ইজম জন্ম নেয়, সে কেউ চান বা না চান৷ Ism-এর বাংলা মানে হল— মতবাদ৷ বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা দল দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ থেকে নির্দিষ্ট কোনো একটি অবস্থার(Condition) প্রেক্ষিতে যখন কোনো ঐতিহ্যকে(Tradition) ভেঙে নতুন কোনো সময়োপযোগী সঠিক দর্শন তথা পদ্ধতির জন্ম দেয়, এবং তার সঠিক প্রয়োগও করে, তখন সেই নির্দিষ্ট দর্শন তথা পদ্ধতির একটি নামকরণ হয়৷ ওই নামকরণটির নাম মতবাদ৷ তখন, ওই মতবাদের সঙ্গে সেই ব্যক্তি বা দলটির বা ওই নির্দিষ্ট দর্শনটির নাম যুক্ত হয়ে যায়৷ এইভাবে সময় পরম্পরায়, মূলত আধুনিক চিত্রকলার শুরু থেকে একটার পর একটা ইজম-এর জন্ম হয়েছে; যার প্রথমটির নাম—ইম্প্রেশনিজম৷

ইম্প্রেশনিজম-এর জন্ম

মূলত দুটি কন্ডিশনের ভিত্তিতে ইম্প্রেশনিজম-এর জন্ম৷ ১. ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভেলিউশন বা শিল্প বিপ্লব৷ ২. ফোটোগ্রাফ আবিষ্কার৷

১৭৬০ সালে শুরু হলেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভেলিউশন-এর শীর্ষ সময় ১৮৪০ সাল, যখন তৃতীয় নেপোলিয়ান প্যারিসকে নতুনভাবে তৈরি করছে৷ এই সময়ের আগে, দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে যে অপরিহার্য জিনিস(Essential Commodity), সেগুলির বাইরে মানুষের আর কিছু চাহিদা ছিল না৷ একটা আস্তানা, পোশাক, খাবার, আর শোয়ার জায়গা৷ সম্পত্তি বলতে জমি৷ যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিলাস ও বাহুল্য প্রবেশ করল, এসেনশিয়াল কমোডিটির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করল৷ কল-কারখানার বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিকের সংখ্যাও হু হু করে বাড়তে শুরু করল৷ কারখানায় হাজিরা দেওয়া ও ছুটির সময় নির্দিষ্ট হল৷ এই প্রথম মানুষ সময় ধরে চলতে শুরু করল৷ তার মূল্য বুঝতে শুরু করল৷ এর আগে মানুষ সময় ধরে কোনো কাজ করেনি৷ এই সময় ধরে চলার বিষয়টি এক সময় সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল৷ চিত্রশিল্পীদের ক্ষেত্রেও৷ আগে একটা পেন্টিং করতে তিন-চার বছর পর্যন্ত লেগে যেত৷ এখন কিন্তু তা করা যাচ্ছে না৷ ছবি এঁকে রোজগার করতে হলে, কম সময়ে যত বেশি আঁকবে, ততই লাভ হবে৷

দ্বিতীয়ত— একেবারে ঠিক এই সময়েই আধুনিক ফোটোগ্রাফির চর্চাও শুরু হয়ে গেছিল৷ এবং ফোটোগ্রফাররা নিশ্চিতও হয়ে গেছিল যে, ফোটোগ্রাফির মূল উপাদান আলো৷ শেষমেশ ১৮২০ সালে তাঁরা স্বীকৃতি পেলেন৷ অফিশিয়ালি জানানো হল— Art and science had finally found a way of creating an image on a material using light, chemicals and the camera obscura would have affected the very psychology of painting. এরপর থেকেই ফোটোগ্রাফ শিল্পের পর্যায়ে উন্নিত হতে থাকল৷ একটি বস্তুর ইমেজকে কত ডিটেইল-এ ধরা যায়, শুধুমাত্র সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না৷ কারণ, ইতিমধ্যে তাঁরা বুঝতে পেরে গেছেন— একটা বস্তুর ওপর যে আলো পড়ে, সেই আলোর উংস যদি পাল্টে পাল্টে যায়, তাহলে, সেই বস্তু সম্পর্কে উপলব্ধিও আমাদের পাল্টে পাল্টে যাবে৷ এবং এই পাল্টে যাওয়াটা সীমাহীন৷ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, একজন মানুষকে মডেলের মতো বসিয়ে, তার ওপর নানা ধরনের আলো, নানা উৎস থেকে ফেলে ফোটোগ্রাফাররা পরীক্ষা-নিরিক্ষা শুরু করেছিলেন— সেই মানুষটির শুধুমাত্র ডিটেইল ইমেজ নয়, সেইসঙ্গে তার স্বভাব, চরিত্র, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি কত সঠিকভাবে বের করে আনা যায়, তার চর্চা করা! আর, এই চর্চা করতে করতেই তাঁরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করলেন— আলোর উৎস যদি পাল্টে পাল্টে যায়, তাহলে একজন মানুষের স্বভাব, চরিত্র, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি ইত্যাদিও পাল্টে পাল্টে যাবে(ছবি-১ ও ছবি-২)৷ 


তাহলে, প্রথমত— ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভেলিউশন-এর পর যে সময়ের মূল্য তৈরি হল, এবং দ্বিতীয়ত— ফোটোগ্রাফারদের আলোকে কেন্দ্র করে যে নতুন দর্শন— এই দুটো মিলিয়ে চিত্রশিল্পীদের আলাদা করে ভাবতে বাধ্য করল যে— শুধুমাত্র কত ডিটেইলে ছবিটা আঁকলাম, সেই দক্ষতার স্তরে আটকে থাকলে চলবে না৷ শুধুমাত্র হাতের দক্ষতার দিন শেষ! চিত্রশিল্পে নতুন কিছু না করলে অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে! এবং সত্যই অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছিল! তৎকালীন চিত্রশিল্পীদের একাংশ, যাঁরা ক্যানভাসে মিনিয়েচার পোট্রেট এঁকে জীবিকানির্বাহ করতেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়লেন ফোটোগ্রাফ আসার পর! এই সংকট থেকেই একটি ইজম-এর জন্ম হল৷ নাম— ইম্প্রেশনিজম৷ (ক্রমশ)


--------


Post a Comment

4 Comments

  1. পড়ছি। গুরুত্বকে সহকারে। বিবর্তন নিয়ে শ্যামল জানার গবষণালব্ধ এই লেখা উৎসাহী পাঠককে ঋদ্ধ করবে নির্দেশেই বলা যায়। দারুণ লাগলো Impressionism এই যাবার আগে ইজম্ সৃষ্টির ব্যাখ্যা অনবদ্য।শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  2. গবেষণালব্ধ
    নির্দিধায়
    দুটি ভুল ঠিক করে পড়বেন।

    ReplyDelete
  3. Jinich he bishoye oiswaryoban tini sobtheke Soho bishoyti bojhate paren.pandityo noy eta gman.

    ReplyDelete
  4. ছবির দর্শনানুভূতি আলাদা। শিল্পী শ্যামল জানা কে কৃতজ্ঞতা। অত্যন্ত ভালো লাগছে / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete