জ্বলদর্চি

রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত মেদিনীপুরের শিল্পী


রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত মেদিনীপুরের শিল্পী

ভা স্ক র ব্র ত  প তি

আমাদের মেদিনীপুর, আমাদের গর্ব। এই মাটি অনেককেই দিয়েছে খ্যাতি। দিয়েছে ভালোবাসা। শুধুমাত্র হাতের কাজের শিল্পকর্ম করে বিরল রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন মেদিনীপুরের বীর সন্তানেরা। অনেকেই জানি না তাঁদের নাম, তাঁদের কথা। অথচ, কি অসম্ভব লড়াই, অধ্যবসায় আর পরিশ্রম করে তাঁরা শিল্পসুষমা পল্লবিত করে ভারতের মহান রাষ্ট্রপতির হাতে সম্মানিত হয়েছেন।
গৌরী চিত্রকর -- ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের হাত থেকে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। গৌরীর আসল নাম গােফুরান বিবি। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের নির্ভয়পুর গ্রামের এই বৃদ্ধা পটুয়া পটচিত্রে নরমেধ যজ্ঞ এঁকেছিলেন। যার জন্য পেয়েছিলেন এই অনন্য সম্মান। সেই সুষমামণ্ডিত পটচিত্রটি এখনও আছে দিল্লির মিউজিয়ামে। গৌরী চিত্রকর ১৯৮২ তে রাজ্য লােকসংস্কৃতি উৎসবে প্রথমবার বিশেষ পুরস্কার পান কৃষ্ণলীলার পট এঁকে। ১৯৮৪-৮৫ তে রাজ্য কারুশিল্প প্রতিযােগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও রাজস্থান, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদে পেয়েছেন সম্মান। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই পটশিল্পীকে দিয়েছিলো এক লক্ষ টাকা অনুদান। কয়েক বছর আগেই তিনি মারা গিয়েছেন।
পুষ্পরাণী জানা -- পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের মাদুরশিল্পী পুষ্পরাণী জানা ১৯৮২ তে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে যখন তিনি পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন গর্ভবতী। মসলন্দ মাদুর তৈরি করেই তাঁর এই উত্তরণ। মূলতঃ স্বামী অভিরাম জানার অনুপ্রেরণায় মাদুরকাঠিকে যাদুকাঠিতে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। মােট ৪ বার রাজ্যের সেরার পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৮-৭৯ তে দ্বিতীয় স্থান, ১৯৭৯-৮০ তে প্রথম স্থান, ১৯৮০-৮১ তে প্রথম স্থান পেয়েছে। এছাড়া ২০০১ এ WORLD CRAFTS COUNCIL ASIA PACIFIC REGION-এ দ্বিতীয় স্থান পান।
আনোয়ার চিত্রকর -- ২০০৬ তে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন অনবদ্য পটচিত্র অঙ্কনের জন্য। তিনি পটচিত্র চণ্ডীমঙ্গলের দৃশ্য এঁকেছিলেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়াতে বসবাস আনােয়ার চিত্রকরের। তাঁর দুই বােন স্বর্ণ ও সুষমা এ রাজ্যের দুই বিখ্যাত পটিদার। মুম্বাইয়ের 'প্রিন্স অব ওয়েলস' মিউজিয়ামে রাখা আছে ‘চণ্ডীমঙ্গল'এর পটটি। বর্তমানে এই মিউজিয়াম 'ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সংগ্রহশালা' নামে পরিচিত। দিল্লির মেট্রো স্টেশনে, মুম্বাই এয়ারপাের্টে, লণ্ডনের অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে আনোয়ার চিত্রকরের বহু ছবি সংগৃহীত রয়েছে। তিনি পটচিত্রের সুবাদে ২০১২ তে আই.টি.পি.ও. ফেষ্টিভ্যালে যােগ দিতে জার্মানী এবং ২০১৩ তে ইন্দো-জাপান ফেষ্টিভ্যালে যােগ দিতে জাপান গিয়েছিলেন। 
গৌরাঙ্গ কুইল্যা -- সামান্য পাট দিয়ে যে অপূর্ব শিল্পকর্ম বানানাে যায়, তা দেখিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবসান গ্রামের গৌরাঙ্গ কুইল্যা। এ ধরনের ব্যতিক্রমী শিল্প তাঁরই আবিষ্কার। যা আগামী পাঁচ বছরে বিশাল আকার নেবে। সেই পাট, পাতা, কাগজ দিয়েই তিনি বানিয়েছিলেন অপূর্ব শিল্পকর্ম। কোনও রঙ ছিলনা তাতে। তমলুকের চারটি প্রসঙ্গ হিউয়েন সাং, বর্গভীমা মন্দির, তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি ও মাতঙ্গিনী হাজরাকে একই ফ্রেমে ফুটিয়ে তুলে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। ২০০২ সালে এ.পি.জে আব্দুল কালামের হাত থেকে নিয়েছেন সেই সম্মান। এহেন গৌরাঙ্গ কুইল্যা আজ এ রাজ্যের পূজা কমিটিগুলির কাছে অতি পরিচিত নাম। যাঁরা শৈল্লিক মানসিকতার পূজারী তাঁরা শ্রদ্ধা করেন গৌরাঙ্গকে। ইতিমধ্যে স্পেন, চায়না, রােম, কুয়েত, আমেরিকা, প্যারিস, ইটালি, জার্মানী গিয়েছেন তাঁর নিজের আবিষ্কৃত জুট হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট এর সম্ভার নিয়ে। আজ এ রাজ্যের বহু শিল্পী অনুসরণ এবং অনুকরণ করেন গৌরাঙ্গের কাজকে। এতে তিনি গর্বিত। এর পাশাপাশি নানা ধরনের সমাজসেবা মূলক কাজে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রাখতে ভালোবাসেন। সাধারণ দুর্বল দুঃস্থ অসহায়দের মাঝে তিনি চলে যান নিজের মনের তাগিদেই। সম্প্রতি স্পেনে গৌরাঙ্গের তৈরি 'ভবানীপুর অবসর' এর প্রতিমা স্থান পেয়েছে মিউজিয়ামে। 
গুরুপদ চিত্রকর -- পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা থানার নয়া-র গুরুপদ চিত্রকর পটচিত্র এঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন ২০০০ সালে। প্রকৃত নাম জুম্মন। পটুয়াদের গ্রাম নয়াকে আলােকিত করেছেন তিনি। আরেক রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্ত পটুয়া গৌরী চিত্রকর হ'লেন গুরুপদর দিদি শাশুড়ি। গুরুপদর প্রকৃত বাড়ি সবং থানার পেরুয়া গ্রামে। গতানুগতিক রঙের পাশাপাশি এখন 'বাংলা নাটক ডট কমে'র সহায়তায় প্রাকৃতিক রঙ ব্যাবহার করছেন পটচিত্র অঙ্কনের জন্য। পটচিত্র সম্ভার নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়া ঘুরেছেন স্পেন, ইটালি, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যালিফোর্নিয়া, লণ্ডন, নিউ মেক্সিকো ইত্যাদি স্থানে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে এক লক্ষ টাকা সাম্মানিক দিয়েছিলো তাঁর শিল্পকর্মের জন্য। 
অলক কুমার জানা -- ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন মাদুর শিল্পে অসামান্য দক্ষতার জন্য। সবংয়ের সারতা গ্রামের বাসিন্দা অলককুমার জানা। এ গ্রামের গর্ব। এর আগে এখানে পুষ্পরানী জানা পেয়েছেন একই পুরস্কার। ২০১৪ সালে অলকবাবু হ্যান্ডিক্র্যাফট এর প্রতিনিধি হিসেবে জিম্বাবােয়ে গিয়েছিলেন। অসংখ্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী ১৯৯৪-৯৫ তে রাজ্যের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, ১৯৯২-৯৩ তে দ্বিতীয় স্থান পান। ক্ষুদ্র ও ছােট উদ্যোগ অধিকার কর্তৃক আয়ােজিত প্রতিযােগিতায় ২০০৭-০৮ এ প্রথম স্থান, ২০১০ এ ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অব টেক্সটাইলস এর আয়ােজিত প্রতিযােগিতায় তৃতীয় স্থান পেয়েছেন। মসলন্দ মাদুর বানিয়ে তিনি আজ প্রােথিতযশা। জেলার প্রতিযোগিতাতেও তিনি বেশ কয়েকবার প্রথম হয়েছেন।
সরযুবালা গিরি – ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন মাদুরকাঠির অপূর্ব শিল্প নৈপুণ্য দেখিয়ে। পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগর-১ নং ব্লকের হলদিয়া-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের খােলাবেড়িয়া গ্রামের সরযুবালা গিরিকে আজ অনেকেই চেনেনা। সরকারি উদাসীনতা আজ গিলে খেয়েছে তাঁর স্বপ্ন। মাদুর শিল্প ও শিল্পীদের দশা বেশ ভয়ঙ্কর। এই দুঃখ কুরে কুরে খায় শিল্পী সরযুবালা গিরির মনকে। তাঁর স্বপ্ন, এই রুগ্ন শিল্পকে বাঁচাক সরকার। 

রজনী চিত্রকর -- ১৮৯২ এর ১১ ই ফেব্রুয়ারি সুতাহাটার আকুবপুর গ্রামে জন্ম রজনী চিত্রকরের। যদিও তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলীর আরামবাগে। কিন্তু মহিষাদলের রাজা দেবপ্রসাদ গর্গ ঐতিহ্যবাহী রথের রঙ করার জন্য এঁদের পূর্বপুরুষদের এখানে আনয়ন করেছিলেন। সেই থেকে এখানে বসবাস। রজনীর মায়ের নাম তরঙ্গিনী চিত্রকর। বাবা উমাচরণ চিত্রকরের হাত ধরেই তাঁর পটশিল্পের প্রতি আগ্রহ। পেটের তাগিদে আকুবপুর থেকে চলে যান কালীঘাটে। কালীঘাটের পটশিল্প ধারার সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে ওখানে থাকাকালীনই। মাটির পুতুল ও পট তৈরি শুরু করেন কালীঘাটের বুকে বসেই। ধীরে ধীরে কালীঘাটের পটের মধ্যে একটা মৌলিক ধারা জারি করলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে ১৯৫৪ এর ২ রা মে স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা হোলো 'দ্যা লাস্ট পটুয়া অফ কালীঘাট'। কেননা, ১৯৩০ সালেই কালীঘাটের পটের ঘরানা পুরোপুরি খতম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি বজায় রেখেছিলেন নিজের তাগিদেই। ১৯৬৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারি তাঁকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন তুলে দেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তিনিই মেদিনীপুরের প্রথম শিল্পী, যিনি এই বিরল সম্মান পেয়েছেন। একসময় নিজের গ্রাম আকুবপুরে তিনি পৌরাণিক পটচিত্রের বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে চিত্রকর সভার অধিবেশনে তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। আজ তাঁর গ্রামে তার বংশের দুজন মাত্র এই ধারাটুকু বজায় রেখেছে টিমটিম করে।

Post a Comment

1 Comments