অ নি ন্দি তা শা স ম ল
ঝড়ের পাখিকে আত্মকথা
কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী এবং জ্বলদর্চি পত্রিকা, বাংলা সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিনের উজ্জ্বল দুটি আলোকস্তম্ভ। সেই জ্বলদর্চি পত্রিকার মাননীয় সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীর একটি কাব্যগ্রন্থ -- 'ঝড়ের পাখিকে আত্মকথা'। অসাধারণ নাম ও সুন্দর প্রচ্ছদের ওপর ভালোলাগার আলতো স্পর্শ দিয়ে পাতা উল্টে উৎসর্গপত্রে চোখ আটকে গেল। কতবার যে পড়লাম হৃদয়ের মধুর কথাটি! 'যার সঙ্গে রোজ ঝগড়া হয়'! নিরবচ্ছিন্ন একঘেঁয়ে ভালোবাসা যে প্রাণময় বেঁচে থাকে, সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা অভাব অভিযোগ চাওয়া পাওয়ার টানাপোড়েনের মাঝেও, খুনসুটি আর একে অপরের প্রতি মমত্ববোধে -- তার প্রকাশ যে থাকবেই প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে এইটুকু বুঝে গেলাম উৎসর্গের এই লাইনেই।
যাঁদের কাছে কবি এই কাব্যগ্রন্থটির ঋণস্বীকার করেছেন, তাঁদের নামগুলো পড়ে শ্রদ্ধায় মাথা নত হল যেমন তাঁদের প্রতি, তেমনই চোদ্দ বছর আগের এক তরুণ কবির প্রতি -- চলার পথে বিশিষ্ট কবিদের ঋণ তিনি মনে রেখে তাঁদের সম্মানিত করেছেন বলে।
এবার আসি কবিতার প্রসঙ্গে।
"-- ভাবছি কোত্থেকে শুরু করি
--'ভাবনার কী আছে! আজ থেকে শুরু হোক অন্য ইতিহাস"
"-- কী হবে সেসব শুনে
তুমি কী ভাবো একাই সৈনিক
যুদ্ধ শেষে ফিরেছে একা একা
তবে শোনাও : ঝড়ের পাখিকে আত্মকথা।"
আহা ! কী অপূর্ব মুখবন্ধ দিয়ে শুরু করে একের পর এক কবিতার মালাগাথা -- এক (১) থেকে তিপান্ন (৫৩)। গভীর উপলব্ধি থেকে উঠে এসেছে প্রেমিকার প্রতি সম্বোধনে কত না জীবনবোধের কথা --
"--- স্তব্ধ হোক সমস্ত কথা
অন্ধ হোক চিন্তারাশি, শ্বাস
অস্থিতে অস্থিতে গড়ে গেছে সেতু
জন্ম থেকে অনন্ত জন্মান্তরে... "
অথবা,
"--- সমস্ত না লেখা কথা হোক প্রণত বিশ্বাস
আমি তার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াব
মানুষ যেভাবে এবং যে কারণে
দাঁড়াতে চায় নিজের মধ্যে"
সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও সোচ্চার প্রতিবাদ কবির--
"-- অদ্ভুত শোনালে ! এই শ্রেণিবিভাজনের মানে কী!"
মিষ্টি প্রেমের কথোপকথনে মুগ্ধ হলাম ৮ সংখ্যক কবিতায়, যার শেষ লাইনে লেখা --
"রোজ তুমি একটি কবিতা আঁকো
বৃষ্টি ভেজার শেষে নাম দিয়ো তার কাজল।"
একজন কবির সবচেয়ে প্রয়োজন একান্ত নিজের একটুকরো সময় আর গভীর পর্যবেক্ষণের অন্তর্দৃষ্টি। ১১ সংখ্যক কবিতায় সেই উপলব্ধির প্রকাশ --
"একজন মানুষের ভিড়ের যেমন প্রয়োজন
তেমনি প্রয়োজন একেবারে একা থাকারও"
কাব্যগ্রন্থের একের পর এক পাতা উল্টে আশ্চর্য বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় পড়লাম প্রতিটি কবিতা --কবির কী অসম্ভব সুন্দর গভীর ভাবনা আর পরিণত মনের অভিব্যক্তি!
"-- অমীমাংসিত কথারা সব প্রণত বিশ্বাস
আগুনের আগুন, এক নিঃশ্বাসে
বলে দেব আজ।"
চারিদিকে এত রক্ত এত ধ্বংস এত আগুন! তার মাঝে থেকে, সব সংকীর্ণতা আর স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রেমিকমন এমন করেই প্রিয়াকে বলতে পারে ---
"--এবার থেকে পৃথিবীকেই ভালবেসো
তোমার মতো করে
পৃথিবীর যেটুকু অংশে আমি
তাতেই আমার হবে
---সেখানেই আলো ঝরুক
আমার আলো আমার পৃথিবী ছোটো হোক সেখানেই থেকো
মায়া হয়ে স্বপ্ন হয়ে জীবনেরও থেকে দূরে শুধু ভালোবেসো।"
(শেষ কবিতা, ৫৩ সংখ্যক )
পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্নেহ মমত্ববোধ -- এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মতো, শব্দের মতো চিরস্থায়ী হয়ে বেঁচে থাক। সব কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটে উঠুক, সৌরভ ছড়াক। প্রিয় কবির কবিতাময় অনন্ত যাত্রাপথে আমার প্রাণভরা শুভেচ্ছা থাকলো ।
পরিশেষে বলি, চোদ্দ বছর আগে লেখা কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কাব্যগ্রন্থ 'ঝড়ের পাখিকে আত্মকথা' আমার হাতে এসে পৌঁছেছে কিছুদিন আগে। চোদ্দ বছর আগের সেই সময়ে দাঁড়িয়েই বইটির আলোচনা তুলে ধরলাম পাঠকের কাছে। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করেছিলাম, পড়ার শেষে মন পূর্ণ হয়েছে। এত বছর পরে, সেদিনের সেই তরুণ কবির সঙ্গে আজকের প্রাজ্ঞ কবি ও সফল সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীর অনেক পার্থক্য। কতরকম বিষয়কে ছুঁয়ে যাওয়া তাঁর কী অসামান্য সব কবিতা, গদ্য পড়ি কত নামী পত্র-পত্রিকায়। জ্বলদর্চি পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখকদের অসামান্য সব ধারাবাহিক প্রকাশ করছেন কবি ও সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী, দেখে মুগ্ধ হই, ঋদ্ধ হই। কবির প্রাণের প্রিয় এই পত্রিকার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। কবির কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা।
-------------
ঝ ড়ে র পা খি কে আ ত্ম ক থা
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রথম সংস্করণ - জানুয়ারি ২০০৬
প্রচ্ছদ - হেমন্ত সাহু
জ্বলদর্চি /৫০.০০
1 Comments
সুন্দর প্রাণময় আলোচনা।
ReplyDelete