জ্বলদর্চি

চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গে অবিভক্ত মেদিনীপুর


চলচ্চিত্র অনুষঙ্গে অবিভক্ত মেদিনীপুর

ভা স্ক র ব্র ত  প তি 

বাংলা চলচ্চিত্র এখন ক্রমশ তার কৌলিন্য হারাচ্ছে। এক সময়ের রমরমা জাত্যাভিমানে সেই জোয়ার নেই আজ। সর্বত্র যেন ভাটার টান। স্বাভাবিকভাবেই দর্শকের মনোরঞ্জনে বদলে ফেলতে হচ্ছে ছবির গঠনশৈলী। একসময় যেভাবে ছবি তৈরি হত, তাতে এখন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েছে। শুধু স্টুডিও নির্ভরতা কাটিয়ে কলকাতার বাইরে বিশেষ করে ভিনরাজ্য বা বিদেশ বিভুঁইয়ে ছবির শুটিং এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আর চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে শুটিংয়ের জন্য বেছে নিতে হয় জেলা গুলির বিভিন্ন স্পটকে। এ সবই বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য। কখনও ছায়াছবির পুরাে পটভূমি, আবার কখনও বা স্রেফ কয়েকটা দৃশ্যের জন্য প্রয়ােজন পড়ে জেলার লােকেশন।
সেই হিসেবে মেদিনীপুর তথা পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলা নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে চলচ্চিত্র জগতের সাথে। এখানকার ভূপ্রকৃতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবন বহু চলচ্চিত্রের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। দুই মেদিনীপুরের বেশ কিছু রাজবাড়ির সাথে নানা চলচ্চিত্রের নাম এখন অমর হয়ে রয়েছে। ১৯৬৭ সালে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছায়াছবির জন্য জাড়া রাজবংশের রায়বাড়ির দুর্গাদালান ও তার সামনের নাটমন্দিরের ছবি তুলে ব্যবহার করা হয়েছিল। এতে অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং উত্তমকুমার। ভােলা ময়রার সাথে বিখ্যাত কবির লড়াইয়ের সেই গানের দৃশ্যে দেখা যাবে এখানকার ছবি। সত্যজিৎ রায়ের একান্ত বিশ্বস্ত ফটোগ্রাফার নিমাই ঘােষ ১৯৮২ সালে জাড়াতে দুর্গাপূজার আলোকচিত্র তুলেছিলেন একটি ডকুমেন্টরী ফিল্মের জন্য। প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'তেলেনাপােতা আবিষ্কার' অবলম্বনে 'স্বপ্ন নিয়ে' ছায়াছবির বেশ কিছু অংশের শুটিং করা হয়েছিল জাড়া রাজবাড়ির মধ্যে ও কাছারী বাড়িতে। এই রাজবংশের জামাই খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে ও সহযােগিতায় পরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রী, নায়ক অরুণ কুমার মুখােপাধ্যায় ও যন্ত্র কুশলীদের এনেছিলেন ১৯৬৬ সালে। এটির কিছু অংশের শুটিং হয়েছিল নাড়াজোল রাজবাড়িতেও। এখানে ২০১৯ এ কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মীর অভিনীত শর্ট ফিল্ম 'সত্যদার কোচিং' এর শুটিং হয়েছিল। এছাড়া শর্ট ফিল্ম 'মৃত্যুপুরী', ওয়েব সিরিজ 'কামিনী', শরৎচন্দ্রের 'মহেশ', এবং কবিগুরুর ছোটগল্প 'জীবিত ও মৃত' র বিভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে নাড়াজোলে।

মহিষাদল রাজবাড়ির ঐতিহ্যশালী লােকেশনে বহু ছায়াছবির শুটিং হয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুমিত্রা মুখার্জির 'দত্তা' সিনেমায় পালকিতে করে যাওয়ার দৃশ্য কিংবা সাম্প্রতিককালে রাজীব বিশ্বাস পরিচালিত ‘খোকা ৪২০' এর গান এখানেই চিত্রায়িত হয়েছে। দেব এবং তাপস পাল অভিনয় করতে এসেছিলেন এখানে। এই মহিষাদল রাজবাড়িতে অশোক পতি পরিচালিত অঙ্কুশ, নুসরৎ এর 'খিলাড়ি' সিনেমার শুটিংও হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিখ্যাত নায়ক সাকিব খান এবং অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চ্যাটার্জি অভিনীত জয়দীপ মুখার্জি ও জাকির হোসেন পরিচালিত 'শিকারী'র শুটিংও হয়েছিল এখানে। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক প্রকাশ ঝা সম্প্রতি শুটিং করেছেন 'সন্ন্যাসী রাজা'র। এছাড়া এখানে হয়েছে 'লবকুশ', 'বাবা তারকনাথ'ও। মহিষাদল ষ্টেশন সংলগ্ন দেওয়ানজীর বাড়িতে হয়েছে 'শ্রী শ্ৰী মা লক্ষ্মী' ছায়াছবির শুটিং। তমলুক রাজবাড়িতে হয়েছে পাহাড়ী সান্যাল ও লিলি চক্রবর্তী অভিনীত 'কেদার রাজা' সিনেমাটি। 

নারায়নগড়ের হাঁদলাগড় রাজবাড়ি ও মহিষাদল রাজবাড়িতেও শুটিং হয়েছে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা  'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'। এতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা রায়। এছাড়াও 'বাংলার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন' গড়বেতার গনগনিতে এটির শুটিং হয়। শুটিংয়ে এসেছিলেন আবির চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্তরা। মেদিনীপুরের কবি, গবেষক ও শিক্ষক সন্তু জানা এই ছায়াছবিতে অভিনয় করছেন। সম্প্রতি 'কিরণমালা' সিরিয়ালের শুটিং হয়েছিল গনগনিতে। বহুবছর আগে 'পান্না' সিনেমারও শুটিং হয়েছিল এখানে। এই সন্তু জানার বংশের এক অখ্যাত মহিলা সুধা জানা অভিনয় করেছিলেন পীযুষ বসু পরিচালিত উত্তমকুমারের 'ধনরাজ তামাং'য়ে (১৯৭৮)। নয়াগ্রামে আদি বাড়ি তাঁর।

এখন ঝাড়গ্রামকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে পর্যটন দপ্তর স্বীকৃত 'চলচ্চিত্র পর্যটনে ঝাড়গ্রাম'। দু'রাত তিন দিনের প্যাকেজ। সত্যিই অভিনব উদ্যোগ। গত চার দশক ধরে এখানকার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে। যেসব পর্যটক এখানে বেড়াতে আসবেন, তাঁদের বিশেষ মনোরঞ্জনের জন্য সেইসব যায়গা দেখানোর মাধ্যমে অনাস্বাদিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্ণধার সুমিত দত্ত। সেইসব স্পটগুলো দেখিয়ে নস্টালজিক করে তোলার ভাবনা উদ্যোক্তাদের। সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে পর্যটকদের স্বার্থে। খোলা হয়েছে ওয়েবসাইট। সব কিছুই চলচ্চিত্র সম্পৃক্ত ঝাড়গ্রামের আবেশকে সাথে নিয়ে।

এই ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িকে লোকেশন করে বহু জনপ্রিয় ছায়াছবি হয়েছে। পীযুষ বসুর 'সন্ন্যাসী রাজা'(১৯৭৫), 'বাঘ বন্দী খেলা' ( ১৯৭৫),  'রাজবংশ' (১৯৭৭), অমল দত্তের 'বেহুলা লখীন্দর' (১৯৭৭), দুলাল ভৌমিকের 'জনম জনমের সাথী' (২০০২),, 'আমার মায়ের শপথ' (২০০৩), সন্দীপ রায়ের 'টিনটোরেটোর যীশু' (২০০৮), 'বাদশাহী আংটি' ( ২০১৪), কৌশিক গাঙ্গুলির 'ব্রেক ফেল' (২০০৯), সুজিত মণ্ডলের 'অরুন্ধুতি' (২০১৪), আর. কে. কুণ্ডুর 'সাবিত্রী মা' (প্রযোজনা করেন গনেশ দাস ও জয়দেব মল্লদেব), অনিক দত্তর 'মেঘনাদবধ রহস্য', এবং ধ্রুব ব্যানার্জীর 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন'(২০১৯) সিনেমাগুলির নামোল্লেখ করা যায়।
'বাঘ বন্দি খেলা' র দৃশ্যায়ন ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ছাড়াও সরডিহা রেলস্টেশন, সরডিহার একটি চালকল, রাস্তাঘাটে হয়েছে। আবীর চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ' দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির পাশাপাশি চিল্কিগড় রাজবাড়িতেও হয়েছে। 'টিনটোরেটোর যীশু'র নিয়োগীবাড়ি আসলে ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদ। এই ছবির একটি দৃশ্য হয়েছিল বাবু বোসের বাড়িতে। তাঁকে মাওবাদীরা খুন করেছিলো পরে। 'বেহুলা লখীন্দর' এ চাঁদ সওদাগরের প্রাসাদ ছিল ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। আর ভেলায় চড়ে যাওয়ার দৃশ্য হয় ঘাঘরাতে। কলাবনীর জঙ্গলেও ছবি তোলা হয়েছিল।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'টেনিদা' অবলম্বনে ১৯৭৮ সালে কাঁকড়াঝোরে শুটিং হয়েছিল উমানাথ ভট্টাচার্য পরিচালিত 'চারমূর্তি' সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছিলেন চিন্ময় রায়, সন্তোষ দত্ত, রবি ঘোষ, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, কাজল গুপ্ত সহ স্থানীয় গোপীনাথ মাহাতো। এছাড়া ঘাঘরার কাছে সৌমেন মণ্ডল শুটিং করেছেন শর্ট ফিল্ম 'মহুল' (২০২০)। 
১৯৫৯ সালে বিকাশ রায় পরিচালিত 'মরুতীর্থ হিংলাজ' সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শুটিং হয় ওদলচুয়ার কেটকি ঝর্না এলাকায়। এছাড়া দহিজুড়ি থেকে কংসাবতী যাওয়ার সময় বসন্তপুরের কাছে এলাকাটি অনেকটাই মরুভূমির মতো। সেখানেও দৃশ্যায়ন হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া "পথের ক্লান্তি ভুলে, স্নেহ ভরা কোলে তব / মাগো, বলো কবে শীতল হবো / কত দূর, আর কত দূর, বলো মা / আঁধারের ভ্রুকুটিতে ভয় নাই / মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই / যদি এ পথ চলিতে কাঁটা বিঁধে পায় / হাসিমুখে সে বেদনা সবো / কত দূর আর কত দূর, বলো মা" গানটি দেখলেই বোঝা যাবে। সেসময় উত্তমকুমার, বিকাশ রায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়রা ঝাড়গ্রামে না থেকে ছিলেন ঘাটশীলাতে। সেখান থেকে এসে শুটিং করছেন। এটাই ঝাড়গ্রামের বুকে প্রথম কোনও বাংলা ছায়াছবির শুটিং হয়েছিল। ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন স্থানে উত্তম কুমার অভিনীত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'দুই পুরুষ' এর কাহিনীতে সিনেমা বানিয়েছেন পরিচালক সুশীল মুখার্জি (২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮)। 

এই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপর একটি কাহিনী অবলম্বনে অজয় কর বানিয়েছিলেন উত্তম সুচিত্রার 'সপ্তপদী' ( ১৯৬১)। এই ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু দৃশ্য তোলা হয়েছিল শালবনীর পিয়ারডোবাতে। ১৯৭৩ সালে খড়গপুরের নিমপুরা এলাকায় 'কোরাস' সিনেমার শুটিং করেছিলেন মৃনাল সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের প্রথম দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করা সাড়া জাগানো 'স্মৃতিটুকু থাক' ছিলো তাঁর ৪০ তম ছায়াছবি। এর কাহিনীকার ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা উমাদেবী বালিকা বিদ্যালয় -এর তৎকালীন শিক্ষিকা লীলাবতী দেবী (রায়)। যাত্রিক পরিচালিত ছবিটি ১৯৬০ এর ২৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়েছিল রূপবানী, অরুনা, ভারতীতে। এই ছবিতে সুচিত্রা সেন শোভা এবং উৎপলা এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৮৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি পাঁশকুড়ার জানাবাড় গ্রামে শুটিং হয়েছিল 'হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা' ছায়াছবি। অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সেদিন শুটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন তাপস পাল এবং সন্ধ্যা রায়। এখানে সেদিন মান্না দের গাওয়া 'ফিরে এলো হরিশ্চন্দ্র' গানটির দৃশ্য তোলা হয়েছিল ফুলের বাগানে। এখানকার নস্করদিঘী গ্রামে 'পরমা' সিনেমার শুটিংয়ে এসেছিলেন অপর্ণা সেন। এই তাপস পালের শেষ ছবি তুহিন সিংহ পরিচালিত 'বাঁশি'র ডাবিং নিজে করে যেতে পারেননি তিনি। তাপসের গলায় সেই ডাবিং করেছিলেন কাঁথির নাট্যকর্মী শোভন কামিল্যা।

সমুদ্র শহর দীঘাতে অজস্র সিনেমার শুটিং হয়েছে। ইয়ত্তা নেই সে সব। তবুও দাগ কেটে যায় উত্তম সুচিত্রা জুটির 'বিকেলে ভোরের ফুল'। সমিত ভঞ্জ ও সুমিত্রা মুখার্জীর 'ঢেউ' এখানে হয়েছে। সুজিত মণ্ডল পরিচালিত দেব, শ্রাবন্তী অভিনীত ছায়াছবি 'সেদিন দেখা হয়েছিল' ( ২০১০) ছবির শুটিং হয়েছিলো এই  দীঘাতেই। এছাড়া জুনপুটে গৌতম ঘােষের 'পাড়", শংকরপুর, তাজপুরে 'ম্যানগ্রোভ', হলদিয়া টাউনশিপে 'রক্তেলেখা', কোলাঘাটে রূপনারায়ণের ধারে সুখেন দাসের 'ন্যায় অন্যায়', ঋতুপর্ণা অভিষেকের 'সুজন সখী', নন্দীগ্রামে মানিক মণ্ডলের 'চোখের পানি’, তমলুকে অশােক বেরার 'দেবী বর্গভীমা', হলদিয়ার বিদ্যাসাগর মােড়ে 'তােমার রক্তে আমার সোহাগ', 'প্রজাপতি', খড়গপুর আই আই.টিতে জিৎ শ্রাবন্তীর 'জোশ', কোলাঘাটে 'চিরদিনই তুমি যে আমার' ইত্যাদি ছবির নানা দৃশ্য তৈরি হয়েছে। কাঁথির জুনপুট-এ 'প্রথম কদম ফুল' সিনেমার বিখ্যাত গান 'আমি শ্রী শ্ৰী ভজহরি মান্না'র দৃশ্য তােলা হয়েছে। এতে দেখা যাবে জেলার বর্তমান কবি দেবাশিষ প্রধানকে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর। এই মেদিনীপুরের বুকেই শুটিং হয়েছে ধীরাজ শর্মার হিন্দি সিনেমা 'ম্যায় ক্ষুদিরাম বসু হুঁ'। এতে অভিনয় করেছেন কনিষ্ক কুমার জৈন, ঋতুপর্ণা সেন, রূপা গাঙ্গুলি, ইমরান হাসমি প্রমুখ। খড়গপুরের প্রেমবাজারের মহম্মদ রিজুয়ান অভিনয় করেছেন টালিগঞ্জের 'টেররিজম'তে। এটির নায়িকা প্রিয়াঙ্কা রায়। রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত 'দুই পৃথিবী' সিনেমার (১৪ অক্টোবর, ২০১০) শেষ দৃশ্য তোলা হয়েছে মেদিনীপুর স্টেশনে। এছাড়া ঝাড়গ্রামের রান্টুয়াতে জিত ও দেবকে নিয়ে এই ছবিরই কিছু দৃশ্য হয়েছিল। এঁরা ছাড়াও এতে অভিনয় করেছেন কোয়েল, বরখা, রিচা শর্মা প্রমুখরা। 

কিন্তু মেদিনীপুরের পটভূমিতে তৈরি সবচেয়ে জনপ্রিয় ছবিটি বােধহয় ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া দীনেন গুপ্ত পরিচালিত 'বসন্ত বিলাপ'। এতে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, রবি ঘােষ, তরুণ কুমার, অনুপ কুমার, চিন্ময় রায়, কাজল গুপ্ত, সুমিত্রা মুখার্জীরা। মেদিনীপুর শহরের অধুনালুপ্ত 'মহুয়া' সিনেমা হল, সাহাদের পুকুর, মেদিনীপুর স্টেশন, জলট্যাঙ্কি, শেখপুরা চার্চ, রাস্তাঘাট, রিক্সাওয়ালাদের সাথে সে সময়কার ছবি উঠে এসেছিল চলচ্চিত্রে। এতো বছর পরে এই 'বসন্ত বিলাপ' সিনেমাটাই হয়ে উঠেছে পরিবর্তিত মেদিনীপুর শহরের এক আশ্চর্য দলিল। এই সাহাদের পুকুরেই সিনেমায় ঝাঁপ দিয়েছিলেন চিন্ময় রায়। 

মেদিনীপুরে জন্মেছিলেন বেশ কিছু অভিনেতা ও পরিচালক। বাংলা সিনেমায় তাঁদের অবদান ভােলা যাবে না। প্রথমেই আসবে শমিত ভঞ্জের (০২.০১.১৯৪৪ - ২৪.০৭.২০০৩) কথা। তমলুক শহরেই বাড়ি। বলাই সেনের 'সুরের আগুন'-এ (১৯৬৫) প্রথম অভিনয় করেন। হৃষিকেশ মুখার্জীর ছবি 'গুড়ি'তে (১৯৭১) জয়া বচ্চনের বিপক্ষে অভিনয় করেন। সত্যজিৎ রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০)-তে হরিনাথ, আপনজন-এ (১৯৬৮) ছেনাে, পরিণীতা-য় (১৯৬৯) গিরীন, অজয় করের 'দত্তা-য় বিলাসবিহারী, মৃণাল সেনের 'মৃগয়া'-তে (১৯৭৬) রিবেল, 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী'-তে (১৯৮১) সূর্যকান্ত, রাজা সাহেব-এ সীতার স্বামী কৃপাসিন্ধু, খনা-বরাহ-তে (১৯৮১) কাম চরিত্রগুলি আজও মানুষ মনে রেখেছে। সমিত ভঞ্জ অভিনীত অন্যান্য ছায়াছবিগুলি হল অভিনয় নয় (১৯৮৩), শহর থেকে দূরে, আবার অরণ্যে, দাদার কীর্তি, রক্তে লেখা, হারমােনিয়াম, অচেনা অতিথি, ওহি রাত ওহি আওয়াজ, জবান, আজকের নায়ক, গণদেবতা, বনজ্যোৎস্না, নতুন পাতা, পরিণীতা, আপনজন, হাটেবাজারে, ফেরা, অমৃত কুম্ভের সন্ধানে (১৯৮২), মােহিনী, প্রতিধ্বনি, সুরের ভুবনে, মান মর্যাদা, গরমিল, আমার শপথ, শঙ্খচূড়, শুধু তােমারি, অনুরােধ, উত্তর মেলেনি, রাজবধু, এই ছিল মনে, দিদি, পুনর্মিলন, আশা ও ভালােবাসা, আমার শপথ, প্রেমবন্ধন, অনুরাধা, যার যে প্রিয়, বউমা, নীলকণ্ঠ, প্রায়শ্চিত্ত, প্রেমের ফাঁদে, সানাই, অমূতের স্বাদ, ব্যাপিকা বিদায়, বড় ভাই, স্ট্রাইকার, রাজা, জীবন মরুর প্রান্তে, এক বিন্দু সুখ, গােলাপ বউ, এই তাে সংসার ইত্যাদি। তিনি পরিচালনা করেছেন ভালােবাসা, বনফুল, ধর্মযুদ্ধ, সাধারণ মেয়ে, ওরা চারজন এবং রাজার রাজা ছায়াছবিগুলি।

কেশপুরের মহিষদা গ্রামে জন্ম দীপক অধিকারী (২৫.১২.১৯৮২) ওরফে দেব-এর। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা এখন। ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের পরপর দুবারের নির্বাচিত সাংসদ তিনি। তাঁর ছােটবেলা কেটেছে চন্দ্রকোনায় মামাবাড়িতে। পুনেতে পড়াশুনা করা এই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারের কেরিয়ার শুরু প্রবীর নন্দীর 'অগ্নিশপথ' (২০০৬) দিয়ে। বিপক্ষে ছিলেন রচনা ব্যানার্জী। এ পর্যন্ত অভিনয় করেছেন আই লাভ ইউ (২০০৭), চ্যালেঞ্জ (২০০৮), চ্যালেঞ্জ-২ (২০১২), খােকাবাবু (২০১২), খোকা ৪২০ (২০১৩), রংবাজ (২০১৩), চাঁদের পাহাড় (২০১৩), পাগলু (২০১১), পাগলু-২ (২০১২), লে ছক্কা (২০১০), বলাে না তুমি আমার (২০১০), দুজনে (২০০৯), পরান যায় জ্বলিয়া রে (২০০৯), মন মানে না (২০০৮), প্রেমের কাহিনী (২০০৭), সেদিন দেখা হয়েছিল (২০১০), রােমিও (২০১১), একটি তারার খোঁজে (২০১০), মাফিয়া (২০১৩), বাওয়ালি আন লিমিটেড (২০১২), বুনো হাঁস (২০১৪), শুধু তোমারই জন্য (২০১৫), জুলফিকার (২০১৬), আমাজন অভিযান (২০১৭), হিরোগিরি (২০১৫), হইচই আনলিমিটেড (২০১৮), ককপিট (২০১৭), যোদ্ধা (২০১৪), বিন্দাস (২০১৫), কিডন্যাপ (২০১৯), লাভ এক্সপ্রেস (২০১৬), চ্যাম্প ( ২০১৭), পাসওয়ার্ড (২০১৯) ছবিগুলিতে। বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে সচল রাখতে সদর্থক ভূমিকাই নিয়েছেন মেদিনীপুরের এই নায়কটি। সমালোচকদের বক্তব্য, রাজনীতির অঙ্গনে এসে দেবের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের ক্ষতি হয়েছে বহুলাংশে। দেবের মতোই মেদিনীপুরের বুকে সাংসদ হয়েছিলেন বাংলা ছবির জনপ্রিয় নায়িকা সন্ধ্যা রায়।

পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের মৈতনা গ্রামের আরাধনা জানা অভিনয় করেছেন আমির খানের 'দঙ্গল'তে। এছাড়া সোহা আলি খানের সাথে 'আতরঙ্গি রে', ইরফান খানের সাথে 'মিডিয়াম', রবিনা ট্যাণ্ডনের সাথে 'মাতৃ'তে রোল প্লে করেছেন। 'দ্যা অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার' এ সাংসদ রামা রাওয়ের মেয়ের চরিত্রে ছিল তাঁর অভিনয়। এছাড়া বলিউডি ফিল্ম 'মা'তেও কাজ করেছেন। মেদিনীপুর শহরের বিধাননগরের অনির্বাণ ভট্টাচার্য এখন বাংলা ছায়াছবির ব্যস্ত অভিনেতা। নাটক থেকে উত্তরণ তাঁর। সাংসদ মিমির প্রথম সিনেমা 'দ্বিতীয় পুরুষ' এ আছেন তিনি। তাঁর অভিনীত অন্যান্য সিনেমাগুলো হোলো আলিনগরের গোলোকধাঁধা, আরশিনগর, দুর্গা সহায়, জোজো, ধনঞ্জয়, গুমনামি, উমা, ফাইনালি ভালোবাসা, শাহজাহান রিজেন্সি, বিবাহ অভিযান, বীরপুরুষ, ড্রাকুলা স্যার, গোলন্দাজ, ঘরে ও বাইরে, ঈগলের চোখ, কলকাতায় কলম্বাস, ঘরে বাইরে আজ , এক যে ছিল রাজা এবং ভিঞ্চিদা।

কাঁথি শহরে তৈরি হয়েছে শ্রেয়ম আচার্যের পরিচালনায় দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের রোম্যান্টিক থ্রিলার সিনেমা 'উৎসর্গ'। সবকিছুই মেদিনীপুরের অনুষঙ্গ এখানে। অভিনয় করেছেন অশোক নন্দ, বিকাশ চন্দ, সুমিতা সিনহা, ঐন্দ্রিলা বসু রায় প্রমুখরা। এর আগে তিনি বানিয়েছিলেন 'দেহান্তর'। হলদিয়ার তপন শেঠ ইতিমধ্যেই শিল্প নির্দেশক হিসেবে প্রায় ৫০ টি সিনেমা ও ২২ টি বড় মাপের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। ইন্দ্রাশিষ আচার্যের 'পিউপা' সেরা শিল্প নির্দেশনার পুরস্কার পায় বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের বিচারে। ঐ বছরই তাঁর শিল্প নির্দেশনায় 'অন্তর কাহিনী' দেখানো হয়েছিল কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। তবে তাঁর শিল্প নির্দেশনায় 'রক্তকরবী' অস্কারের দৌড়ে ছিল একবার। এছাড়া তৃতীয় অধ্যায়, মৈনাক ভৌমিকের 'বর্ণপরিচয়', সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'ভিঞ্চিদা', রেশমি মিত্রের 'হঠাৎ দেখা' ( ভারত বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায়), অনিক দত্তের 'ভবিষ্যতের ভূত'এ তাঁর শিল্প নির্দেশনা মনকাড়া। রণবীর সিংহ এবং সোনাক্ষী সিনহার 'লুটেরা' হিন্দি সিনেমাতে তিনি ছিলেন সহকারী শিল্প নির্দেশক। 'তারানাথ তান্ত্রিক' এ শিল্প নির্দেশনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন তপন শেঠ। এছাড়া তাঁর অভিনীত 'তিন পাত্তি', 'দ্যা পার্সেল', 'আই রিবর্ণ' উল্লেখযোগ্য। বাংলা সিনেমার প্রাণপুরুষ হিরালাল সেনের বায়োপিকে মেদিনীপুরের এই মানুষটি ছাপ রেখেছেন কাজের মাধ্যমে।

'বাহুবলি', 'বাহুবলি ২', 'আমাজন অভিযান', 'বেলাশেষে', 'বস', 'পাওয়ার', 'বিন্দাস', 'ব্যোমকেশ পর্ব', 'সজারুর কাঁটা', 'ইয়েতি অভিযান', ফেলুদা সিরিজের বিভিন্ন সিনেমায় অ্যানিমেশনের কাজ করে তাকে লাগিয়েছেন হাউরের মতো অখ্যাত যায়গায় অ্যানিমেশনের কাজ শিখে! এসব শিখিয়েছেন কৃশানু চৌধুরী। বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ কালীপদ চৌধুরীর ছেলে। এছাড়া জঙ্গল বুক, হ্যারি পটার, লায়ন কিংতেও অ্যানিমেশনের কাজ করেছে কৃশানুর ছাত্ররা। লক্ষীরাজ মুখোপাধ্যায়, সৌরভ রায়, সুমন পাইক, কার্তিকচন্দ্র গিরিরা আজ মেদিনীপুরের বুক থেকে হলিউডেও পা দিতে পেরেছে অ্যানিমেশনের দৌলতে।

পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি কোলাঘাটের দেউলিয়ার মান্দারগেছিয়াতে। তিনিও বাংলা সিনেমাকে দেখিয়েছেন আশার আলাে। তাঁর পরিচালিত ছবিগুলি হল বাজিমাত, চিরসাথী, কুরুক্ষেত্র, মা আমার মা, তুলকালাম, স্বপ্ন : দ্যা ড্রিম, সঙ্গী, সাথী, নাটের গুরু এবং নবাব নন্দিনী। সত্যজিৎ রায়ের সােনার কেল্লা'-র ছােট্ট মুকুল তথা কুশল চক্রবর্তীর বাড়ি দাসপুরের কলােড়া গ্রামে। কুশলের বাবা রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর লেখা জনপ্রিয় নাটক 'শকুনির পাশা'-র কথা আমরা সবাই জানি। ডিমারীর আন্তাড়া গ্রামের সরিৎশেখর ব্যানার্জী অভিনয় করেছেন অশােকা, মুক্তধারা এবং শতভিষা সিনেমাতে। অভিনেত্রী ছন্দা চ্যাটার্জীর বাড়িও মেদিনীপুর জেলায়। এখন সিরিয়াল করেন। আগে 'সাত ভাই চম্পা' সিনেমা করেছিলেন তিনি। কবি অমৃত মাইতি অভিনয় করেছেন 'দেবী বর্গভীমা'তে। মেদিনীপুরের কবি তথা শর্ট ফিল্ম পরিচালক মৃনাল কান্তি মাহাতো সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর পরিচালিত 'বাঁদনা'র (২০১৭) জন্য। এছাড়া ২০১৯-২০ তে করেছেন 'বাহা সারহুল'। আরো অনেক শর্ট ফিল্ম বানানোর কৃতিত্ব তাঁর। 

আশির দশকের শুরুতে মেদিনীপুর শহরের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী তথা 'জ্যাক পল অ্যাণ্ড সন্স' এর মূল উদয়রঞ্জন পাল প্রযোজনা করেছিলেন বরুণ কাবাসির পরিচালনায় 'অরুণ বরুণ কিরণমালা' সিনেমাটি। তিনি পরে নিজের পরিচালনায় 'অমরজ্যোতি' নামে একটি সিনেমা প্রযোজনা করেছিলেন। এতে অভিনয় করেছেন শ্রীলা মজুমদার। সুর দিয়েছেন কল্যান সেন বরাট। পরিচালক সৈকত ভট্টাচার্য মেদিনীপুরে একমাস থেকে শুটিং করেছিলেন 'দুলিয়া' চলচ্চিত্রের। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি 'শ্বেত পাথরের থালা'-র প্রয়ােজনা করেছেন হলদিয়ার ব্যবসায়ী শেখ মুজফ্ফর। কাঁথির সাতমাইলের 'প্রফুল্ল' সিনেমা হলের মালিক মানিক দাস 'সত্যম শিবম সুন্দরম' সিনেমার প্রযােজনা করেছিলেন। মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনাতেই গড়ে উঠেছে প্রয়াগ ফিল্ম সিটি। শাহরুখ খান এই ফিল্ম সিটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। এখানে শুটিং হয়েছিল দেবের 'যোদ্ধা' সিনেমাটি। এখন ফিল্ম সিটি অবশ্য সম্পূর্ণ বন্ধ।
প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির বায়োপিক নিরজ পাণ্ডে পরিচালিত 'এম এস ধোনি : দি আনটোল্ড স্টোরি' র শুটিং হয়েছিল ধোনির  একসময়ের কর্মস্থল খড়গপুরের বিভিন্ন স্থানে। খড়গপুরে রেলের টিকিট চেকারের চাকরি করতেন ধোনি। ২০১৫ সালে এখানে শুটিং করতে এসেছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত। খড়গপুর স্টেশন, সেরসা স্টেডিয়াম, ধোবিঘাট, গোলখুলি দুর্গামন্দির, রেল আবাসন, সাউথ ইনস্টিটিউট, স্টেডিয়াম লাগোয়া টমাসের চা দোকান ইত্যাদি স্থানে নিয়মিত শুটিং হয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৬ এর ৩০ শে সেপ্টেম্বর। এতে স্থানীয়দের মধ্যে অভিনয় করেন ঝাড়গ্রামের গিধনী এলোকেশী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তথা স্থানীয় 'কথাকৃতি' নাট্যসংস্থার সাথে যুক্ত দেবলীনা দাশগুপ্ত। তিনি ডি আর এম এর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এছাড়া অভিনয় করেছেন গোলবাজারের বিনোদ শঙ্কর, দীনেশ শঙ্কর প্রমুখ।

মেদিনীপুরের সাথে ওতােপ্রােতভাবে জড়িয়ে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম। তিনি মেদিনীপুরের কাঁথি সমুদ্রের উপকূলীয় পটভূমিতে লিখেছিলেন উপন্যাস 'কপালকুণ্ডলা' (১৮৬৬)। সেই নামেই তৈরি হয়েছে বিখ্যাত সিনেমা। 'কপালকুণ্ডলা' প্রথম চলচ্চিত্রায়িত (১৯৭৪) হয়েছিল অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। সন্ধ্যা রাণী, শোভা সেন, নীতিশ মুখার্জি, সমীর কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত এই ছায়াছবিটির অনেক অংশেরই শুটিং হয়েছিল কাঁথি উপকূল এলাকায়। ছবিটিতে কৃতজ্ঞতা স্বীকারে তাই নাম রয়েছে কাঁথির সতীশচন্দ্র জানা, খগেন্দ্রনাথ শাসমল এবং বঙ্কিমচন্দ্র মাইতির। ১৯৮১ তে ফের পিনাকীভূষণ মুখার্জি পরিচালিত 'কপালকুণ্ডলা'র শুটিং হয়েছিল খেজুরির হিজলির বালিয়াড়িতে। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন মহুয়া রায় চৌধুরী, রঞ্জিত মল্লিক, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখার্জি, অজিতেশ ব্যানার্জি প্রমুখ। কৃতজ্ঞতা স্বীকারে নাম ছিলো এখানকার বাসিন্দা বৈকুণ্ঠনাথ গুড়িয়ার।

হিজলী টাইডাল ক্যানেলের পাশেই খেজুরীর গােলাবাড়ি গ্রাম। সেখানেই বাস করতেন অসংখ্য যাযাবর সম্প্রদায়ের কাকমারা মানুষজন। সেই মানুষজনের কাহিনী নিয়ে 'আম্মা' নামে একটি গল্প লিখেছিলেন বঙ্কিম পুরস্কারপ্রাপ্ত লাক্ষী গ্রামের গল্পকার সুশীল জানা। বিশ্ববিখ্যাত 'ডি সিকা' পুরস্কার জয়ী পরিচালক গৌতম ঘােষ এই 'আম্মা' গল্প অবলম্বনে সিনেমা তৈরি করেছিলেন। কাঁথি, মারিশদা এলাকাতেই শুটিং হয়েছিল এখানকার তেলুগু শবর সম্প্রদায়ের যাযাবর কাকমারাদের কাহিনীকে কেন্দ্র করে। সিনেমাটির নাম হয়েছিল 'দখল'। ১৯৮৩ সালে গৌতম ঘােষের এই ছবিটি ভারত সরকার থেকে পেয়েছিল 'স্বর্ণকমল' পুরস্কার। ওয়েস্ট বেঙ্গল জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন এই 'দখল’ ছবিটির জন্য ১৯৮৪ সালে শ্রেষ্ঠ গল্প লেখক হিসেবে 'দিশারী' পুরস্কার দেয় সুশীল জানাকে। বাংলা চলচ্চিত্র পুরস্কার সমিতিও তাঁকে শ্রেষ্ঠ গল্পলেখক হিসাবে রূপাের ময়ূর এবং মেমেন্টো দিয়ে এই সময় সম্মানিত করে। সুশীল জানার লেখা 'সূর্যগ্রাস' উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫২-৫৩ তে খােকা লাহার পরিচালনায় 'অনুপমা' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। খেজুরির ডাকঘর এবং তার ইতিহাস নিয়ে অরিজিৎ দে বানিয়েছেন শর্ট ফিল্ম 'নির্জন সাক্ষর'।

 মেদিনীপুরের সবংয়ের দুইল্যা গ্রামের বাসিন্দা ধনঞ্জয় মণ্ডল ফিল্ম পরিচালক হিসেবে এখন যথেষ্ট সমাদৃত। তাঁর বানানো চলচ্চিত্র 'তালনবমী' (২০০৫) পেয়েছে International Critic Award ( FIFRESCI Award at Zanzibar)। এছাড়া তিনি বানিয়েছিলেন সিনেমা 'মেলা' (২০০৮)। সবংয়ের তিলন্তপাড়ার মাইতিদের বিখ্যাত রাসের মেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই ছায়াছবিটি। 'এ সাইলেন্ট কিলার' ডকুমেন্টরির জন্য পেয়েছেন দুটি জাতীয় এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সব মিলিয়ে চারটি আন্তর্জাতিক ও পাঁচটি ডকুমেন্টরি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের অধিকারি তিনি। সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন 'পদ্ম পাতার জল' এর জন্য। ঝাড়খণ্ড ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তাঁর 'রোল নম্বর সেভেন্টিন' কে বেছেছে সেরা সামাজিক ছবি। অসংখ্য ডকুমেন্টরি ফিল্ম যেমন কৃষ্ণযাত্রা, বহুরূপিজ অব বেঙ্গল, এ জার্নি উইথ কাকমারা, গঙ্গাসাগর, ভাঙ্গন - দ্যা ইরোশান, ন্যাচারাল ফাইবার ক্র্যাফটস, দ্যা স্টোরি অব WBSEB, ছৌ ড্যান্স অব পুরুলিয়া, চার- দ্যা স্যাণ্ডি শোর, ঢাক - দ্যা ড্রাম অব বেঙ্গল ইত্যাদি তিনি বানিয়েছেন। এছাড়া দুটি টেলিফিল্ম 'দেওয়াল' ও 'ভাড়া বাড়ি' তাঁর হাতে তৈরি। সব মিলিয়ে ৪১ টি ফিল্ম এর পরিচালনা করেছেন তিনি। কলকাতার পরিচালক কুনাল বিশ্বাস বালিচকের লুপ্তপ্রায় 
হাপুগানের শিল্পীদের নিয়ে বানিয়েছেন শর্টফিল্ম 'হাপু : দ্যা এপিলগ'। ঝাড়গ্রামের তমাল চক্রবর্তী বানিয়েছিলেন শর্ট ফিল্ম 'এক বিন্দু প্রাণ'।

জামবনি ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে সৌগতসুন্দর সামন্ত বানিয়েছেন তথ্যচিত্র 'চিল্কিগড় ও কনকদুর্গা'। লিটল ম্যাগাজিনের শতবর্ষ উপলক্ষে পরিচালক অভিজয় কার্লেকর যে তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন, তাতে স্থান পেয়েছিলো মেদিনীপুরের মেদিনীপুরের কবি সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের কথা। জঙ্গলমহলের বীরযোদ্ধা শেষ রাজা নাকি হুদুরদুর্গা। সাঁওতালি লোকশ্রুতি অনুযায়ী সেই কাহিনী অবলম্বনে সুমন্ত মুর্মু বানিয়েছেন স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র 'হি ওয়াজ নট এ ডেমন, হুদুরদুর্গা : এ গ্রেট ট্রাইবাল কিং'। আদিবাসী সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে এবং সাঁওতাল সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই তথ্যচিত্র।

তবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে মেদিনীপুরের সম্পর্ক একটি ক্ষেত্রে অবশ্য নিবিড় হয়ে উঠলাে না দুর্ভাগ্যের কারণে। নচেৎ 'পথের পাঁচালী-র বােড়াল গ্রামের মত জনপ্রিয় হয়ে উঠতেই পারতাে 'ময়না। ১৯৭১ এর আশ্বিনে খ্যাতনামা পরিচালক সত্যজিৎ রায়, পুত্র সন্দীপ রায়, আলােক চিত্রী সৌমেন্দু রায়-রা এসেছিলেন ময়না রাজবাড়িতে। 'অশনি সংকেত'-এর লােকেশান দেখতে। রাজা জ্যোতির্ময়ানন্দ বাহুবলীন্দ্র সব খুঁটিনাটি দেখান। সেসময় তাঁদের খেতে দেওয়া হয়েছিল মর্তমান কলা ও রাজভোগ। তবে সেদিন রাত কাটান মেদিনীপুর শহরে। কিন্তু পরিবহনের অস্বাচ্ছন্দ্য এবং বিদ্যুতের অভাবের কারণে এখানে তিনি চিত্রায়িত করেননি 'অশনি সংকেত' (১৫ ই আগষ্ট, ১৯৭৩) চলচ্চিত্রটি। 

তবে ময়না-র সাথে পরবর্তীতে অন্যভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে বিশ্ব চলচ্চিত্র। আশির দশকের গােড়ায় ময়নার পুলকানন্দ বাহুবলীন্দ্র, সত্যজিৎ রায়কে দিয়েছিলেন ময়নার ভুবনবিখ্যাত গহনাবড়ি। যা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এই অদ্ভুত 'অলংকারবটিকা'কে স্থান দিয়েছিলেন তাঁর 'আগন্তুক (১৯৯১) চলচ্চিত্রে। সেই চিত্রনাট্যের কিছু অংশ এই পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া দরকার -- 
"অনিলা : আপনাকে একটা নতুন জিনিস দেখাই মনোমোহন :  সর্বনাশ, এ আবার কি?
অনিলা : গয়না বড়ি। মেদিনীপুরের বৌ-ঝিয়েরা নিজের বাড়িতে তৈরি করে। 
মনোমোহন : আহারের এত বাহার, এ শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।"

এখানেই গড়ে উঠেছে 'মেদিনীপুর ফিল্ম সােসাইটি'। ১৯৬৩ র ৫ ই আগস্ট তখনকার জেলাশাসক শিবপ্রসাদ সমাদ্দারের বাংলোতে সের্গেই আইজেনস্টাইনের 'ব্যাটলশিপ পটেমকিন' ছবি দেখিয়ে শুরু হয় সংগঠনটির পথচলা। এই ফিল্ম সোসাইটি প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল সৈকত ভট্টাচার্য পরিচালিত 'দুলিয়া' ছবিতে। এটি মেদিনীপুর শহরের পাশাপাশি গ্রামেই শুটিং হয় একমাস ধরে।

মেদিনীপুরের প্রথম সিনেমা হল 'অরোরা'। ১৯৪৬ সালে স্থাপিত হয় এটি। এরপর ১৯৪৭ এর ৪ টা ফেব্রুয়ারি বল্লভপুরে হরিচরণ সাউ খুললেন 'হরি' সিনেমা হল। এখানে প্রথম দেখানো হয় 'চন্দ্রলেখা' সিনেমা। ১৯৬৭ তে অনিলবন্ধু দাস বিধাননগরে শুরু করলেন 'মহুয়া' সিনেমা হল তৈরি। তবে তিনি তা বেচে দেন বাঁকুড়ার কালীপদ দত্তকে। ১৯৬৯ এর ৭ ই ডিসেম্বর এখানে 'মহাতীর্থ কালীঘাট' সিনেমা দেখানোর মাধ্যমে শুরু হয় পথচলা। আর ৯ ই আগস্ট 'সাগিনা মাহাতো' দেখিয়ে শুরু বানিজ্যিক ভাবে এগিয়ে চলা। যদিও এখন সব হলগুলিই বন্ধ। রূপ পরিবর্তন ঘটেছে সেগুলির।

মেদিনীপুরের সাগর, নদী, ঝাউবন, মােহনা, শিল্পাঞ্চল, লালমাটি, শালজঙ্গল, টিলা চিত্রনাট্যের প্রয়ােজনেই দরকার হয়। এখানকার ইতিহাস, গণসংগ্রাম, জনজাতি, সাহিত্য, বারংবার হয়ে উঠে চলচ্চিত্রের অংশ। কিন্তু ইদানিং চলচ্চিত্র শিল্পে পড়ছে ভাটা। তাই কাঁথির প্রাচীনতম 'উদয়ন' সিনেমা হল ভেঙে তৈরি হয়েছে উঁচু বাড়ি। 'বসন্ত বিলাপ'-এ স্থান পাওয়া মেদিনীপুর স্টেশন রােডের 'মহুয়া' আজ আর নেই। মেদিনীপুরের মানুষ সংস্কৃতিবান, সাহিত্যরসিক। কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে আগ্রহ কম। কিন্তু এখানে যে অফুরন্ত উপাদান রয়েছে তা যদি কোনও পরিচালক যথাযথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেন তবে লাভবান হবে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ। অনেক দেরিতে হলেও এখন কি একটু একটু বুঝতে পারছে পরিচালকরা ?

কৃতজ্ঞতা স্বীকার -- সিদ্ধার্থ সাঁতরা, দীপক দাস, শুভময় মজুমদার, শান্তনু অধিকারী, অরিন্দম ভৌমিক, সুমিত দত্ত, কিংশুক গুপ্ত, দিগন্ত মান্না, ড. মৌসম মজুমদার, ড. সুস্নাত জানা, সন্তু জানা, সুদর্শন সেন, আরিফ ইকবাল খান, সুজিত ভৌমিক, রঞ্জন মাইতি, সিদ্ধার্থ বাহুবলীন্দ্র, রঞ্জন মহাপাত্র, মানবেন্দ্রনাথ খান, অন্তরা মজুমদার, বরুণ দে, শিলাদিত্য সেন, সুদেষ্ণা বসু, কাশীনাথ সাহা, কুনাল দে
-----------

Post a Comment

2 Comments

  1. মূল্যবান তথ্যে ঠাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপহার দিলেন ভাস্করব্রত পতি। লেখককে অভিনন্দন জানাই এই মূল্যবান লেখাটির জন্য। এই ফলিল আগামী দিনের সিনেমা চর্চায় পথ প্রদর্শক এর কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস...
    সিদ্ধার্থ সাঁতরা ।

    ReplyDelete
  2. মূল্যবান তথ্যে ঠাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপহার দিলেন ভাস্করব্রত পতি। লেখককে অভিনন্দন জানাই এই মূল্যবান লেখাটির জন্য। এই দলিল আগামী দিনের সিনেমা চর্চায় পথ প্রদর্শক এর কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস...
    সিদ্ধার্থ সাঁতরা ।

    ReplyDelete