জ্বলদর্চি

হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা / পর্ব -৫


সু দ র্শ ন  ন ন্দী 

হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা  || পর্ব - ৫


পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল-নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে-
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।

প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আটচালা থেকে বের হত নগর কীর্তন। কীর্তন গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। সবাই জমায়েত হত আটচালায়।  তারপর খোল, করতাল নিয়ে হত গ্রাম প্রদক্ষিণ। কীর্তনের সেই মিঠে সুর শোনা যেত অনেকে দূর থেকে। সেই চোখে জল আনা কীর্তনের সুরের খোঁজ এখন তেমন আর পাই না। সস্তায় বাজিমাত ও ফাঁকিবাজ ফর্মুলার হিন্দি গানের সুরে যখন কীর্তনের সুর শুনে এখনও চোখে জল আসে, যেমন গ্রামের শোনা কীর্তনে আসত। এখনকার চোখের জল আসে কি ছিল, কি হল- এই ভেবে!

রান্নাবান্না হত কাঠের উনুনে। উনুনে হাওয়া দেবার জন্য ব্যবহার হত চোঙের পাইপ । মাটির হাড়ি ছিল। কলাই করা (সাদা) বাসনের চল ছিল বেশি। কাঁসার থালা ব্যবহার হত লোকজন এলে।  বর্ষাকালের জন্য কাঠ গোয়ালঘরের কাঠামোয় তোলা থাকত। গ্যাস তো দূরের কথা কয়লার চলও ছিল না। ঝরা পাতা বস্তায় ভরে কুড়িয়ে আনতাম বন থেকে। তা দিয়ে ধান সেদ্ধ হত। ঠাকুমা মুড়ি ভাজতেন খুব ভোরে উঠে। মকর পরবের সময় একপ্রকার মাঝরাত পর্যন্ত চলত পিঠেপুলির পর্ব। মকর পরবে আমরাও ছোটরা জেগে তুসু গান শুনতাম মেয়েদের সাথে। সকালে বাঁধে চৌদাল ভাসানোর সময় ঐ কনকনে শীতে হড়হড় করে জলে নামতাম চৌদালের ভেতরের ঝিলপি, নারকেল উদ্ধার করে গিলতে। স্নান সেরে নতুন জামা পরা, আগুন পোয়ানো,পিঠে খাওয়া, পয়সা খেলা ছিল নিবিড় আনন্দের।  
    তবে সে সময় শহরে  কাঠের উনুনের সাথে কয়লার উনুনও ছিল। বালতির মুখে মাটি দিয়ে বানানো উনুন। একটি ঘুঁটেতে ছাই রেখে কেরোসিন দিয়ে জেলে সেটিকে উনুনের মাঝে রাখা হত। এরপর মূল গায়কের পাশে দোহারের মতো পাশে থাকত আরও ঘুঁটে। কয়লা দেওয়া হত তার উপর । ঘুঁটের ছাই দিয়ে বাসন মাজা থেকে দাঁত মাজা সবই হত। খুব কম জিনিসই ফেলা যেত। অবশ্য এখনো কয়লা ব্যবহার অনেক জায়গায় রয়েছে। বিশেষ করে কোলিয়ারি অঞ্চলে।    

গ্রামে চাষবাস ছিল মূল জীবিকা। মুখ্য ছিল ধান চাষ। অনেক পান বরুজ ছিল গ্রামে । সেই পান ব্যবসাতেও অনেকে জড়িত ছিলেন। ব্যবসা হত দশ কিলোমিটার দূরের শহর বিষ্ণুপুরে গিয়ে। বেঙ্গল- নাগপুর রেলওয়ে তখন বিষ্ণুপুর দিয়ে গিয়েছে। মা সারদা এই স্টেশন দিয়েই কলকাতা যেতেন। বিষ্ণুপুর বাঁকুড়া জেলার একমাত্র মহকুমা শহর তখন। মল্লরাজাদের একদা শৌর্যবীর্যের রাজধানী।    

সেসব আজ যত ভাবি ততো উদাস হয়ে যাই নস্টালজিয়ায়। ভাবি এই তো সেদিন সব ছিল, কোথায় যেন সব হারিয়ে গেল। এভাবেই কি অতীত ভবিষ্যতের গর্ভে হারিয়ে যায়! হবে হয় তো!

-----

Post a Comment

0 Comments