অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল
পর্ব-৬
স ন্দী প কা ঞ্জি লা ল
বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী
বুদ্ধিজীবী তাকে বলে যিনি বুদ্ধিকে ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ করে! বুদ্ধি কী? বুদ্ধি হল দ্রুত আয়ত্ব বা বিশ্লেষণের ক্ষমতা! 'জ্ঞান' হলো অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির সঠিক প্রয়োগ! আমরা ভাবি যার বুদ্ধি আছে তার জ্ঞান ও আছে। বুদ্ধি ও জ্ঞান একই শব্দ মনে করে আমরা গুলিয়ে ফেলি। জ্ঞানহীন বুদ্ধিমানেরা হচ্ছে আঁতেল। যারা নিজের বুদ্ধির বহর প্রমাণের জন্য নানা ফন্দি - ফিকির করে থাকে। আমাদের সমাজে এই সব লোকের ভাগ বেশি। যারা সোশ্যাল মিডিয়া কি ব্যবহারিক জীবনে আশেপাশের লোকজনকে উঠতে বসতে জ্ঞান দান করে জীবন ঝালাপালা করেন। তারা যেকোনো প্রকারে প্রমাণ করতে চান তারা জ্ঞানী।
সভ্যতার তাগিদে মানুষকে তার আদিম স্বভাব বহুলাংশে দমন করতে হয়। এই নতুন রূপ হলো তার সভ্য ও সামাজিক রুপ। এটি কিন্তু একটি মুখোশ। সে এই মুখোশ পরে নিজের কাছে এবং সমাজের কাছে পরিচিত। মানুষের এই সামাজিক পরিচিতিকেই 'ব্যক্তি আমি' বলা হয়। কিন্তু ব্যক্তি পরিচয়ের পিছনেও মানুষের এক অজ্ঞাত রূপ আছে। সমাজের মানদণ্ডে তা অসভ্য বা অধমরূপ। মানুষ সে রূপকে আড়াল করে রাখে। আর একেই বলা হয় 'গুপ্ত আমি'। 'ব্যক্তি আমি' এবং 'গুপ্ত আমি'-র মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক। আবার প্রত্যেক পুরুষের মধ্যে এক নারী সুলভ আচরণ, আবার প্রত্যেক নারীর মধ্যেও পুরুষ সুলভ আচরণ লুকিয়ে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে সেই রূপ প্রকাশ পায়! বুদ্ধিমানরা গুপ্ত আমিকে সারাজীবন বহন করে, প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য। আর জ্ঞানী মানুষেরা সেই গুপ্ত আমিকে শেষ করে, তার ভিতর এবং বাইরে একটাই 'আমি' তা হলো 'ব্যক্তি আমি'।
অনেকে বলেন, ও বুদ্ধিমান নয়। সে জ্ঞানী নয়। আসলে প্রত্যেকের মধ্যে বুদ্ধি ও জ্ঞান রয়েছে। তারা তার হদিস পায় না। যেমন ধরুন প্রত্যেকদিন আপনি একই রাস্তায় বাজারে যান। হঠাৎ আপনি জানতে পারলেন, ঐ রাস্তার বটগাছের তলে টাকার কলসি পোঁতা আছে। আপনি তখন সবার নজর এড়িয়ে ওখানে খুঁড়তে থাকবেন, টাকার কলসির লোভে। তাই কাউকে যদি জানানো হয়, তোমার মধ্যে বুদ্ধিও আছে জ্ঞানও আছে, সেও তা খুঁড়ে বের করবেই। এইজন্য প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষার।
একজন চোর অবশ্যই বুদ্ধিমান, তা না হলে তার ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। যে কোনো দুর্নীতিবাজ কিংবা চাটুকারদেরও বেশ বুদ্ধি, তারা তা ব্যবহার করে ক্ষমতা ভোগ করতে চায়, এরা বুদ্ধিকে ব্যবহার করে। তাহলে এদের কি আমরা জ্ঞানী বলবো? কখনোই না! জ্ঞান হলো প্রজ্ঞা, জ্ঞানী ব্যক্তি অবশ্যই প্রজ্ঞাবান, বুদ্ধিমান। যাদের মধ্যে এই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রজ্ঞা আছে সত্যিকার অর্থে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পৃথিবীর বুকে নিজের নাম অমর করে রাখার সুযোগ পান। যেমন, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ নানক, কবির, সার্ত্রে, এমিল জোলা আরও অনেক আছেন।
গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে 'জ্ঞান যোগ'এ জ্ঞানীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলছেন, " যস্য সর্বে সমারম্ভাঃ কামসংকল্পবর্জিতাঃ / জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ " [ ১৯ নং শ্লোক] যার বাংলা অর্থ হলো, যাঁর সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টা কাম ও সংকল্প রহিত, তিনি পূর্ণ জ্ঞানী।
জ্ঞানীরা অবশ্যই বুদ্ধিমান। কিন্তু যে সমস্ত বুদ্ধিমান জ্ঞানী নয়, বকধার্মিকের মতো ভালো কাজ করেন বটে, কিন্তু তাদের পেছনে কামনা ও বাসনা কাজ করে থাকে। অনেক জ্ঞানী মানুষ অবস্থার চাপে পড়ে খারাপ কাজ করলেও, সময় ও সুযোগ পেলে এমন ভালো কাজ করেন, পৃথিবীতে নতুন ইতিহাস তৈরি করে।
মানুষের বুদ্ধির মতো জ্ঞানও প্রাকৃতিক বিষয়। তবে বুদ্ধির চেয়ে জ্ঞানের স্তর অধিক উন্নত। আভিজাত্যময় ও বিরল। কারণ মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলে সে কিছু না কিছু বুদ্ধির অধিকারী হয়ে ওঠে এবং সময়ের বিবর্তনে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় মানুষের বুদ্ধির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। মানুষ কখনো পরিস্থিতির চাপে বুদ্ধিহীন হয়ে পড়ে অথবা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের জন্য কারও কারও বুদ্ধিনাশ ঘটে থাকে। আবার মানুষ কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায় যখন তার বুদ্ধির দরজা খুলে যায়। সে যদি সফলতা ও সম্ভাবনার মধ্যে থাকে তবে আরও অধিকতর সফলতা লাভের উপায়সমূহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার মস্তিষ্কে গিজগিজ করতে থাকে। অন্যদিকে সে বিপদাপন্ন হলে তা থেকে উদ্ধার কিংবা নিস্তার লাভের অভিনব উপায়সমূহ তার মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভাবন করে ফেলে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনোক্রমেই সম্ভব হয় না।
জ্ঞানী ব্যক্তি ও তার জ্ঞান সর্বদা সর্বজনীন হয়ে থাকে এবং অনাদিকালের ইতিহাসে তা অমরত্ব লাভ করে। পৃথিবীর সর্বকালের সব জ্ঞানী হুবহু এক কথা বলেছেন। যেমন প্রাচীনকাল অন্ধকবি হোমার যে মহাকাব্য রচনা করেছেন তার নীতিকথা ও আপ্তবাক্যের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে ভারতের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে।
মনে প্রশ্ন জাগে বুদ্ধি থাকলে সংসার জীবন সমাজ ভালোভাবে চলতে পারে। আবার জ্ঞানের দরকার পড়ে কেন? তাহলে বলতে হয় সক্রেটিস ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিলে পারতো! গ্যালিলিও না হলে আমরা আজও জানতাম সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। জ্ঞান না হলে কোনটা ভুল কোনটা ঠিক, আমরা বুঝতেই পারতাম না। বুদ্ধির পরিমাপ করা যায়, জ্ঞানের পরিমাপ হয় না!
বুদ্ধি থাকলে তুমি যে কোনো কাজে সফলতা পাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। বুদ্ধি যদি জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে সে বুদ্ধি বাস্তবে সফলতা অর্জন করে। যেমন একটি ঘুড়ি বানাতে বুদ্ধির দরকার হয়। ঘুড়ি বানানোর পর যখন সুতো লাগিয়ে ঘুড়িকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন লাটাই থাকে নিজের হাতে। এই লাটাইকে নীচের দিকে টানলে ঘুড়ি উপরে উঠবে। বুদ্ধি যদি ঘুড়ি হয়, সূতা জ্ঞান আর লাটাই হল মানুষ। অর্থাৎ জ্ঞান দ্বারা বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তা নাহলে সেই জ্ঞান কোনো কাজ করে না!
পৃথিবীতে দু' রকমের মানুষ আছে। একরকম, যারা সব কিছু গ্রহণ করে, দুই যারা সব কিছু দিয়ে দিতে পারে। বুদ্ধিমানের একটা অংশ যারা শুধুই গ্রহণ করে, মুখে বড় বড় কথা বলে, কিন্তু মল আর মূত্র ছাড়া কিছুই দেয়না, আর নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করতে নানা রকম ভেক ধরে। তারা খায় ভালো। যারা দিতে জানে, তাদের থাকে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ, একটি ইতিবাচক মনোভাব এবং তারা মুখে বড় বড় কথা না বলে বাস্তবে সমাজ সেবায় আগ্রহী, তারা প্রকৃত জ্ঞানী। তারা ঘুমান ভালো। আর যারা আঁতেল জাতীয় বুদ্ধিমান তারাও সমাজ সেবা করে, তবে তারা সমাজ সেবার নামে নিজেদেরই সেবা করে।
------
1 Comments
অসাধারণ ধারাবাহিক শুভেচ্ছা রইল, চলুক।
ReplyDelete