জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কথা


মেদিনীপুরের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কথা 

ভা স্ক র ব্র ত  প তি 

জল-জঙ্গল-বালিয়াড়ি আর উষর ভূমি সহযােগে আমাদের জেলা মেদিনীপুর। অর্থাৎ পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম। কোথাও সমুদ্র উপকূল, তাে কোথাও লালমাটির হাতছানি। অঞ্চলভেদে তাই নানা রকমের গাছগাছালি। স্বাভাবিকভাবে পাখপাখালি বিভিন্ন। পরিবেশের তারতম্যের সাথে সাথে বদলে যায় প্রাণীকুলের অবস্থান, প্রকৃতি, পরিচয়, কাজকর্ম এবং সর্বোপরি ইকোসিস্টেম। মেদিনীপুরের বুকে তাই ধরা পড়ে প্রাণীকূলের রকমফের। বাস্তুতান্ত্রিক পরিমণ্ডলকে আশ্রয় করে একেক স্থানে একেক প্রাণীর দেখা মেলে। 

কিন্তু হায়! সারা রাজ্যের মতাে এই মেদিনীপুর থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণীকুল। বিলুপ্তপ্রায় সেইসব বনজ প্রাণীরা আজ অস্তিত্বের সংকটে দোদুল্যমান। বিশেষ করে মানুষের বদান্যতায় এই ঘাের সংকট দেখা দিয়েছে জেলার আপামর বন্যপ্রাণীকূলের জীবনে। বিশেষ করে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। 

এক শ্রেণীর অশিক্ষিত মানুষের দল সংস্কৃতির নামে প্রাণীহত্যা চালায় জেলার বিভিন্ন স্থানে। 'সেঁদরা' পরব তথা শিকার উৎসবের নামে চলে দেদার প্রাণী নিধন যজ্ঞ। জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের এই ট্র্যাডিশন আজকের পৃথিবীতে অচল। অথচ প্রশাসন নীরব দর্শক। মাঝখান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে জেলার ইকো সিস্টেমের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গানুগুলি। তাছাড়া অনবরত কৃষি জমিতে কীটনাশক, সার ব্যবহারের ফলে জলদূষণ, মৃত্তিকাদূষণ ঘটছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে ইকোসিস্টেম। তার জটিল প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীর জীবনে। এক ধরনের চোরাশিকারির কল্যাণে ধরা পড়েছে বহু পাখি, প্রাণী। কে দাঁড়াবে ওদের পাশে?
একসময় জেলায় প্রচুর সংখ্যক ব্যাঙ হত্যা করা হত। অথচ এটি পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের প্রয়ােজনীয় স্তরে অবস্থান করে। ১৯৭২ এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যাঙ রপ্তানি কিছুটা রদ করা সম্ভব হয়েছিল। হিসাব বলছে যে, ১৯৮৬ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতা থেকে ৩৩০ টন ব্যাঙের 'পা' রপ্তানি করা হয়েছিল। যদিও ঐ বছরই তা নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাঁচ লক্ষ সাপ ও গােসাপের চামড়া বিদেশে রপ্তানি হয়েছিল। প্রায় ২০ হাজার পাখি রপ্তানি হয়েছে বিদেশে। ১৯৭৪-৭৯ পর্যন্ত এদেশে ধরা হয়েছিল প্রায় ৬০ লক্ষ সাপ সহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রাণী। স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোনো হিসেব নেই।

প্রতিনিয়ত খনিজ সম্পদ আহরণ, উৎপাদনের জন্য সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে খননের কাজের জন্য মাটির উর্বরতা, জলধারণ ক্ষমতা কমছে। ফি বছর ৬০০০ মিলিয়ন পরিমাণের মাটি ভূমিক্ষয়ের ফলে অপসারিত হচ্ছে এদেশে। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হার বাড়ছে। 
আমাদের দেশে বন্যার সম্ভাবনা ২০ মিলিয়ন হেক্টর জমি থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ মিলিয়ন হেক্টর হয়েছে। এই প্রভাব থেকে মােটেও বঞ্চিত হয়নি আমাদের মেদিনীপুর জেলা। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হেক্টর জমির বন জ্বালানির জন্য কাটা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে খাদ্যের অভাবে এবং বাসস্থানের অভাবে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাণীকুল ঘরভিটা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখােমুখি। যেখানে ১৯০০ সালে ভারতের অরণ্য ছিল মােট ১৬ লক্ষ বর্গ কিমি, সেখানে এখন তা ১ লক্ষ ৬৬ হাজার বর্গ কিমির কাছাকাছি। 

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান - IUCN (International Union for Conservation of Nature and Natural (Resources)। এছাড়া গঠিত হয়েছে WWF (World) Wildlife Fund)। প্রত্যেকেই বন্যপ্রাণীর রক্ষার কাজ করে চলেছে।
মেদিনীপুরে পাওয়া যায় এমন কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর পরিচিত নাম ও বিজ্ঞানসম্মত নাম-

১) হনুমান (The Common Langur) - Presbytis entellus. 2) বানর (The Rhesus Monkey)-Macaca Mulatta ৩) চিতা বেড়াল ( The Leopard Cat ) - Felis bengalensis ৪) বাঘরোল (The Fishing Cat)-Felis Viverrina, ৫) বনবেড়াল (
The Jungle Cat) - Felis chaus ৬) খট্টাশ (The Common Palm Civet) - Paradoxurus hermaphroditus. ৭) গন্ধগোকুল (The Small Indian Civet) - Viverricula indica, ) ৮) নেউল (The Common Mongoose)- Herpestes edwardsii  ৯) বেজি (The Small Indian Mongoose)- Herpestes auropunctatus, ১০) হায়েনা (The Stripped Hyena) - Hyaena hyaena ১১) ইঁদুর (Common House Rat) Rattus rattus  (Baridicoot Rat)- Bandicota indica. 
(Brown Rat) - Rattus norvegicus. 
(House Mouse) - Mus Musculus 
১২) শেয়াল (The Jackal) - Caris aureus ১৩) (The Bengal Fox) - Vulpes bengalensis ১৪) শজারু (The Indian Porcupine) Hystrix indica ১৫) খরগোশ (The blacknaped Hare) Lepus nigricollis nigricollis ১৬) চামচিকা ( The Pipistrelle) Pipistrellus coromandra. ১৭) বাদুড় (The Flying Fox) - Pteropus giganteus. ১৮) হাতি (The Elephant)- Elephas maximus ১৯) কাঠবিড়ালি (Five Striped Squirrel)-  Funambulus Pennanti ২০) ডলফিন / শুশুক (Dolphin) - Delphinus dolphins ২১) প্যাঙ্গোলিন (Pangolin) Manis crassicaudata ২২) ভেঁড়া- (Sheep) - Ovis Sp ২৩) শূকর (Boar) - Sus scrofa ২৪) ছাগল (Goat) - Capara Sp ২৫) গরু (Cow) Bos indicus ২৬) ছুঁচো - Talpa Sp ২৭) (Cat) - Felis domesticus ২৮) কুকুর (Dog) Canis familiaris ২৯) মহিষ (Bufello) - Bubalus bubalis ৩০) ঘোড়া  (Horse)- Equus Caballus ।

মেদিনীপুরের বুকে উপরােক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি 'বন্যপ্রাণী' হিসেবে চিহ্নিত। এঁদের অনেকগুলো লুপ্তপ্রায় এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। WW HUNTER তাঁর  'A STATISTICAL ACCOUNT OF BENGAL -  MIDNAPORE' এ লিখেছেন - "The domestic animals of Midnapore district used for purposes of agriculture are buffaloes and oxen. Cows are also sometimes used by Muhammadans for ploughing, but not often, goats, sheep, pigs, geese, ducks and fowls are reared for food, or as articles of trade.
The board of revenue estimates the domestic animals in the District thus: Buffaloes, Cows, bullocks 69000, sheep and goats 85000, pigs 10000. I have no means of testing these figures."

একসময় এই মেদিনীপুরের উপকূলভূমিযুক্ত বালিয়াড়িতে মিলতাে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সেই বাঘের চামড়ার আসনে বসতেন বঙ্কিমচন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা'র কাপালিক। তিনি লিখেছেন, "কাপালিক অগ্নি জ্বালিত করিয়া কহিল - 'ফলমূল যাহা আছে আত্মসাৎ করিতে পার। পূর্ণপাত্র রচনা করিয়া, কলসজল পান করিও। ব্যাঘ্রচর্ম আছে, অভিরুচি হইলে শয়ন করিও। নির্বিঘ্নে তিষ্ঠ - ব্যাঘ্রের ভয় করিও না। সময়ান্তরে আমার সহিত সাক্ষাত হইবে।” কিন্তু হায়! আজ মেদিনীপুরের কাঁথির সেই দৌলতপুর ও দরিয়াপুরের কল্লোলিত সমুদ্র গর্জনের সাথে বন্য পশুর রব শােনা যায় না আর। পাততাড়ি গােটাতে হয়েছে এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে। 
মেদিনীপুরের চড়ক গাজন উৎসবেও গাজনের গানে (মাঙন বা মাগন গান) গাওয়া হয় বাঘের কথা। ড. সুব্রত মুখোপাধ্যায় সেরকমই একটি মাগনের গান ( সূবর্ণরৈখিক ভাষাতে) উল্লেখ করেছেন 'পাটভক্তা কহুছি কথা/ কাঁহিক যিব তুই ?/ বাটরে গুটায় কেন্দুয়া বাঘ/ দেখি আইনু মুই/ উটে তার হাঁড়িয়া তুঁঢ় নম নেজুড়/ চালতাপারা চোখ/ খাইব সবজনকু গিলিব সবজনকু'। কি বলতে চাইছে তা সহজেই অনুমেয়। গোপীবল্লভপুর ২ নং ব্লকে রয়েছে ব্যাঘ্রেশ্বর মন্দির। এখানকার শিবের নাম। কথিত আছে যে, এই শিবকে পাহারা দিতো বাঘ। এছাড়া এখানে বাঘের নামে গ্রামনাম রয়েছে বাঘঘোরা এবং বাঘডুবি। আর খোদ জঙ্গলমহলের বুকে বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য মানুষ পূজা করেন 'বাঘুৎ' দেবতা। অথচ জঙ্গলমহলে হঠাৎ দেখতে পাওয়া রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে নিধন করে দেয় এক শ্রেনীর অবিবেচক মানুষ। ২০১৮ এর ১৩ ই এপ্রিল বাঘঘোরা গ্রামে ঘটে সেই ভয়ানক বাঘ হত্যাকাণ্ড।
মেদিনীপুরের বহু মন্দিরে ছাগল বলিদানের রীতি রয়েছে। বিশেষ করে দেবী কালীর কাছে। দুর্গাপূজাতেও হয়। আগে মহিষ বলি ছিল। এখন অনেক কমে গেছে। সেঁদরা পরবের নামে হাডডাঙার শিকার উৎসব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রচুর পরিমাণে স্তন্যপায়ী প্রাণীর দফারফা করা হোতো। জাল টাঙিয়ে বাদুড় ধরার চল রয়েছে গ্রামাঞ্চলে। দীঘার সমুদ্রে প্রায়ই ভাসতে দেখা যায় মৃত তিমি ও ইরাবতী ডলফিন কিংবা গাঙ্গেয় ডলফিন। কখনো কখনো জেলার নদীনালা এবং খালবিলেও ঢুকে পড়ে ডলফিন। আর কিছু মাতব্বরের কল্যানে সেগুলো অযাচিতভাবে প্রাণ হারায়।

ভারতের বুকে ১৯১৬ এবং ১৯১৭ সালে প্রথম সংরক্ষিত অরণ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই ব্রিটিশ বনাধিকারিক ই আর স্টিভেন্স এবং ই এ স্মাইথস। যদিও তাঁদের সেই প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছিলেন পারসি উইণ্ডহ্যাম। তবে ভারতে সংরক্ষণের বিষয়ে পথ দেখিয়েছিলেন জিম করবেট। আজ ঝাড়গ্রামে তৈরি হয়েছে চিড়িয়াখানা। সেখানে অন্যান্য প্রাণীদের সাথে বেশ কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর ঠাঁই  হয়েছে। 
সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের মান্দারমনি সমুদ্র সৈকতে বঙ্গোপসাগরে ভেসে এসেছিলো বিশালাকার মৃত তিমি। এটি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। সমুদ্রে ইলিশ ধরার মরশুম শুরু হয়েছে। ফলে প্রচুর ট্রলার মাঝসমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে। পরিবেশপ্রেমীদের মতে, এমতবস্থায় সম্ভবত কোনো জাহাজ বা ট্রলারের ধাক্কায় আহত হয়ে অবশেষে মৃত্যুর মুখোমুখি এই বিরল প্রজাতির বৃহদাকার স্ত্রী তিমিটি। সম্ভবত এটি বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় Sei Whale। এটি Balaenoptera গণের অন্তর্গত। এটি আসলে ব্লু হোয়েল এবং ফিন হোয়েলের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তিমি। বলা হয় Baleen Whale। বিজ্ঞান সম্মত নাম Balaenoptera borealis। প্রায় ৭০ বছর ধরে বেঁচে থাকার ক্ষমতাধারী এই তিমি। এই ধরনের তিমিকে বলা হয় 'কোলফিস'। অনেকটা 'কডফিস' এর সমগোত্রীয়। জাপানিরা বলে Iwashi kujira এবং Sanriku। সার্ডিন হোয়েল নামেও চেনে অনেকেই। পরিনত পুরুষ তিমির দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট এবং স্ত্রী তিমির দৈর্ঘ্য ৪৯ ফুট হয়। এর আগে ২০১২ এর ১০ ই ডিসেম্বর দীঘাতে এই ধরনের একটি তিমির মৃতদেহ মিলেছিলো। সমুদ্র উপকূল থেকে ৪০ নটিক্যাল মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই তিমিটি ছিল ৪৫ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া। ১৮ টন ওজন ছিল। মাঝসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের জালে আটকে গিয়েছিলো সেটি। তাঁরাই নিয়ে আসে উপকূলে। সেসময় সমুদ্র উপকূলেই বালি খুঁড়ে কবর দেওয়া হয়েছিল সেই মৃত তিমিটিকে। পরে তাঁর কঙ্কালগুলিকে সংগ্রহ করে প্রায় লক্ষাধিক টাকা খরচ করে দীঘাতে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষিত করা হয়েছে ২০১৭ এর ১৩ ই জুন। আজও দীঘায় আগত পর্যটকরা তা দেখতে পান।

কিন্তু সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে গােটা জেলাজুড়ে বেশ কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব সঙ্গিন। আজ যথেষ্ট হারে মেলেনা বাদুড়, খেকশিয়াল, ভাম, নেউল, হনুমান, সজারু, বাঘরােলদের। আমরা কি এঁদের পাশে দাঁড়াতে পারি না? কেন কিছু অবিবেচকদের হিংস্র শিকার হবে এদের জীবন? আমাদের জেলার বাস্তুতন্ত্র বাঁচাতে আজ এঁদের পাশে দাঁড়ানাে একান্ত কর্তব্য।
--------

Post a Comment

0 Comments