জ্বলদর্চি

শঙ্খরাগের ছায়া / অলক জানা


খু কু ভূ ঞ্যা


ফুল কাঁটা মেঘ রৌদ্রের গন্ধ


কবিতা কী? আমরা কি কেউ তাকে দেখেছি?তার চোখ মুখ শরীর অথবা ছায়া? দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে হৃদয়ের গভীরে, স্নায়ুর ভেতর একটা কম্পন হয়। আলোড়ন হয়। তখন বাইরেটা শান্ত। ভেতরে ভাঙচুর।উত্তাল ঝড় প্লাবন। যন্ত্রণার গর্ভগৃহ থেকে বেরোতে চায় সৃজনের আলোবীজ। অক্ষর সেজে ওঠে প্রতিমায়।

কদিন আগে হাতে পেলাম কবি অলক জানার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ শঙ্খরাগের ছায়া। কবিতাগুলো বেশিরভাগই শূন্য মাঠের বেনাঘাসের মতো। বসন্ত দেখেনি কতদিন। ছায়া মাদুরে বসে রাতের পর রাত নুড়ির মতো কুড়িয়ে চলেছে অন্ধকার। ফুটে উঠেছে কবির বেকারত্ব ব্যর্থতা যন্ত্রণা আর গার্হস্থ্য জীবনের মেঘ রৌদ্র দিনলিপি।

'রাধা' কবিতায় দেখা যায়---

"সময় সূচকের কাঁটা প্রস্তাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে জীবন যৌবনের যাবতীয় তেরো খণ্ডের লীলা,
সংকেত কুঞ্জের বাতাসে এতো প্রাণ ! 
না বোঝার কী?
ছুটে আসার মধ্যে
অনেক দায় সে বুঝেছিল বলেই তার নাম রাধা।"

জীবন থেকে রৌদ্র খরচ প্রতিদিন। কিন্তু তৃষ্ণার বার্ধক্য হয় না কখনও। ষোলো আনা ইচ্ছে নিয়ে সে খনন করে চলে নদী। যে নদীর ঢেউ লাগে নিতান্ত নিভৃতে গোপনে। অথচ একটা স্বীকৃতি পেয়ে যায় হৃদয়ের পুর্নতার মহত্বে। সেক্ষেত্রে সার্থক হয়ে ওঠে রাধারূপী নারীটি, সার্থক প্রেমিক পুরুষের ভেতর।

'সঞ্জীবন' কবিতাটি একটু অন্যরকম। ছায়াচর থেকে উত্তরণ সঞ্জীবনী আলোর দিকে। যেমন--

"আমি হাজার জন্মের অসম্পূর্ণতা থেকে উচ্চারণ
করি: নিজেকে বিলিয়ে দেবার মধ্যে কোনো ক্ষয় নেই,
অশোভন কাঁটার প্রলাপ ফুল হয়ে যায়।"

অসম্পূর্ণতার ভেতরেই তো ঘুমিয়ে থাকে পথ। শুধু টের পেতে হয়। ইচ্ছেকে জাগ্ৰত করতে হয়। একসময় সমর্পিত হয়ে যায় শরীর মন। শুধু বিলিয়ে নেশা প্রত্যাশায় ক্লান্তির কথা মনে থাকে না। মনে পড়ে না, এতো আত্মঅপচয় দিয়ে কিবা হয়? যখন সমস্ত শ্রম ঘাম পরিশ্রম ফুলের বাগান সাজিয়ে বসন্তের ছয়লাপ।
সার্থক হয়ে ওঠে কবি।

"পাখি উড়তে শিখলে কেমন ভারমুক্ত হয়ে যায়
গাছ ও গাছের ডাল
সেভাবেই নিঃস্ব তারাহীন নাকাকলি, ঘষা কাঁচ
চশমা, সিগারেট অবশিষ্ট--একা একজন কবি।"
(কবি ও কবিতা)

কেউ কাউকে চিরকাল বহন করে না। শুধু একটা সময় পর্যন্ত--
অতঃপর নিজের জন্য তৈরি করতে হয়, সান্ধ্য আড্ডা। রাতের নৈঃশব্দ্য। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর নিজস্ব খেত মাটি। তার জন্য সংগ্ৰাম অবিরাম।এ লড়াই একমুঠো আলোর জন্য। নিজের মাটি ও শিকড়ের জন্য। এই যুদ্ধপথে কবি একা ও সঙ্গীহীন। অবশেষে থেকে যায় নিজস্ব পথের রেখা, আলো। একটুই প্রাপ্তি।

"চাকরি নেই, বেঁচে থাকার মতো দুটো পরিচিত
হাত আছে, আছে দুটো পা-ও,যা আমার বলে
দাবী করতে পারি। দৃষ্টিতে রঙ বদলের অনিবার্য
গত্যন্তর আমাদের জন্য ফুটপাত বা মোরাম মুছে
ঢালাই রাস্তার নিষ্ঠুরতা।"
(প্রস্তাবিত শব্দ)

কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে কবির বেকারত্বের যন্ত্রণা। বেঁচে থাকার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম। তবু কবি হার মানেননি। বুকে বল দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যান সামনের দিকে। ভোরের দিকে। এখানেই তিনি সার্থক কবি পুরুষ ও পিতা।

"সে কাব্য চিরদিনই অলিখিত থাক, মাঠে মাঠে ফসলের
কবিতা, নতুন স্বপ্নের নাভিপদ্ম হোক।"
(তুমি ব্যথা তুমি কোমল)

আড়ালই ঈশ্বর। কিছু গোপন নীরব যন্ত্রনায় লালন পালন করতেই হয় আগামীর বসন্তের জন্য। সেক্ষেত্রে কবির এই গোপন বাসনা পেয়েছে পূজার পুর্নতা। যা আগামীতে ভোরের উচ্ছ্বাস,আবহ--

"কোনো অন্তরায় ছিল না বলেই তো তার নাম নদী
হাসিতে ঢেউ লিখন, কথা হয়ে শুয়ে থাকে বাঁশের
কংকাল, সাঁকো।"
(নদী পেরোনোর গল্প)

ভেতরে মন যতটা ত্যাগী হতে পারবে তার নদী ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাবে নিজস্ব ঠিকানায়। বাধাহীন। সংকটহীন। পথ আটকে দাঁড়ালেই বাসনার ভেতর জন্ম নেয় শ্যাওলা।
তখন মরে যায় নিজস্ব নদীর গতিপথ।মৃত ঢেউয়ের কাঁপন আগলে কেবল চর চর সন্ধ্যা দেখা।

"তোমার জন্য কবিতা সাজাই,
এতেই অপার আনন্দ,কে কোথায় বাহবা কিংবা
গুজব রটায় পরোয়া করব কেন বলো?
যে পাগলটা বেঁচে থাকে সে আমার একান্ত শৈশব,
সেই তো হাসায়, কাঁদায়ও।"
(শৈশব)

এই যে 'তুমি'--মনে করি, সুন্দরের মেরুদণ্ড সে। সেই রঙ রূপ রস ওম। মেঘ রৌদ্র আলো অন্ধকার। দেখতে ঠিক মানুষের মতো নয়। কতকটা পাখির মতো, কতকটা নিরাকার। অথচ তার উপস্থিতি টের পায় একমাত্র কবি। কবিই জানে সে কেমন আনন্দ। কতখানি বেদনা। সে আছে বলেই বিঘে বিঘে শূন্যতাময় হৃদয়মাঠে এখনও পদ্ম ফোটে।ফোটে কৃষ্ণচূড়া। আনজনে বলে কলঙ্ক। তাতে কী যায়? প্রেম যদি চাঁদ নামায় কাঙাল উঠোনে আপনি খসে পড়ে কালোমুখের জিভ। প্রেমের প্রতিমা বুকে নিয়ে কবি এগিয়ে যায় বুকভর্তি বসন্ত সৌন্দর্যের দিকে। কবি হয়ে ওঠেন অজেয় এবং সার্থক প্রেমিক।
------------------------------------------
শঙ্খরাগের ছায়া---অলক জা না
প্রচ্ছদ -- কমলেশ নন্দ
প্রকাশক---কবিতিকা 
প্রথম প্রকাশ---২০১৯
মূল্য ---৭০ টাকা

Post a Comment

0 Comments