জ্বলদর্চি

স্বপন পাল


স্ব প ন  পা ল


সন্ধ্যাকাল 

মেয়ে কলেজের মাঠে সন্ধে নামলে
একটা পাখি উড়ে এসে বাতাসে 
বিদায় লিখে যায়, কোথাও গভীর ভাবে
আঁকা আছে ঘরে ফেরার এটাই সময়
নিশাচর আড়মোড়া ভাঙ্গে, শঙ্খধ্বনি
পাড়ায় পাড়ায় অকাতর বেজে গেলে
রাতের প্রস্তুতি শুরু হবে। 
আগুন নেভাতে হলে আগুন জ্বালাতে হবে
কতকাল ধরে একটা ধারণা নিয়ে
বেঁচে আছি, বেঁচে আছে দিনের সকাল।
সন্ধে নামলে ঘরের চৌকাঠ চোখে ভাসে
রোদের দাঁতের নীচে চেরাই প্রত্যঙ্গগুলো
জুড়ে যায়, প্রদীপের আলো টানে।
জোনাকি জ্বলার আগে সন্ধ্যাতারা উঠে আসে
আগুন জ্বলবে তবে, আগুন জ্বালাতে হবে
আগুন জ্বললে তবে নিভবে আগুন।
     
পালিয়ে যাওয়া 

নোনতা বিস্কুট থেকে গুঁড়ো ঝরে ঝরে পড়লে
অপচয় মনে হতো, আমাদের ছোটবেলা
সে রকম স্মৃতি নিয়ে চোরকাঁটার মতো
প্যান্টের পায়ে বা মোজায় থাকতে পারে।
দরোজা খুলে প্রথম দেখা মেয়েটার চোখ
ডুবতে থাকা সূর্যের থেকেও মায়াবি লেগেছিল,
বিকেলেই বাঁশ পড়ছে শুনতে পাচ্ছি মাঠে
সামনে পুজোর ছুটি, নোনতা বিস্কুটের দিন।
একটা জন্ম অনায়াসে পিছলে গেলে পোড়ে
জুতোর বাক্সে লুকিয়ে রাখা 
পুতুল মেয়ের জামা, ছেঁড়া কাগজ সূর্য আঁকা,
অপটু হাতচিঠি, দু'একখানা রঙিন বোতাম।
তারপরেও যে আসে, নীচের ঠোঁট দাঁতে ধরলে
ভীষণ চেনা লাগে, তেমনি চোখ 
কেউ বললো, তোকে নিয়ে পালিয়ে যাবো, যাবি
চমকে উঠে শুনতে থাকি বাঁশ পড়ছে,
চায়ের সাথে তখনি কি নোনতা বিস্কুটও ?
                           

ম্যাজিক জাফরি 

জাফরি পেরিয়ে যে ঠাণ্ডা বাতাসটুকু আসে,
উষ্ণ হতে হতে তাই দু'চোখ পোড়ালো।
ওই পুকুর ঘাট, ওই স্খলিত বসনা রমণীরা,
কোন পুরুষ আসেনা এদিকে, শুধু নারী।
সবার নজর এড়িয়ে ভাঙ্গাচোরা পার হয়ে
এই তিনতলা কেন ডাকলো, সে কি দেখাবে
বাইরে কি দৃশ্যবদল হয়ে গেছে ?
চারশো বছর পিছনে হেঁটে কেন এলাম,
চোখ পুড়ে যাচ্ছে নীচের পুকুরে কাচ কালো
জল, আজ তারিখ কতো, এখন সময় কতো?
পিছনে ফিরতে ভয়, একটা সাপের ফণা স্থির,
অবশিষ্ট সিঁড়ি ভেঙ্গে পড়লো এইমাত্র,
মরচে ধরা কড়ি-বরগার ছাদ এখন 
আমাকে সমেত ধ্বসে যেতে পারে নীচে।
সরে যেতে পারছিনা কেন, জাফরির জাদু
নীচে জল ছিল কি কখনো, 
স্নানে নামা রমণীরা ? কেন জ্বলে যাচ্ছে চোখ?
                              

সন্দেহের বীজ 

কোনদিন লম্বা ছুটির এই ঋতু শেষ হলে
দূরের দূরের কিছু বুড়ি ছুঁতে যেতে পারি,
রোদের চাপড় কি বেশি মনে হবে
বাতাসের দমকা দাপট ? অস্থির কেউ নয়
ঘুরপথ নেই, বিশেষ দাবিও নেই
ঘুমের ভিতর থেকে উঠে আসা অনুরূপ ছায়া
মনে হয় সেও সরে যাবে, চলাচল শব্দ
শুরু হতে ব্রিজ কেঁপে উঠবে বিকেলে।
স্বচ্ছ জলের নীচে দেখা দেওয়া
জলজ প্রজাতিগুলো হয়তো ফিরেও যাবে
গুপ্ত অবস্থানে, জলের ঘোলাটে চিহ্ন
বলে দেবে সভ্যতা আবার...
পুজোদেখা ভিড় দেখে ভুলে যাব 
এদিনের সব আত্মগ্লানি, কবে গেছে
ধূসর সময় ভুলে যেতে হয়। ভুলে যেতে যেতে
কোথাও বীজের মতো তবু রয়ে যাবে
একটি প্রজন্ম বেয়ে যতদূর যেতে পারে ভয়,
সন্দেহ করার মতো কতো সূত্র পাবো।
                         
এক নার্সের প্রেমিক

যে ঘরে তুমি ফিরে এসে নিজেকে বন্দি করো
কথা দিচ্ছি আজ তার নীচ দিয়ে যাবো,
ব্যালকনির দরোজা খুলে দেখো, দেখা হবে।
তোমার হাসপাতাল গতদিন পুষ্পবৃষ্টি নিয়েছিল
আমি ভয়ে ভয়ে পাপড়ি এড়াবো, 
তোমাকে ছোঁবার মতো ভুল করবো না জানো।
হাত ধরে চিলিকার নৌকায় তোলা ছবি 
গতবছর, কাতর অ্যালবামে,
ফেসবুক স্মৃতিতে ফেরায়।
সাক্ষী ছিল সহস্র ধূসর বালিহাঁস,
দীর্ঘ গ্রীবা পেলিকান বলেনি কি এসো যেন
বছর বছর? আমাদের সাহস হবে না,
আমাদের হাতগুলো কতদিন প্রিয়-স্পর্শহীন
সন্দিহান থেকে মরে যাবে?

 ----

Post a Comment

3 Comments

  1. বাহ বেশ লাগলো।

    ReplyDelete
  2. অপূর্ব কবিতাগুলি। প্রত্যেকটি কবিতা পড়েই একটু থেমে ভাবতে হয়। আসলে জবিতাগুলি ভাবিয়ে নেয়। শেষ কবিতাটি পড়েও মনে থেকে যায় প্রথম কবিতার শেষ লাই, আগুন জ্বললে তবে নিভবে আগুন।

    ReplyDelete
  3. ভালো লাগলো শব্দ চয়নের নিপুনতাই আমি মুগ্ধ, আমি আপ্লুত, কবি।

    ReplyDelete