জ্বলদর্চি

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়


 অ ভি ন ন্দ ন  মু খো পা ধ্যা য়


মনোহারি

শাটার উঠেছে আর শুরু হয়ে গেছে সংশয়
আজকে ক্রেতার দল আনবে কী যাযাবর বায়ু?
জারে জারে রাখা আছে দেহের অধিক কোনো ক্ষয়
যেভাবে প্রদীপে থাকে গত মানুষের পরমায়ু

সোনালি র‍্যাপার মোড়া ফিকে হয়ে আসা সাদা চোখ
সুতোয় ঝুলিয়ে রাখা মহামান্য আঙুলের কণা
পাউচের অন্ধকারে গুঁড়ো গুঁড়ো মিশে থাকা শোক
জানেনা কীভাবে পাবে দেহাতীত শোধের কামনা

এই তো অপেক্ষা শুরু। ব্রহ্মতালু ভেসে যায় ক্রোধে
ক্রেটের ভেতর এসে শুয়ে পড়ে কাচের হরিণ
পানীয়র থেকে আরো শীতল, বিষণ্ণ কোনো বোধে
সমস্ত ক্রেতার কাছে থেকে যায় অসামান্য ঋণ

তবুও শাটার ওঠে, বেজে ওঠে মনোহারি গান
এ জীবন কিছু নয় -- খুলে রাখা দেহের দোকান
অপরাধবোধ 

প্রতিটি লেখার শেষে জেগে ওঠে অপরাধবোধ
নিজেকে শোধন করি, তুলে নিই অশ্রুপোড়া ছাই
যা কিছু সমান্তরাল, নির্বাক ছায়ার প্রতিশোধ
তাকেই জড়িয়ে ধরি, নিষাদ শরীর খুঁটে খাই

যারা অনাহুত ছিল, যাদের পড়িনি এতকাল
চরাচরে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল মৃত অভিধানে
তাদের স্মরণ করে পেতে দিই সফেন কপাল
সংশয়াতীত হলেই প্রলাপ নাভির দিকে টানে

সে টান উপেক্ষা করি, ছুটে যাই সহজ বালক
যেভাবে সমস্ত সুর সেতারের অন্তরালে ছোটে
ভাষার সমুদ্রে আমি মান্দাস হারিয়ে ফেলা লোক
অপরাধবোধটুকু অলিভ মুকুট হয়ে ওঠে

সেলাম ঠোকেনি কেউ, তবু আমি ভাষার প্রহরী
লেখাতেই ডুবে যাই, লেখাতেই মাথা কুটে মরি


শেকল

দুরন্ত ঘোড়ার খুরে ধুলো নয় উড়ে আসে মেঘ
প্রাচীন অতীত থেকে যে ছিল মনুষ্যপায়ী, খুনি
ফসল তো কিছু নয়, কৃষকের নেভানো আবেগ
এখনো পাখির মুখে কিছু কিছু অত্যাচার শুনি

আরো শুনি কী উপায়ে অসহায় গাছের পাতারা
ক্রমশ গলিয়ে ছিল জেগে ওঠা রাক্ষসের মন
এ কাহিনী জেনে গেছে ফসলের মাঝখানে যারা
খুঁজে ছিল অন্ধ রোদ, বয়ে আসা স্বজনপোষণ

এভাবে বুনন চলে এক যুগ থেকে অন্য যুগে
সেলাই মেশিন যেন, মুদ্রাদোষে কথাকে সাজায়
যেভাবে অনন্তকাল স্মৃতিহীনতায় ভুগে ভুগে
হারানো মানুষ তার ঠিকানায় ফিরে যেতে চায়

ফেরা তো সহজ নয়। মেঘজন্ম ছেয়ে যায় দূরে
ঘোড়াটিকে দানা দাও, সোনার শেকল দাও, খুরে


লড়াই 

তুমুল  যোনির মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছি ঋজুগান
নিজের খেয়ালে বাজে পিয়ানোর সাদাকালো দাঁতে
প্রতিটি তালের গুণ দ্রুত হয় লয়ের আঘাতে
রসের সমুদ্র ধরে ভেসে যায় মৃদু সাম্পান

ঢেউ আর কাকে বলি? সে নিজেই নিভৃতচারিণী
পিঠের প্রতিটি ভাঁজে ফুটে ওঠে আঁচড়ের সুধা
রাত পারাপার শেষে আগুনের মতো আরো ক্ষুধা
জেগে থাকে লিঙ্গমূলে, যোনিটি তখনো থাকে ঋণী

যেন কতকাল আগে ভাসিয়েছে নাভিটি, নদীতে
স্রোতএসে নিয়ে গেছে যাবতীয় উপাসনা, কাম
গোপন সারথী যেন, নেমে আসে রতিমধ্যযাম
তাকেই সূচনা করে অবশেষে ভেঙে, শুষে নিতে

আগুন নিভছে তবু ধিকিধিকি জ্বলে আছে ছাই
এ আসলে কিছু নয়, প্রকৃতির আদিম লড়াই

রাস্তা 

কিছুদূর একা হেঁটে মনে হয় পাশে কেউ থাক
যতটুকু পারা যায় তাকেই সজীব করে রাখি
এমন নীরব দিনে কেউ এসে পালক ছড়াক
জীবনের কাছাকাছি ফিরে যাক শরাহত পাখি

গাছে গাছে ফুল আসে পাতাটির আড়ালে আড়ালে
আদরের ছায়াটুকু পড়ে থাকে হিতাহিত ভ্রমে
ফুরিয়ে গিয়েছে ঘ্রাণ এ যাবৎ ফেলে আসা কালে
যেভাবে ফুরিয়ে যায় ছড়ানো বিষাদ ক্রমে ক্রমে

কাকে আর ভুল বলি? তা আসলে ব্যথার প্রাচীর
উঁচুনিচু কুরুশের বুনে দেওয়া নরম স্তবক
যেভাবে হাতের মাঝে রেখাগুলি অবিরাম স্থির
মনে হয় আমি সেই আলোতে মিলিয়ে যাওয়া লোক

কিছুই থাকেনা শ্লেটে, শুধুমাত্র লিখে রাখি ধুলো
কিছুদূর একা হেঁটে মুছে ফেলি বাকি রেখাগুলো

--------

Post a Comment

1 Comments

  1. 'রাস্তা' কবিতাটি খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete