জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫

শ্যা ম ল  জা না


পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা এবং তাঁদের মতবাদ ও ছবি(১ম অংশ)

এই যে পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম-এর ব্যানারের তলায় ছোটো ছোটো একাধিক মতবাদের জন্ম হল৷ ওই মতবাদগুলির(Ism)সঙ্গে তার স্রষ্টা যে প্রতিবাদী শিল্পীরা, এই দুইয়ে মিলে এক-একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলে, মতবাদটি ও তার শিল্পীকে একসঙ্গে বোঝানো সম্ভব হবে সহজে৷ তবে, সব ইজম্ ও সব শিল্পীর আলোচনা এখানে সম্ভব নয়৷ তাই, যেগুলি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলির মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হল৷

পল সেজাঁ ও স্ট্রাকচার অফ পিকটোরিয়াল ফর্ম

পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনায় ও ছবি আঁকায় সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন সেজাঁ৷ আরও বলা ভালো— বিংশ শতাব্দীর আধুনিক শিল্পকলায় পথ প্রদর্শক ছিলেন পল সেজাঁ।একাধিক বহু মৌলিক চিন্তা-ভাবনার সা্হায্যে একাধিক ইজম্-এর সূত্রপাত করেছেন৷ ইম্প্রেশনিস্টরা যেভাবে প্রকৃতিকে দেখতেন, তিনি সেভাবে দেখতে চাইলেন না৷ তিনি নিশ্চিতভাবেই বললেন— প্রকৃতি বা তার ল্যান্ডস্কেপ সবটাই এক সহজ জ্যামিতিক উপাদান দিয়ে গঠিত৷ আমার উদ্দেশ্য হল স্থায়ী গড়ন নির্মাণের।আমি বিশ্বাস করি যে, সব কিছুতেই যদি আমরা রঙকে দেখতে পাই তাহলে রঙই গড়ন তৈরি করতে পারে এবং আলো-ছায়াও সৃষ্টি করতে পারে। রং বোঝাতে পারে দৃশ্যের গভীরতা, দূরত্ব, এবং রঙই আনতে পারে গড়ন ও ঘনত্ব৷

বহু মাস বহু বছর ধরে সেজাঁ প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করলেন তাঁর প্রচণ্ড মেধা এবং তীক্ষ্ণ একাগ্রতা নিয়ে।ফল-স্বরূপ সেজাঁ আবিষ্কার করলেন—  রেখা সমতল৷ রঙের গুণাগুণ৷  তাদের একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক৷ রৈখিক গতিপথের বিভিন্ন প্রভাব৷তার তলের গভীরতা সৃষ্টির ক্ষমতা৷ রঙের চরিত্র, বিশেষ করে তার গভীরতা এবং তলের উপর তার প্রভাব!শীতল রঙ(চাঁদকে কেন্দ্র করে যে রং, নীল ও তার অনুসারি রঙগুলিকে শীতল রং বলে)-কে কমিয়ে উষ্ণ রঙ(সূর্যকে কেন্দ্র করে যে রং, লাল ও তার অনুসারি রঙগুলিকে উষ্ণ রং বলে)-কে বাড়িয়ে তিনি ছবিতে ওজন এবং গভীরতার পরিবর্তন আনতে সক্ষম হলেন৷রঙের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রয়োগ  করে তিনি গড়নের শ্রেষ্ঠ অবয়ব আনতে সক্ষম হলেন। বর্ণ প্রয়োগেও সেজাঁ যুগান্তকারী উপলব্ধির প্রকাশ ঘটালেন। তিনি বর্ণের তারতম্য ঘটিয়ে বস্তুর ঘনত্ব ও দূরত্ব সৃষ্টি করলেন।যাকে বলি আমরা বাইনোকুলার ভিসন বা পার্সপেক্টিভ৷ এইসব মেধাবী কৌশলের ফলে সেজাঁর ছবি হয়ে উঠল একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যময়৷ যা তাঁর ইম্প্রেশনিস্ট বন্ধুদের থেকে একেবারে আলাদা!(ছবি-১)

জর্জেস স্যুরা ও নিও ইম্প্রেশনিজম, পয়েন্টিলিজম, ও ক্রোমো-লুমিনারিজম বা ডিভিশনিজম

জর্জেস স্যুরার বিখ্যাত পেন্টিং “এ সানডে আফটারনুন অন দা আইল্যান্ড অফ লা গ্র্যান্ড জাতে” থেকেই নিও ইম্প্রেশনিজম-এর জন্ম হয়৷(ছবি-২) 

১৮৮৬ সালে নামকরণটি করেছিলেন— ফ্রেঞ্চ শিল্প সমালোচক ফেলিক্স ফেনেওঁ৷

স্যুরাই প্রথম ইম্প্রেশনিস্টদের আলোর থিওরি সম্পূর্ণ মেনে নেননি৷ তিনি বিষয়টিকে আরও নির্দিষ্ট করতে চেয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন— প্যালেটে রং না মিশিয়ে বা ক্যানভাসে তুলি দিয়ে ঘষে ঘষে রং না মিশিয়ে প্রতিটি রঙকে আলাদা আলাদা মোটা মোটা তুলির পোঁচ(Stroke)দিলে ও ক্যানভাসে তারা আলাদা আলাদা অবস্থান করলে, ছবির ঔজ্জ্বল্য ও গভীরতা অনেক বৃদ্ধি পায়, ঠিক কথা৷ কিন্তু বিষয়টি আরও নির্দিষ্ট হওয়া দরকার৷নিও ইম্প্রেশনিজম-এ তিনি এ কথাই বললেন৷ বললেন, রঙের পোঁচগুলির পরিমাপ কী রকম হওয়া উচিত? আমি মনে করি, পোঁচগুলি যত ছোটো হবে, এবং কেউ কারোর সঙ্গে যদি না মেশে, স্বতন্ত্র হয়, তাহলে ছবির ঔজ্জ্বল্য আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে৷ শুধু তাইই নয়, ছবির ডিটেলও বৃদ্ধি পাবে৷ তিনি পোঁচের বদলে বিন্দু ব্যবহার করলেন, যেহেতু বিন্দু পোঁচের চেয়ে অনেক ছোটো(এখান থেকেই পয়েন্টিলিজিম-এর জন্ম হল)(ছবি-৩)৷ 

শুধু তাইই নয়, তিনি বিভিন্ন রঙের যে স্বতন্ত্র বিন্দুগুলি দিলেন, তারও একটি বৈজ্ঞানিক বিভাজন করলেন(এখান থেকেই ক্রোমো-লুমিনারিজম বা ডিভিশনিজম-এর জন্ম হল)৷ এতে কোনো দর্শক দূর থেকে যদি ছবিটা দেখে, তাহলে ওই রঙের বিন্দুগুলি স্বতন্ত্রভাবে তাদের চোখে ধরা পড়বে না, অপটিক্যালি ব্লেন্ড হয়ে মিশ্রিত অবস্থায় তারা দেখতে পাবে৷ এতে ছবিতে যে উজ্জ্বলতা আসে, তা প্যালেট ও তুলি দিয়ে মেশানো রঙে আসে না! (ক্রমশ)

                                   


Post a Comment

1 Comments

  1. পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী ও তাদের রঙের ব্যবহারিক গুণে কি ভাবে এক একটি ইজম্ তৈরি হচ্ছে এবং ব্যাকরণের ব্যবহারে কি ভাবে এক একটি চমৎকার মূর্ছনা তৈরি করে
    গেছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। শ্যামল অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে তার গবেষণা লব্ধ অভিজ্ঞতা বর্ণমালার গেঁথে দিচ্ছে
    পাঠকের জন্য। আমি অভিভূত।ধন্যবাদ।

    ReplyDelete