জ্বলদর্চি

হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা - ৭


হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা || পর্ব-৭

 সু দ র্শ ন  ন ন্দী  

রাখে হরি মারে কে!

কখনো গ্রাম কখনো শহরে বড় হচ্ছি। গাছপালা-পাখি-প্রজাপতি, গরু-মোষ-ছাগল-কুকুর, পুকুর-খাল-বিল-মাঠ-ঘাট, হাঁস টু হায়না সবার সাথেই। আমার বয়স তখন আড়াই বৎসর। সেই আড়াই বৎসরের জীবন মরণের একটি ঘটনা এই ষাট বছর পরেও আমার চোখে-মনে ভাসছে স্বচ্ছ ভাবেই। গ্রামের বাড়িতে আছি তখন।  আমার  কত্তামা মানে ঠাকুমা সবাইকে পইপই করে বারণ করে দিতেন আমাকে একা ঘরের বাইরে না ছাড়তে। কটা হায়না কদিন খুব ঘুরঘুর করছে। ঘরের লেঠেল তিতা খয়রা হায়নাগুলোকে কদিন তেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। তবুও তারও সতর্ক বাণী, বড্ড চালাক হায়নাগুলান; ফাঁক পেলেই ছোট ছ্যানাপুনা তুলে লিয়ে চল্যে যাবেক দিদি। সাবধান!

কিন্তু হায়নার থেকে বেশি বিপদের  মৃত্যুফাঁদ যে ঘরের মাটির দেওয়ালের ওপাশের গ্যাঁড়াটি (ছোট্ট পুকুর) তা কে জানত! আমার ছোট পিসির বয়স তিন বছর। সেও পতঙ্গপুরে বড় হচ্ছে। আমার একমাত্র খেলার সঙ্গী, হরিহর আত্মা। তা সেদিন দুপুরে খেলতে খেলতে দুজনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে বাঁশতলায় গিয়ে বালি নিয়ে খেলছি। ঠাকুমা ঘরে ছিলেন না। মা রান্নাঘরে।  বাবা, কাকা জ্যাঠা সব জমিতে চাষের কাজে। চারিদিকে শুনশান। কটা বক উড়ে গেল। গরমে দুটো শালিক ঝিমোচ্ছে তেঁতুল ডালে। দূরের মাঠ থেকে ঘুঘুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শুধু। পিসি বলল-চল গ্যাঁড়াতে জল নিয়ে আসি। এবারে রান্না রান্না খেলব। সে আমায় হাত ধরে গ্যাঁড়ার পাড়ে নিয়ে এল। পুরো ঢালু পাড়, মোরাম  কাঁকরে ভর্তি।  তিন বছরের বিচ্ছু পিসি আমাকে সামনে রেখে বলল তুই নাম আগে। নাকে আমার সিকনি গড়াচ্ছে ফলসের মতো। বা হাত দিয়ে ল্যাপটে মুছি। এবার তার কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতো আমি যেই এক পা এগিয়েছি অমনি গড়গড় করে গড়িয়ে  গ্যাঁড়ার সোজা গভীর জলে পড়ে গেলাম। একশ আশি ডিগ্রি চিৎপটাং, মরার শেষ এপিসোড।  এই যে আমি পড়লাম সে ঘটনা আমি পরিষ্কার মনে করতে পারছি। ডুবেই জল খেতে থাকি, এতো কষ্টেও লক্ষ্য করলাম, পুচকে বা মিচকে সেই পিসি দৌড়ে ঘরের দিকে চলে গেল। আমি জল খাচ্ছি, ছটপট করছি, প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে দম বন্ধ হয়ে । হঠাৎ লক্ষ্য করি ঠাকুমা পাড় থেকে দৌড়তে দৌড়তে চিৎকার করছেন- আমার ছ্যালা ডুবে গেল গো, কে আছ বাঁচাও, বাঁচাও…। এরপর আমার কিছু মনে নেই।

 পরে ঠাকুমা বলেছিলেন- আমি চিৎকারের পরই দেখি তুই জলের নীচে ডুবে গেলি। আর খুঁজে পেলাম না। আমি  ঐ সময় মণ্ডলদের ঘরে গোটা পান আনতে গিয়েছিলাম। তখন বাড়ি ফেরার কথা নয় আমার । কি মনে হয়েছিল  চলে আসি ওদের ঘর থেকে। আবার  পিছনের দরজা দিয়ে সব সময় ঘরে ঢুকি আমি, সে সময়  গ্যাঁড়ার পাড় দিয়ে হেঁটে ঘুরে সামনের দরজা দিয়ে  ঢুকছিলাম।

আমি অবাক হয়ে আজও ভাবি, এর কোনটি অন্যথা হলেই আমাকে উনি দেখতে পেতেন না বা চিৎকার করতে পারতেন না। আবার ঐ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ভেসেছিলাম বলে তিনি আমায় দেখতে পান, তারপর ডুবে যাই। অর্থাৎ কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে ঠাকুমা ঐ রাস্তায় এলেও তিনি আমাকে দেখতে পেতেন না কারণ আমি জলের তলায় তখন। এতো গেল একদিক। কিন্তু আমাকে বাঁচাবে কে? ঘরে পুরুষ মানুষ নেই। আমিও আর ভেসে নেই। ঠাকুমার চিৎকার শুনে আমার এক কাকা বাইরে বেরিয়ে আসেন। ওনার শরীর খারাপ হওয়ায় উনি সেদিন জমিতে চাষের কাজে যান নি। কাকা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে ঘরে থাকা মাছ ধরা জাল নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় পুকুর নেমে পড়েন।  ছেঁকে ফেলেন সারা পুকুর। পাড়ে তখন অনেকে এসেছেন । সেই জালে আমি উঠি মাছের মতোই। শুনেছিলাম “মৃত” আমি, আমার পালস, জ্ঞান ছিল না, এক কলসি জল বের হয় আমার পেট থেকে। শেষ পর্যন্ত যমরাজ হেরে যান। মানুষের জীবন সুতোর উপর ঝুলছে। কখনো সুতো ছিঁড়েও সে বেঁচে যায়, এ এক অতি আশ্চর্য ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। রাখে হরি মারে কে!

                                  

Post a Comment

0 Comments