মেদিনীপুরের যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের কথা
ভা স্ক র ব্র ত প তি
মেদিনীপুরের মানুষ সংস্কৃতিবান। চিরায়ত সংস্কৃতির পীঠস্থান এই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় (পূর্ব, পশ্চিম ও ঝাড়গ্রাম ) স্বাভাবিকভাবে ঠাঁই পেয়েছে যাত্রা, নাটক, থিয়েটারও। বর্তমানে যাত্রার একটা বৃহত্তম মার্কেট তৈরি হয়েছে জেলায়। জেলার নন্দকুমার ও বেলদাকে বলা হয় 'মেদিনীপুরের চিৎপুর'। এছাড়া প্রায় প্রতিটি গঞ্জতে স্থানীয় উদ্যোগে যাত্রার প্রতি গভীর ভালােবাসা গড়ে উঠেছে। কিন্তু, গত ৯-১০ বছর ধরে এক 'সোপ সিরিয়াল' বিষয়ক চটুল এবং সস্তার সংস্কৃতির বৃদ্ধিতে যাত্রা সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে। যুবমানসে যাত্রা নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল, তা স্তিমিত হতে শুরু করেছে। সেই ষাটের দশকে জেলার যাত্রাশিল্পের চাহিদা বাড়ায় অন্নসংস্থানের যে পথ প্রশস্ত হয়েছিল ইদানিং অবশ্য অনেকটাই হতাশাজনক অবস্থায়। আঞ্চলিক ক্লাব, গ্রাম কমিটি, বিদ্যালয় কিংবা পেশাদার যাত্রাপার্টি আজ যাত্রাশিল্প থেকে চরম বিমুখ হয়ে উঠেছে। মাথা কুঁড়ে মরছে যাত্রা জগতের সাথে সম্পৃক্ত মানুষজন।
যাঁরা কলকাতা বা শহরতলীর পেশাদার যাত্রাদল বায়না করে থাকেন তাঁদের যাত্রার পরিভাষায় বলা হয় 'নায়েকবন্ধু'। যাত্রার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে এই 'নায়েকবন্ধু' বৃদ্ধি আশাতীতভাবে বেড়েছে জেলায়। বেড়েছে বুকিং এজেন্ট এবং বুকিং এজেন্ট সেন্টারও ( গদিঘর )। যাত্রাশিল্পে মেদিনীপুর জেলা কলকাতা বাদে রাজ্যের অন্যান্য জেলার মধ্যে প্রথম দিকে অবস্থান করে। এই মুহূর্তে বেলদাতে মোট ২৬ টি গদিঘর রয়েছে। এঁদের মাধ্যমে বুকিং হয় সব দলের। এরমধ্যে ৫-৬ টি দল ভালো চলে। দুটো করে যাত্রা আছে এরকম দলও রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে আছে মোট ৫৮ টি যাত্রাদল। নন্দকুমারের গদিঘর থেকে বুকিং হয় ৩৪ টি যাত্রাদল। এইসব দলের কলকাতাতেও রয়েছে বুকিং সেন্টার। বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী তিন মেদিনীপুর মিলিয়ে ছোট-বড় যাত্রাদলের সংখ্যা ২৭৬ টি। সুদূর অতীতে বেলদাতে গড়ে উঠেছিল 'শিল্পীচক্র' নামে নাট্যদল। তারপর ধীরে ধীরে এখানে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে অসংখ্য যাত্রাদল।
নন্দকুমারে রয়েছে বিষ্ণুলোক অপেরা, অগ্নিবীণা অপেরা, স্টার অপেরা, উমা অপেরা, বনমালী অপেরা, নাগ কোম্পানি, দেবীপল্লী যাত্রা সমাজ, যাত্রা নিকেতন ইত্যাদি নামকরা যাত্রাদল। তেমনি বেলদাতেও আছে উদয়ভানু জানার 'কল্পতরু অপেরা'সহ আরও অনেক যাত্রাদল। বাংলা ভাষার যাত্রাদল ছাড়াও ওড়িয়া যাত্রা ও আদিবাসী যাত্রার দল এবং চল রয়েছে সমগ্র মেদিনীপুর জুড়েই। এমনকি পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও ঝাড়খন্ডেও অভিনীত হয় আদিবাসী যাত্রাপালা। আদিবাসী যাত্রাশিল্পে এক অতি উজ্জ্বল নাম দুর্গাপ্রসাদ হেমরম। কেশিয়াড়ির এই মানুষটি ১৯৯০ থেকে পালা লেখা শুরু করেছেন। 'মারে পটম জজ' ছদ্মনামে এখনও পর্যন্ত লিখেছেন ৪০ টি পালা। এগুলোর মধ্যে 'সেঙ্গেল লেকান কুড়ি বঙ্গাঁ ক জমেকান', 'আম ক জাঁওয়ায় মেরে গাতে খবর আঞ মে' খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
একসময় পশ্চিম মেদিনীপুরের রাধামােহনপুরের মাধবী দত্ত অভিনয় করতেন নট্ট কোম্পানীতে। কলকাতার বিভিন্ন যাত্রাদলে নায়কের চরিত্রে এখনও অভিনয় করেন পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরীর কুমার কৌশিক। সুদর্শন এই নায়ক দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত নাম। ঘাটালের প্রহ্লাদ ঋষি ছিলেন যাত্রার সুরকার। ২০১১ তে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর চিৎপুরে বেশ কয়েকটি যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয় যার মূল বিষয় ছিল মমতা ব্যানার্জী। এমনই একটি পালা 'বাংলার ক্ষমতায় এবার মমতা'তে মমতা ব্যানার্জীর চরিত্রে অভিনয় করেন রুমা চক্রবর্তী। তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের মানুষ।
নারায়নগড়ের নিমা গ্রামের ঝর্ণা পাত্র প্রথম শুরু করেন বেলদার শীতলা অপেরায় 'বনপলাশীর পদাবলী' ও শিল্পীচক্র অপেরার 'সৈনিক' পালাতে। এরপর নায়িকার ছেলেবেলার চরিত্রে কলকাতার 'শিল্পীতীর্থ' তে অভিনয় করতেন। অবশেষে নট্ট কোম্পানি, আর্য অপেরা, অগ্রগামী, শান্তিনিকেতন অপেরাতে অভিনয় করেছেন মেদিনীপুরের এই মেয়ে। বিশেষ বিশেষ পালাগুলি হোলো শকুনির পাশা, কৃষ্ণ ভগবান, পালকি চলে রে, বরণীয়া বধূ, বাদশাজাদি জাহানারা, সীতা বিসর্জন, বসন্ত বাহার, প্রেমের প্রতিদান ইত্যাদি। সাউরির বিদিশা মহান্তীর নাম যাত্রা সমাজে অতি পরিচিত। প্রথম শুরু করেন 'তমোঘ্ন নাট্য কোম্পানি' নামে এক কলকাতার দলের 'সম্ভবামি যুগে যুগে' তে। এরপর চুটিয়ে অভিনয় করেছেন মেদিনীপুরের এই যাত্রাশিল্পী।
পূর্ব মেদিনীপুরের হাউরের নট ও নাট্যকার সুকুমার রায় এরাজ্যের যাত্রামােদী দর্শকের কাছে অতি পরিচিত। প্রায় ৭০টির বেশি পালাগান লিখেছেন তিনি। ১৯৮১ তে 'রাজা সাহেব' পালার জন্য বিহার সরকার থেকে সম্মানিত হন। ১৯৭০এ তার প্রথম যাত্রাপালা 'নতুন সূর্য'। এরপর তিনি লিখেছেন 'আমি সীতা হতে চাই না' (যাত্রাদূত), সাতদিনের স্বামী (তারা মা অপেরা), মানুষকে বিশ্বাস নেই (দিগ্বিজয়ী অপেরা), পানের আগুনে জ্বলছে প্রতিমা (ইষ্টবেঙ্গল), কলির পরের ষ্টেশন, কোন সে আলাের স্বপ্ন নিয়ে, বিয়ের নামে ব্যবসা (তারা মা অপেরা), কমলা কেমন আছাে?, আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না, চাকরী করা বউমা (চন্দ্রলােক অপেরা), ওগাে বাংলার বধূ, কলির কৃষ্ণ কাঁদছে (শ্ৰীদুর্গা), বাঘিনী বউ নাগিনী শাশুড়ি (শিল্পাঞ্জলী), পতি-পত্নী-পতিতা (দিগ্বিজয়ী), ভদ্রলােকের কথার দাম নেই (কল্যানী অপেরা), ভােটে দাঁড়াচ্ছে বউ (গন্ধর্ব অপেরা), কাজলা দিঘির কালো বউ (গন্ধর্ব অপেরা) ইত্যাদি। এর মধ্যে ১৯৭ এর বেশি রজনী অভিনীত হয়েছিল 'ভোটে দাঁড়াচ্ছে বউ' পালাটি। 'বউ কিনেছি রথের মেলায়' যাত্রাপালার জন্য ১৯৯৯ সালে সুকুমার রায়কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর কর্তৃক শ্রেষ্ঠ পালাকার হিসেবে সম্মানিত করে। তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ পালাগুলি হল -"মায়ের চোখে ঘুম নেই এবং কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী'।
মেদিনীপুরের দীঘার রমেন মাইতি ছিলেন যাত্রার সুরকার। যাত্রায় 'বিবেক' এর রােল করতেন। সন্তোষকুমার পতি-র 'শ্যামসুন্দর অপেরার', বংশীধর মিদ্যার 'বানেশ্বর অপেরা', ওড়িশার কামেশ্বর পন্ডার ‘চন্দ্রশেখর অপেরা', কেশরম্ভার ‘শীতল অপেরা' এবং ‘রূপবাণী অপেরা'-র পর যাত্রা ছেড়ে শিখতে লাগলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। গীতবিতান সঙ্গীত আকাদেমী থেকে সর্বভারতীয় স্তরে প্রথমশ্রেণিতে প্রথম হয়ে পেয়েছিলেন স্বর্ণপদক। এরকম বহু যাত্রাশিল্পীর জীবন আবর্তিত হয়েছে নানা ওঠাপড়ায়। একসময় মৎসমন্ত্রী কিরণময় নন্দের দাদু গঙ্গাধর নন্দ গড়ে তুলেছিলেন শখের যাত্রা দল। যাত্রার সাথেই জড়িয়ে আছে কার্তিক সামন্ত-র নাম। সাইক্লোরামা পদ্ধতি যাত্রাকে করে তুলেছিল আধুনিক। আজ সবংয়ের শিক্ষক শান্তনু অধিকারী লেখেন যাত্রার গান। তেমনি হাউরের অহিভূষণ পাত্রও লেখেন গান।
মহিষাদলের হরিখালি গ্রামের মুকুন্দমোহন দাস কলকাতার পেশাদার যাত্রাশিল্পী ছিলেন। তাঁর পুত্র গবেষক প্রভাতকুমার দাস পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা একাডেমির কার্যকরী সমিতির সদস্য হয়েছিলেন। এখন যাত্রা একাডেমি পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় 'বহুরূপী' পত্রিকার ১২৪ তম বিশেষ 'বাংলা যাত্রা সংখ্যা' প্রকাশিত হয়েছে।তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ 'বাংলা যাত্রাপালার গান' এবং অমরনাথ পাঠকের প্রবন্ধ নিয়ে 'বিস্ময় যাত্রা থিয়েটার' বইদুটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা বিষয়ক পিএইচডির পরীক্ষক হয়েছিলেন। যুগজিৎ নন্দ বেলদা গঙ্গাধর অ্যাকাডেমির শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু যাত্রা নিয়ে তাঁর গবেষণা বেশ তারিফযােগ্য। জেলার যাত্রা প্রসারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। একসময় তিনি ছিলেন মেদিনীপুর যাত্রা একাডেমীর সভাপতি। যাত্রা নিয়ে তিনি অসংখ্য লেখা লিখেছেন।
মেদিনীপুরের যাত্রা নিয়ে কিছু বলার আগে বরং জেলার নাট্যচর্চা আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বলার দরকার । ১৮৭৫ এ মেদিনীপুর জেলায় থিয়েটার প্রথায় নাট্যাভিনয় শুরু হয়। খড়গপুরে জমিদার প্রিয়নাথ রায়ের বাড়িতে রথযাত্রা উপলক্ষে দুটি নাটক দুদিনে অভিনীত হয়। তখন এই নাটকে পরিচালনা ও অভিনয়ে ছিলেন বিখ্যাত ডাঃ নীলরতন সরকার। এরপর ১৮৭৬ -৭৭ এ মেদিনীপুরের চিড়িমারসাইতে রামগােবিন্দ নন্দীর বাড়ীতে হরিশচন্দ্র', 'রামাভিষেক' নাটক সহ 'চক্ষুদান' নামে একটি প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে মহিষাদলের রাজা গােপালপ্রসাদ গর্গ একটি ড্রামাটিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। রঘুনাথবাড়িতে মহন্তরা গ্যাসবাতি ও হ্যাজাক সহ থিয়েটার হল তৈরি করেছিল। ১৮৮১-৮২ তে গােপালচন্দ্র মাইতির উদ্যোগে গঠিত হয় 'হিন্দু থিয়েটার'। ১৮৮৫-৮৬ তে কর্ণেলগােলাতে গঙ্গারাম দত্তের বাড়িতে মঞ্চ বেঁধে দুটি নাটক অভিনীত হয়েছিল। ১৮৮৭ থেকে ছোট বাজার মহল্লাতে ধারাবাহিকভাবে নাটক অভিনীত হয়ে আসছিল। ১৯৫২-৫৩ পর্যন্ত এখানকার প্রেক্ষাগৃহটি লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
ধীরে ধীরে নাটকের অবয়ব ছেড়ে পেশাদার ভিত্তিতে যাত্রাদলের জন্ম নেয়। একসময় মঙ্গলকাব্যাশ্রয়ী লােকনাটকের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সামাজিক, ঐতিহাসিক অশ্রু সজল যাত্রাপালার অভিনয় শুরু হয় জেলায়। দুই মেদিনীপুরে যাত্রা-তালিকায় নিম্নোক্ত ধারাগুলির নাম আসবে -- ১) ভাঁড়াযাত্রা, ২) কৃষ্ণযাত্রা, ৩) যুগীযাত্রা, ৪) শয়ালযাত্রা, ৫) ওড়িয়া যাত্রা।
ড. সুবিকাশ জানা 'মেদিনীপুর জেলার লােকনাট্য'-তে বলেছেন-“মেদিনীপুর জেলায় যে সকল লােকনাট্য প্রচলিত তা বিক্ষুদ্ধ 'নাটক' বা বিশুদ্ধ 'যাত্রা' নয়। নাটক এবং যাত্রা দুটো মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যে সকল গােষ্ঠী বা নাট্যাসংস্থা অভিনয় করছেন তারা তাদের পালাগুলিকে বিভিন্ন সময়ে নাটক বলছেন তবে দর্শক-শ্রোতা কিন্তু হামেশাই পালাগুলিকে 'যাত্রা নামে অভিহিত করে থাকেন।"
গবেষক শ্যামল বেরা লিখেছেন 'ভাঁড়যাত্রা' নিয়ে বিশদ বিবরণ সমৃদ্ধ বই। এটি এখন মােহন দাস ও সম্প্রদায় কোনওমতে টিকিয়ে রেখেছেন। 'কৃষ্ণযাত্রা' নিয়েও শ্যামল বেরা একটি বৃহৎ বই প্রকাশ করে মেদিনীপুরের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। শয়ালযাত্রা অবশ্য হামেশাই হয় এখনও। সাধারণত মঙ্গলকাব্যাশ্রয়ী এই লােকযাত্রায় আমরা পাই মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, শীতলা মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, কপিলা মঙ্গল, শিবায়ন ইত্যাদি ধারাগুলিকে।
যাত্রায় পুরুষের মহিলা চরিত্রে অভিনয় করা একসময় খুব চালু ছিলো। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার রঘুনাথবাড়ি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে যতীন চক্রবর্তী ওরফে যতীন রানী নেমে পড়েন স্বদেশী যাত্রার আসরে। তখন স্বদেশী আন্দোলনের আগুন জ্বলছে। তাই যতীন রানীকে কারাবাসও করতে হয় কয়েকবার। ১৯৩৯-৪০ এ যাত্রা জগতের অতিপরিচিত নাম উপেন পাণ্ডা যতীনকে কলকাতার গণেশ অপেরায় নিয়ে আসেন। এরপর নট্ট কোম্পানী, আর্য অপেরা, রয়েল বীণাপানি, ভাণ্ডারী অপেরা, রঞ্জন অপেরাতে অভিনয় করতেন। পূর্ববঙ্গে নট্ট কোম্পানীকে যে পালা প্রথম প্রতিষ্ঠা দেয় সেই 'চাঁদের মেয়ে' পালায় চাঁদের চরিত্রে অভিনয় কৱেন যতীন রানী। এছাড়া চাঁদ সওদাগর-এ মনসা, ভীষ্মতে গঙ্গা চরিত্রে পুরুষ হয়েও মহিলার অভিনয় করেছিলেন যতীন রানী। সেসময় যতীন রানী যাঁদের সঙ্গে অভিনয় করতেন তাঁরা হলেন উপেন অধিকারী, হরিপদ বায়েন, ফণী ভট্টাচার্য, ক্ষিতীশ বিশ্বাস প্রমুখ।
১৯৫৮-৫৯ এ যতীন রানী অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে দল পরিচালনা শুরু করেন। যতীনবাবুর শেষ অভিনয় ‘সিরাজউদ্দৌল্লা' পালায় সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগমের চরিত্রে। ভাণ্ডারী অপেরার কর্ণধার হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ এর ১০ই অক্টোবর কলকাতার রিজেন্ট পার্কে 'শূন্য বাসরে বধূ' পালা আরম্ভ করে অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। পরের দিন তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৬৩ সালে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা উৎসবে যতীন চক্রবর্তীকে মানপত্র দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। এটাই তাঁর প্রথম ও শেষ মূল্যায়ন। মেদিনীপুরের যতীন রানীর মতাে আর কোনও পুরুষ অভিনেতা কলকাতায় গিয়ে দাপিয়ে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতে পারেননি। একসময় বেলদার জয়চণ্ডী অপেরায় অভিনয় করতেন ( জাল সন্ন্যাসী ) বর্তমানের শ্রেষ্ঠ বেতার নাট্ পরিচালক তথা চারবারের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত মেদিনীপুরের মানুষ আশিষ গিরি।
মেদিনীপুরের কয়েকজন বিশিষ্ট নায়কদের নাম ১) শশাঙ্কশেখর মাইতি, হাউর। ২) বলাই কিশাের সামন্ত, রাইন, কোলাঘাট। ৩) অনিলকুমার মাইতি, মেদিনীপুর। ৪) হিমাংশুশেখর দত্ত, পুলশিটা। ৫) জয়দেব বাগলী, বাথানবেড়িয়া। ৬) সুবােধ হাজরা, পাঁশকুড়া। ৭) নারায়ণ ভৌমিক, কামারদা প্রমুখ।
মেদিনীপুরের কয়েকটি বিখ্যাত (যাত্রার) ডেকোরেটিং কোম্পানি ১) মা দুর্গা ডেকোরেটার, চন্দ্রকোণা ২) গীতাঞ্জলি ডেকোরেটর, ঘাটাল ৩) শ্রীদুর্গা ডেকোরেটর, শালবনী ৪) বীনাপানি ডেকোরেটর, পাঁশকুড়া ৫) দাস ডেকোরেটর, মেচেদা ৬) মডার্ন ডেকোরেটর, ডেবরা ৭) তৃপ্তি ডেকোরেটর, তমলুক ৮) হেমলতা ডেকোরেটর, দেউলিয়া ৯) গৌরাঙ্গ ডেকোরেটর, গৌরা ১০) রাধারানী ডেকোরেটর, কোলাঘাট ইত্যাদি।
মেদিনীপুরের সৌখিন যাত্রা দলের কিছু তথ্য দেওয়া যাক। অঞ্চল ভিত্তিক সেগুলির তালিকা দেওয়া হোলো -
ক। তমলুক -- ১) দোনাচক কালীমাতা ক্লাব ২) বাতােয়ালী নটরাজ নাট্য সম্প্রদায়, রাধাবল্লভপুর ৩) হরশংকরপুর মৈত্রী সংঘ ৪) নিউ সত্যনারায়ণ এ্যামেচার পার্টি, কাকগেছিয়া ৫) রাজারামপুর কিশোর সংঘ যাত্রা পাটি, শিবরামনগর ৬) কুলাপাড়া শ্রী দুর্গা লাইব্রেরী যাত্রা পার্টি, কোটবাড় ৭) আমড়াতলা দেশবন্ধু কিশাের সংঘ, আমড়াতলা।
খ। ঝাড়গ্রাম-- ১) চিড়াকুটি মাধচন্দ্র স্মৃতি সংঘ, কেশিয়াপােতা ২) ছাতনাশোল তরুণ সংঘ ৩) লালগড় মিলনী সংঘ ৪) ঝাড়বনী তরুণ সংঘ, নেকড়াশােল ৫) রাঙ্গরাকোলা রামপ্রসাদ যাত্রা অভিনয়, খালশিউলী ৬) ধাদনগিরি শিবদুর্গা অপেরা পাটি, চোরচিতা ৭) হাতিপােতা বীণাপানি অপেরা পার্টি, গোপীবল্লভপুর ৮) ভাঙ্গাবাঁধ বীণাপানি ক্লাব, শিলদা।
গ। মেদিনীপুর — ১) রসকুণ্ডু তরুণ সংঘ ২) সৎপতি শীতলা অপেরা পাটি, পিড়াকাটা ৩) নাট্যশ্রী, কর্ণেলগােলা ৪) তারা নাট্যপীঠ, মিরবাজার ৫) ধাদিকা বাণী নিকেতন, গড়বেতা ৬) নাট্যরূপা, কর্ণেলগােলা ৭) বিবেকানন্দ আশ্রম, কুইকোটা ৮) জলহরি মৌপাল যাত্রা পার্টি ৯) সিঙ্গাই সবুজ সংঘ, মারকুণ্ডা ১০) চড়াইগ্রাম নবারুণ সমিতি, পুরুলদা ১১) সনকা অপেরা পার্টি, গোয়ালতোড় ১২) গােপীনাথপুর রবীন্দ্র সংসদ, খুরসি ১৩) ব্রাণ্ডনিপুর লােকশিল্প সংঘ, যশােরাজপুর ১৪) শিল্পীসংঘ, কর্ণেলগোলা ১৫) বাড়মানিকপুর নাট্যদল।
ঘ। কেশপুর -- কোটা শীতলা অপেরা পার্টি, শিরসা।
ঙ। নয়াগ্রাম -- ১) জামিরপাল শচীন্দ্র যাত্রা পার্টি, জামিরপাল গড়।
চ। কাঁথি -- ১) রামচক মিলনী ক্লাব ২) চণ্ডীভেটি বীরেন্দ্র স্মৃতি সংঘ, ভবানীচক ৩) বিক্রমনগর কিশাের সংঘ ৪) পশ্চিম দেউলবাড় তরুণ সংঘ ৫) মিলন সংঘ লােকরঞ্জন সংস্থা, ভগবানপুর ৬) কালিন্দী অঞ্চল সেবা সংঘ ৭) ধান্যঘরা মিলন সংঘ ৮) উদয় সংঘ, দেবীদাসপুর।
ছ। ঘাটাল -- ১) জোতঘনশ্যাম শ্রী শ্রী বৈদ্যনাথ অপেরা ক্লাব ২) জয়কৃষ্ণপুর হেমন্ত সংঘ, সেকেন্দারী ৩) মিতালী নাট্য সমাজ, ছত্রগল্প ৪) বীরভানপুর কালিকা অপেরা, হেমন্তপুর ৫) কোটালপুর বাসন্তীময়ী বান্ধব অপেরা পার্টি ৬) শ্ৰী শ্ৰী শীতলামাতা অ্যামেচার ক্লাব, রাধাকান্তপুর।
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় প্রথম যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০১ এর ১৪-২২ শে ফেব্রুয়ারি বেলদা গৌরাঙ্গ রাইস মিল প্রাঙ্গণে। উদ্বোধন করেন স্বপন কুমার। এখন আর যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়না। প্রথম যাত্রা উৎসবের বিচারক ছিলেন যুগজিৎ নন্দ, বীরেন্দ্রনাথ দেব এবং প্রিয়ব্রত মিশ্র। দ্বিতীয় যাত্রা উৎসব ২০০২ তে এবং তৃতীয় যাত্রা উৎসব হয় ২০০৬ তে। ২০০২ এর ১২-১৮ই আগষ্ট যাত্রা শিল্পী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সঞ্চালক ছিলেন যুগজিৎ নন্দ।
১৯৯০ সালে গঠিত হয় 'মেদিনীপুর যাত্রা পরিষদ'। এর স্থায়ী সভাপতি হয়েছিলেন যুগজিৎ নন্দ। কার্যকরী সভাপতি হয়েছেন রাজেন্দ্রনাথ ধর, যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন সুরেশচন্দ্র গিরি এবং গৌতম কুমার বারিক। মেদিনীপুর জেলার পেশাগত যাত্রাদলের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বেলদা ও নন্দকুমার ছাড়াও পাঁশকুড়া, এগরা, ত্রিলােচনপুর, ভগবানপুর, তেমাথানি, খড়গপুর, ডেবরা, ঘাটাল, হেঁড়িয়া এলাকায় অনেক যাত্রাদল মিলবে।
মেদিনীপুর জেলার কিছু প্রাচীন যাত্রাদলের নাম হোলো - লােকতীর্থ অপেরা, পরশমনি যাত্রা সংস্থা, আগমনী যাত্রা সমাজ, বিশ্বকর্মা অপেরা, কল্পতরু যাত্রা সংস্থা, মহাকালী অপেরা, বিষ্ণুলোক অপেরা, শিল্পী মঞ্জুরী অপেরা, মা বাসন্তী অপেরা, নবারুণ যাত্রা সমাজ ইত্যাদি। মেদিনীপুরের যাত্রাদলগুলি এই জেলা ও রাজ্যের বেড়া ডিঙিয়ে অন্যান্য রাজ্যতেও অভিনয়ের ডাক পায়। যা অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
কলকাতার দলগুলি যখন বছরে ৮০-৯০ টি শাে করে তখন মেদিনীপুরের বহু দল বছরে ১৫০ নাইট শাে করে। সাধারণত আশ্বিনের দুর্গাপূজা থেকে অঘ্রাণের রাসপূর্ণিমা পর্যন্ত দেড় মাস প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম। এই সিজিনকে বলে 'ঝরা সিজিন'। এরপর অঘ্রাণ থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় পর্যায়ের বুকিং। প্রতি বছর শীতের সময় থেকে শুরু হয়ে যায় যাত্রার সিজিন। কিন্তু মূলতঃ চৈত্র থেকে আষাঢ় এই চারমাস গ্রামাঞ্চলে উদযাপিত হয় শীতলা পূজা, মনসা পূজা, চড়ক গাজন, রথযাত্রা, বাসন্তী পূজা, ফলহারিনী কালীপূজা সহ শয়লা উৎসব। মেদিনীপুরের যাত্রাদলগুলোর এই সময় ভালোই বায়না থাকে।
জেলার বিশিষ্ট যাত্রা গবেষক ও সংগঠক যুগজিৎ নন্দের কথায়, যাত্রার ভবিষ্যৎ বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়। লক ডাউনের আগে থেকেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। এখন পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। আসলে কলকাতার যাত্রার প্রভাবে জেলার যাত্রার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গিয়েছে। সেখানে ফিল্ম ও সিরিয়ালের নায়ক নায়িকাদের দেখা যাচ্ছে যাত্রায় অভিনয় করতে। প্রত্যন্ত গ্রামে যাত্রার প্রতি সাধারণ মানুষের কদর অবশ্য এখনও আছে। তিনি জানান, এই মুহূর্তে বহু দরিদ্র যাত্রাশিল্পী নিরন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। উপার্জন একদমই বন্ধ। পরিস্থিতি খুব ভয়ঙ্কর হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার লোকপ্রসার প্রকল্পে কিছু দরিদ্র যাত্রাশিল্পীর নাম নথিভুক্ত করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ শিল্পীই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
মেদিনীপুরের যাত্রা মেদিনীপুরের মানুষের কাছে গর্বের মুকুট। আজ চটুল সংস্কৃতির আক্রমণে এই লােকঘরানাটি একটু হলেও আক্রান্ত। মানুষের রুচির ওপর নির্ভর করে আজ যাত্রাতে চলচ্চিত্র অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রবেশ ঘটছে। এটা খারাপ লক্ষণ। কিন্তু তথাপি মেদিনীপুরের যাত্রা শিল্পী ও শিল্পটি টিকে থাকবে তার স্বকীয়তাকে আশ্রয় করেই।
----------
0 Comments