জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল || পর্ব - ৫



অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল 
পর্ব -৫

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল  

বুদ্ধি যদি নদী হয়, জ্ঞান মহাসাগর

জ্ঞান ও বুদ্ধিকে একই শব্দ মনে করে একত্রে গুলিয়ে ফেলেন এমন লোকের সংখ্যা আমাদের সমাজে নেহাৎ কম নয়। অনেকে আবার জ্ঞানকে বুদ্ধি মনে করে নিজের বুদ্ধির বহর প্রমাণের জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করে থাকেন। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক রয়েছেন যারা মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তাকে জ্ঞান মনে করেন এবং তাদের আশেপাশের লোকজনকে উঠতে বসতে জ্ঞান দান করে অনেকের জীবন ঝালাপালা করে ফেলেন। জ্ঞান-বুদ্ধির বাইরে মানুষের আরও একটি অতিন্দ্রিয় মহাক্ষমতার নাম প্রজ্ঞা, যার মাধ্যমে সে সত্যিকার অর্থে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পৃথিবীর বুকে নিজেকে অমর করে রাখার সুযোগ লাভ করে। প্রতিটি কারণে কেউ হতে পারেন সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মানুষ কিংবা অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী মহামানব। 

জ্ঞান বুদ্ধি অর্থ এই তিনটির মধ্যে জ্ঞানার্জন হলো সবচেয়ে শ্রমসাধ্য এবং জ্ঞানকে সংরক্ষণ করা সত্যিকার অর্থেই কঠিন ও দুঃসাধ্য বিষয়। তাই আমাদের সমাজে প্রকৃত জ্ঞানীর সংখ্যা যেমন কম, তেমনি জ্ঞানভিত্তিক জীবন যাপন করা লোকের সংখ্যা আরো কম। জ্ঞান ছাড়া বুদ্ধির কোনো গুরুত্ব নেই। আবার বুদ্ধি ছাড়া কোনো জ্ঞানই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। জ্ঞান বেঁচে থাকার রসদ পায় বুদ্ধি থেকে। বুদ্ধির যদি বদহজম হয় তখন বুদ্ধিমান মানুষ জ্ঞানগরিমা থেকে দূরে সরে গিয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আবার কম বুদ্ধির লোক যদি কোনো উপায়ে অধিক জ্ঞনার্জন করে ফেলে, তবে সেই জ্ঞান ওই ব্যক্তির মাথায় বদহজমের প্রতিক্রিয়া ঘটাতে থাকে। কারণ কোনও কোনও বিষয়ে অজ্ঞ হওয়ার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই, কিন্তু যা জানি না, তা জানি বলে প্রমাণ করার চেষ্টা ভয়ংকর। জ্ঞান আর বুদ্ধি একই পাত্রের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে থাকবে। প্রয়োজনে পরিমাপ মত মেশাতে হবে। যদি একই পাত্রে সবসময় রাখা হয়, তা হয়ে উঠবে মারাত্মক। যেমন  চিনি যদি জ্ঞান হয়, আর বুদ্ধি যদি গুড়--তবে আলাদা না রেখে যদি এক জায়গায় মিশিয়ে ফেলা হয়, তবে তা গাঁজিয়ে মোদো হয়ে যায়। তা একটি নেশার বস্তু হয়ে ওঠে। এমনকি যে পাত্রে থাকে সেটি ফাটিয়ে দেয়।যদি মানুষের মধ্যে থাকে মানুষকে নেশাগ্রস্ত এবং বলবান করে তোলে। যে বল তার শরীরের স্বাভাবিক বল নয়। তখন সে পাগলের মতো আচরণ করে। এই সমস্ত লোকেরা লাভের পেছনে ছোটে। সে লাভ আর্থিক হতে পারে, আবার মানসম্মান যশের হতেও পারে। এরা সমাজ সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে ভীষণ দক্ষ। এধরনের লোকেরা নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে। এমনকি উপকারী বন্ধুবান্ধব পিতা মাতা আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে আপন স্ত্রী পুত্র কন্যাদের সর্বনাশ করতেও পিছপা হয় না। যেহেতু এরা বুদ্ধিমান, সেহেতু তারা সহজে পরিবেশ পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পারে, তাই তারা বক্তা হলে গলার স্বর পরিবর্তন করে মুখরোচক বক্তব্য বলে, আবার আপন স্বার্থমতো ক্ষমতার কাছে নিজেদের উপাদেয় ও অপরিহার্য করে তোলার এক চেষ্টা চালায়। 
বুদ্ধি ছাড়া জ্ঞানের যেমন কোনো মূল্যই নেই, তেমন শিক্ষারও মূল্য নেই। সাধারণ বুদ্ধির অর্থ বাস্তব অবস্থাকে অনুধাবন করা, এবং সেই অনুসারে যেভাবে কাজ করা উচিত, সেই ভাবে কাজ করা। আমাদের জন্মের সময় পাঁচটি ইন্দ্রিয় থাকে - স্পর্শ, স্বাদ, দৃষ্টি, ঘ্রাণ ও শ্রুতি। পরবর্তীকালে আর একটি ইন্দ্রিয় যোগ হয় - সাধারণ বুদ্ধি! সাধারণ বুদ্ধি কিন্তু শিক্ষার উপর নির্ভর করে না। পৃথিবীতে যত অস্ত্র আছে, তার মধ্যে বুদ্ধি সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র। তাই এই বুদ্ধিকেও মাঝে মাঝে শাণিত করতে হয়।

যেমন, এক কাঠুরে এক মালিকের কাছে সাত বৎসর কাজ করার পরও তার মাইনে বাড়েনি, কিন্তু এক নতুন কাঠুরে কাজে যোগ দিয়ে দু' মাস পরে তার বেতন বেড়ে যায়। তখন প্রথম কাঠুরে তার মালিককে বলল,- আমার বেতন বাড়লো না, অথচ সে দু' মাস কাজ করতে না করতে বেতন বেড়ে গেল। মালিক তখন বলল, তুমি দ্বিতীয় কাঠুরের কাছে জেনে নাও কেন তার বেতন বেড়েছে। প্রথম শ্রমিক দ্বিতীয় শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, সে তার থেকে বেশি কাঠ কাটে কম সময়ে। কারণ হিসাবে বলল, প্রত্যেকবার একটি গাছ কাটার পর সে কুড়ুলে শান দেয়। তাই কম সময়ে কম পরিশ্রমে সে বেশি কাঠ কাটতে পারে। তাই সফল হতে গেলে প্রত্যেকবার তোমাকে কুড়ুলে শান দিতেই হবে। আমাদের শরীরে যেমন ভালো খাদ্যবস্তুর প্রয়োজন, তাই বুদ্ধির উন্নতির জন্য সৎ চিন্তা দরকার।
জ্ঞানের প্রাথমিক পরিচয় হলো- বুদ্ধির অধিক্ষেত্র যেখানে শেষ হয় ঠিক সেখানেই জ্ঞানের শুরু হয়। জ্ঞানের সঙ্গে প্রায়ই বস্তুর সংযোগ থাকে না। অতীন্দ্রিয়  এবং অপার্থিব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে জ্ঞানীরা যে সূত্র রচনা করেন কিংবা তথ্য দেন তার ওপর গবেষণা চালিয়ে বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞানীরা নানান কর্মযজ্ঞ করে থাকেন। আ্যলবার্ট আইনস্টাইন, নিউটন প্রমুখ মহাজ্ঞানী কর্তৃক উদ্ভাবিত সূত্র যেমন আধুনিক সভ্যতার অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সূচনা করেছে তেমন সক্রেটিস, আ্যরিস্টটল, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখ দার্শনিকের চিন্তার ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর অনেক দেশে নিত্যনতুন সভ্যতার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হোমার, শেকসপিয়র, কালিদাস কিংবা ঋষি বেদব্যাসের মতো মহাজ্ঞানীর কারণেই তামাম দুনিয়ার বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মযজ্ঞ অবিরতভাবে চলছে এবং আগামী দিনেও চলবে বিদ্যার্থীদের বিদ্যা অর্জনের অধিক্ষেত্ররুপে।

এই বুদ্ধি হচ্ছে জ্ঞানের উৎস। জ্ঞান হচ্ছে শুভ কাজের সরবরাহকারী। জ্ঞানঅর্জন খাদ্য গ্রহণের মতো কতটা খাওয়া হচ্ছে তার উপর স্বাস্থ্য নির্ভর করে না-- কতটা হজম হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। বুদ্ধির বলে তুমি সম্পদশালী হতে পারো! কিন্তু জীবনে  সুখ না মিলতে পারে। জীবনে সুখ নির্ভর করে, জীবনে জ্ঞনার্জনের পথে বাধা তুমি কতটা দূর করতে পেরেছো তার উপর। তোমার অধিকারে থাকা সম্পদের উপর নয়। তাই বুদ্ধি যদি নদী হয়, জ্ঞান মহাসাগর।

-------

Post a Comment

1 Comments