জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন || পর্ব-৪

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন || পর্ব- ৪

পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞা
   
ঈশ্বরকণা – ঈশ্বর না কণা ?

টেক্সাস-এর ছোট্ট শহর ওয়াক্সাহ্যাচি। তার মাটির তলায় ৮৭.১ কিমি দীর্ঘ গোলাকার সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ চলছে জোরকদমে। ২০০ জন বিজ্ঞানী ও ২০০০ জন শ্রমিক একযোগে দিনরাত এক করে কাজে নেমেছেন। টানেলের ভেতরে বসানো হবে পেল্লাই সাইজের যন্ত্র সুপারকন্ডাকটিং সুপারকোলাইডর (superconducting supercollider বা SSC)। প্রোটন-প্রোটন সংঘর্ষ বাধানোর যন্ত্র (প্রোটন প্রতি যার ক্ষমতা ২০ Tev)। সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডর (LHC)-এর চাইতে পাঁচ গুণ বেশি শক্তিশালী। খুব উচ্চ শক্তি (ultra high energy)-র বিজ্ঞান গবেষণায় সারা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপকে টেক্কা দেবে আমেরিকা― এই ছিল বাসনা। এ হেন পরিকল্পনার বাজেট শুনলে চক্ষু কপালে উঠবে। ১১০০ কোটি ডলারের বেশি ! পাঁচ বছরে খরচ হয়েছে শতকরা মাত্র কুড়ি ভাগ টাকা। সবেমাত্র ২৪ কিমি টানেল খোঁড়া হয়েছে (চিত্র - ১)। প্রোজেক্টের সিংহভাগ কাজ এখনও বাকি। এদিকে বাজেট দিনকে দিন বেড়ে চলেছে।
এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সংবাদ এল – মিশন পরিত্যক্ত। সালটা ছিল ২১ শে অক্টোবর, ১৯৯৩। কারণ খুব সিম্পল, আকাশ ছোঁয়া খরচ। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ঠাণ্ডা যুদ্ধ (cold war : ১৯৪৭ - ১৯৯১) শেষ হয়েছে। তাই অতিরিক্ত খরচের রাশ টানতে এমন বিগ বাজেট প্রকল্প ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সিনিয়র (presidential term : ১৯৮৯ - ১৯৯৩)।

অথচ এক দশক আগে ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন (presidential term : ১৯৮১ - ১৯৮৯)-এর বিজ্ঞান পরামর্শদাতা আমেরিকার গার্গেন্টুয়ান হাই-এনার্জি ফিজিক্স প্রোজেক্ট-এর ডিজাইন কমিটিকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে এবং বলেছে "Bold and Greedy" হতে। তারপর প্রেসিডেন্ট রেগনের স্বদিচ্ছায় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু হয় "Throw Deep" নাম দিয়ে (পরে যার নাম হয় SSC)। এই প্রোজেক্টে ভারত সরকার পাঁচ কোটি ডলার সাহায্যের অঙ্গীকার করেছিল। প্রোজেক্ট পরিত্যক্ত ঘোষণা করায় বিজ্ঞান গবেষণা এক দশক পিছিয়ে পড়েছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা। কারণ ব্রম্ভাণ্ডের ভর সৃষ্টির জন্য দায়ী কনিকার সন্ধান পেতে পাতালে ওই সুড়ঙ্গের খননকাজ শুরু হয়েছিল। কতটা গুরুত্বের ছিল এই বিজ্ঞান গবেষণা ?

অফুরন্ত বিকিরণ, দৃশ্যমান পদার্থ, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি ও স্থান-কাল বা শূন্যস্থানের সংমিশ্রণে তৈরি এই ব্রম্ভাণ্ড। এ হেন ব্রম্ভাণ্ডে এত পদার্থের আগমন কীভাবে সম্পন্ন হয়েছে? কে জুগিয়েছে তাদের ভর? এত গ্রহ তারা নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এই পৃথিবীতে মানুষ গাছপালা পাহাড় পর্বত ইত্যাদি এল কোথা থেকে? নাকি এখানেও ভগবানের দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকব আমরা?

বাস্তবে আমরা যা দেখছি, সবই কি সত্যি ? তাই যদি হয়, তাহলে পদার্থের আদি উপকরণ কী― এমন প্রশ্নের মুখে বিজ্ঞানীরা বারবার এত বিচলিত বোধ করেন কেন? নাকি এর মূলে রয়েছে ব্রম্ভাণ্ডের কোন অসমতার নীতি? ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন― পরমাণুর তিনটি আলাদা আলাদা কনা কেন থাকবে, একটি কেন নয়? প্রোটন ও নিউট্রন হাতির মতো মোটা হয়ে গেল আর ইলেকট্রন কিনা ইঁদুর? অর্থাৎ তিনটি কনার ভর আলাদা আলাদা হল কেন ? কে জোগাল এদের ভর? ভর জোগাল-ই যদি, কার প্রভাবে ভর বন্টনে এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ করল?

ব্রম্ভাণ্ডের সে-সব রহস্যের পর্দা উন্মোচনে পদার্থের 'ভর' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ঠিকই, কিন্তু 'কে জোগায় ভর' এই  প্রশ্নের সঠিক দিশা ব্যক্ত করে কসমোলোজির স্ট্যান্ডার্ড মডেল। 

'স্ট্যান্ডার্ড মডেল' কী ?

মহাবিস্ফোরণে ( বিগ-ব্যাঙ এক্সপ্লোসান ) এই ব্রম্ভাণ্ডের জন্ম। জন্ম মূহূর্তে শুধুমাত্র বিপুল বিকিরণের (এনার্জি) সমাহার।  তারপর তাপমাত্রা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিসাম্য ভেঙ্গে স্বাধীন হয় চার রকমের বল এবং তৈরি হয় নানা জাতের কণা।

গাছের আপেল ও পৃথিবীর মধ্যে যে টান, তা গ্র্যাভিটি। ব্রম্ভাণ্ডের যেকোন‌ও দু'টি বস্তুর মধ্যে এই বলের খেলা চলে। অর্থাৎ বিশ্বের চরিত্র নির্ধারণ করে মহাকর্ষ। সুইচ অন করার সঙ্গে সঙ্গে যে টিভি চলে, পাখা ঘোরে, আলো জ্বলে― তার মূলে আছে তড়িৎ বল ও চুম্বক বল। একসঙ্গে তড়িৎচুম্বকীয় বল। এই বল মানুষের দেহে সব কণার গঠন ঠিক করে। পরমাণুর ভেতরে ক্ষুদ্র ভারি জায়গা হল নিউক্লিয়াস। তার ভেতর তীব্র নিউক্লিয় বলের প্রভাবের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রনের বাস। আবার ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, রেডিয়াম প্রভৃতি মৌলের তেজস্ক্রিয়তার কারণ ক্ষীণ নিউক্লিয় বল। তা উইক ফোর্স বা মৃদু বল। 

আর ব্রম্ভাণ্ডের কণা ? মাত্র ১৮ জাতের(চিত্র - ২) । ব্রম্ভাণ্ডের আদি অবস্থায় সবাই নিরাকার এনার্জির মতো ভরহীন ছিল। প্রচণ্ড দ্রুত গতিতে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। তাপমাত্রা আরও কমে আসায় প্রতিসাম্য নীতি ভেঙে এনার্জি থেকে সবার প্রথম জন্ম নেয় কোয়ার্ক। কোয়ার্ক ছ'রকমের― আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, টপ ও বটম কোয়ার্ক। এরা ভারি কণা। আরও ছ'রকমের হালকা কণা― ইলেকট্রন, মিউয়ন, টাউ, নিউট্রিনো-ইলেকট্রন, নিউট্রিনো-মিউয়ন ও টাউ-নিউট্রিনো। 
                                
অবশিষ্ট ছয়ের মধ্যে পাঁচ জাতের কণা লুকিয়ে থাকে নির্দিষ্ট বলের অভিক্রিয়ার পশ্চাতে। ফোটনের বিনিময় হয় তড়িৎচুম্বকীয় অভিক্রিয়ার কালে। গ্লুয়ন হাতবদল হয় যখন তীব্র বল ক্রিয়া করে। ফোটন-গ্লুয়ন উভয়ে ভরহীন। কিন্তু মৃদু বলের মূলে আছে তিন তিনটি ভারি কণা ― ডব্লিউ-প্লাস (W +), ডব্লিউ-মাইনাস (W –) ও জেড-জিরো (Z°)। আঠারো পূরণ হতে বাকি থাকে আর মাত্র একটি কণা। ঈশ্বর-কণা। তখনও সে সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে ধরতে আবারও ফাঁদ পাতলেন বিজ্ঞানীগণ। এবার জেনেভায়, সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডরে। শেষমেশ, 2012 সালের 4 জুলাই সার্নের ডিরেক্টর-জেনারেল রল্ফ-ডিয়েটার হয়্যার ঘোষণা করলেন এই ব্রম্ভাণ্ডের ভর জোগানকারী, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের শেষতম কনা হিগস বোসনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই হিগস-বোসনই 'ঈশ্বরকণা' বা 'গড পার্টিকেল'। ফলস্বরূপ ২০১৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯৬৪-তে ঈশ্বরকনার ভবিষ্যৎবক্তা বিজ্ঞানীদ্বয় ফ্র্যাঙ্কোইস এংলার্ট (জন্ম : ৬ নভেম্বর, ১৯৩২) ও পিটার হিগস (জন্ম : ২৯ মে, ১৯২৯)।
গ্র্যাভিটির আদবকায়দা বাকি বলগুলোর মতো নয়। তাই তাকে তালিকার বাইরে রেখে বাকি তিনটি বল ও ১৮ কণার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে একগুচ্ছ তত্ত্ব। সব ক'টা তত্ত্বকে একসঙ্গে নিয়েই স্ট্যান্ডার্ড মডেল।

কিন্তু কণার মধ্যে ঈশ্বরের নাম? এর ঐতিহাসিক করুণ প্রেক্ষাপট উপরে আলোচনা করা হয়েছে। শুধু নাম-করণের পশ্চাতে উজ্জ্বল ইতিহাস বিবৃত করা বাকি। 

নোবেলজয়ী পদার্থবিদ লিওন লেডারম্যান (১৯২২ - ২০১৮) ও বিজ্ঞান লেখক ডিক টেরেসি লিখলেন একখানা বই, " The God Particle : If the Universe Is the Answer, What Is the Question ?" ; আমেরিকার করদাতা সাধারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবর্গকে উদ্দেশ্য করে বিজ্ঞান গবেষণা কতটা জরুরি বোঝাতে। 
সেখানেই তারা পদার্থের ভর জোগানকারী কণাকে সম্বোধন করে বসলেন 'গডড্যাম পার্টিক্যাল'। দূরছাই কণা। এদিকে বইয়ের প্রকাশক ওই নামে রাজি না। তিনি 'গডড্যাম পার্টিকেল' থেকে 'ড্যাম' শব্দটি বাদ দিলেন। হয়ে গেল 'গড পার্টিকেল'। ঈশ্বর-কণা। নামের মধ্যে ঈশ্বর ? ব্যাস, লুফে নিল মিডিয়া ও আপন করে নিল পৃথিবীর মানুষ। সেই থেকে জনপ্রিয় হল হিগস বোসন, ঈশ্বর-কণা নামে। কীভাবে ভর জোগায় এ কণা? আগামী পর্বে সে বিষয় বিস্তারিত আলোচনা হবে, প্রিয় পাঠক।

তাহলে, সত্যিই কণা-বিজ্ঞান জগতের ঈশ্বর এই ঈশ্বর-কণা বা হিগস বোসন। এরা একদিকে কণা হলেও অন্য দিকে ঈশ্বরও বটে, অন্তত স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বাকি কনাগুলোর নিকট ( প্রোটন ও গ্লুয়ন বাদে )। ঈশ্বর-কণার মদতে প্রোটন-নিউট্রন ভরহীন থেকে ভারি কনায় পরিণত হয়েছে। তারপর সৃষ্টি হয়েছে অনু, পরমাণু, মৌল, যৌগ, পদার্থ, পাহাড়, পর্বত, মানুষ, গ্রহ , নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদি। এ কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে আজকের পুরো দৃশ্যমান ব্রম্ভাণ্ড এই ঈশ্বরকণার দান।

------

Post a Comment

1 Comments