জ্বলদর্চি

হিমালয়ের পথে চলতে চলতে - ৮


হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || অষ্টম পর্ব

দে ব ব্র ত  ভ ট্টা চা র্য্য
       
 
কেদারনাথ দর্শন 
              
যেদিন কেদারনাথ দর্শনের আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে জ্বেলে ছিলাম -সেদিনই পবিত্রতার প্রলেপ পড়া শুরু হয়েছিল অন্তরের পরতে পরতে। আজ কেদারনাথ ধামে এসে দাঁড়িয়েছি। এখনও মন্দিরের চূড়া চোখে পড়েনি। কিন্তু এ মাটীতে পা দেওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি রোমকূপে অনিন্দ্যের স্পর্শসুখ অনুভব করলাম। 
    হীরু-জাবরুদের কর্তব্য শেষ। আমাদের ফিরে যাওয়ার কোন নির্দিষ্ট সময় সূচী নেই। এখানে রাতে থেকেও যেতে পারি। তবে এই দুপুরে যা ঠাণ্ডা ,রাত্রিতে কি এখানে থাকা সম্ভব হবে? যাই হোক হীরুদের সঙ্গে সহযাত্রা এখানেই শেষ। হীরুর পিঠে হাত রাখলাম। গভীর মমতায় মন ভরে গেল। ও তো আজকালকার ছেলে। বয়সে তরুণ, ছটপটে। কিন্তু কত মার্জিত রুচিবোধ, শ্রদ্ধাশীল। বর্তমান প্রজন্মের প্রতি মানুষের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয়েছে, হীরু যেন তার বাস্তব প্রতিবাদ। হীরু আমার লাঠি ফিরিয়ে দিল। যেন মনে মনে বলল, -
-এ হ'ল আপনার বর্তমান সাহারা। শক্ত করে ধরুন। ভাববেন আমিই পাশে আছি এখনও। 
       সামনে তাকিয়ে দেখলাম -শ'য়ে শ'য়ে ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে গায়ে গা লাগিয়ে। লেজের চামর দুলছে। ফিরে যাওয়ার জন্য ঘোড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। ফেরার ঘোড়া-মূল্য সম্পূর্ণ মালিকের। সরকার এখানে ভাগ বসান না। এখন দুপুর বারোটা। না, ভুল বললাম। এখানে দুপুর সকাল বিকেল বলে কিছু নেই। কেবল দিন আর রাত্রি। মেঘের চাদরে ঢাকা প্রকৃতি। কখনও থমথমে কখনও ঝরঝর। একটা অবাক ব্যাপার, যতক্ষণ ঘোড়ায় ছিলাম এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। মেঘ আসা যাওয়া করেছে, আলো কমেছে বেড়েছে কিন্তু ভিজতে হয়নি একটুও। বৃষ্টি হলে ঘোড়ায় বসে ঠায় ভিজতে হ'ত। এখন আবার মেঘের ঘনত্ব বাড়ছে। মনে হচ্ছে এবার ভিজতে হবে।  মজার একটা ঘটনা আছে, এখানে বৃষ্টি পড়ে না। মেঘগুলো বেমালুম জামা কাপড়ের আড়াল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সারা দেহ ভিজে একশা। আমরা হাঁটা শুরু করার সাথে সাথেই মেঘের লুকোচুরি শুরু হ'ল। যেমন ধোঁয়ায় পৃথিবী ঢাকে তেমনি মেঘের আড়ালে আমরা ঢাকা পড়ে গেলাম। দেহের কোন অংশই ভিজতে বাকি থাকলো না। অনুভব করলাম, আজ তো স্নান করা হয়নি, তাই বাবার মন্দির প্রাঙ্গণে ওঠার আগেই প্রকৃতি আমাদের সূচীস্নাত করিয়ে নিলেন। ধন্য তোমার সৃষ্টি! জয় বাবা কেদারনাথ  !
       চলতে চলতে হঠাৎ চোখের সামনে যেন অলৌকিক রত্ন ভাণ্ডারের দরজা খুলে গেল। দূর থেকে চোখে পড়ল কেদারনাথ মন্দিরের চূড়া। কত জন্মের সাধনার ধন এ দৃশ্য। যেদিন বাড়ী থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, মনে ছিল কেদারনাথ মন্দিরের ছবি। বহুবার দেখেছি বইয়ের পাতায়। আজ সেই মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি যেন। কল্পনা আর স্বপ্ন যখন বাস্তবে ধরা দেয় তখন আর ভাষা থাকে না। কেবল অন্তরে অনুরণন চলতে থাকে।
       সাত হাজার মিটার উঁচু কেদারনাথ পর্বতের সানুদেশে  কেদারনাথ মন্দির। মহাপ্রস্থানের পথে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী প্রথমবার কেদারনাথের পুজো করেন। তবে বর্তমান মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা শিবাবতার ভগবান শঙ্করাচার্য। এ মন্দিরের কাঠামো অন্তত হাজার বছরের পুরানো। 'কেদার' শব্দের অর্থ হ'ল ভূমি বা স্থান বা ক্ষেত্র। সে অর্থে কেদারনাথ হলেন ভূমিপ্রভু বা ক্ষেত্রপতি। প্রকৃতপক্ষে হিমালয়ের প্রায় সমগ্র অংশ জুড়ে মহাদেব বিরাজমান। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের প্রথমটি হ'ল কেদারনাথ ধাম। এখন শুধু আকাঙ্ক্ষা বাবার চরণ স্পর্শ করা। 
শুনেছি, বাবার চরণ দর্শনের জন্য পুরোহিত বা পাণ্ডা মশাইদের শরণাপন্ন হ'তে হয়। চাতালের এখানে ওখানে গেরুয়াধারী পুরোহিতদের চোখে পড়ল। পায়ে পায়ে একজন সৌম্য দর্শন শুভ্রকেশ  গেরুয়াধারীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি অন্য এক তরুণ পাণ্ডা মশাই এর সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখে আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। পেছনের তরুণটি বললেন, 
 -সাধনদা, আজ বিকেলে আবার দেখা হবে। 
 একদম চকচকে বাংলায় কথাগুলি শুনে মন পুলকিত হ'ল। সাধনদা মানুষটিও নিশ্চয় বাংলার সুসন্তান। নমস্কার জানিয়ে বাবার চরণ দর্শনের বাসনা প্রকাশ করলাম। বাংলার বাইরে বাঙালীরা স্বজনপ্রিয় হন।আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাধনবাবু শান্ত স্বরে বললেন ,
 -বাবাকে দর্শনের জন্য কোনও পুরোহিত একান্ত প্রয়োজন, তা কিন্তু নয়। আমরাই যজমানদের খুঁজে বের করি। এ হ'ল প্রথা। আপনারা বাংলা থেকে এসেছেন। তাই বলি, চাইলে কোনও পুরোহিত নিতে পারেন অথবা নিজেরাই পুজো দিতে পারেন। 
 আমি বললাম, 
  -তবে আমরা নিজেরাই পুজো দেবো। 
  -কোন অসুবিধে নেই। সামনের দোকানে পুজোর সামগ্রী পাবেন। বাবাকে স্পর্শ করে প্রণাম করে আসুন। আমি এখানেই থাকবো। তখন কথা হবে। 
  সাধনবাবু আঙ্গুল তুলে দোকানটি দেখিয়ে দিলেন। ভবেশদা জানতে চাইলেন, 
 - বাংলার কোন্ অঞ্চলের মানুষ আপনি। আমরা পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আসছি। 
  সাধনবাবু হাসলেন, 
  -দেখুন, আমি কিন্তু পশ্চিম -পূর্ব কোন মেদিনীপুরের নই। কেবল মেদিনীপুর জেলায় আমার বাড়ী ছিল। মুগবেড়িয়ায়। আমি যখন সংসার ছেড়ে আসি তখনও মেদিনীপুর ভাগ হয়নি।
  জানলাম, প্রথাগত ভাবে উনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেননি। হিমালয় ভ্রমনে বেরিয়ে চারধাম যাত্রার পথে বাবা কেদারনাথের চরণে এসে থেমে যান। পরে অবশ্য সারা ভারত ভ্রমণ করেছেন তবে ওনার স্থায়ী নিবাস কেদারনাথ।
  সাধনবাবুর নির্দেশিত দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটি কম বয়সী ছেলে বসে। প্যাকেটে সাজানো বাতাসা, নকুলদানা, শুকনো সন্দেশ। এ ছাড়া ফুলের মালা কুচো ফুল ও আছে। নৈবেদ্য হাতে নিয়ে বুঝেছি, ফুলগুলো সবই কাগজের। প্রতীকী। আসলে এখানে নীচের থেকে ফুল খুব একটা আসে না। তাই এ ফুলই গ্রহনীয়। 
     আমরা ব্যাগগুলো সতরঞ্জ পাতা তক্তোপোসে আর জুতো তার নীচে রেখে তৈরী হলাম। হাত মুখ ধুতে গিয়ে সে এক দুর্দশা! এ তো জল নয়, বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা ! জমে যায়নি এই ঢের। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হাতে পায়ে জল নিলাম। ছেলেটি দুজনের হাতে দুটি ডালা ধরিয়ে দিয়ে বলল, 
  -বলুন, জয় বাবা কেদারনাথ। ওঁ নমঃ শিবায়। 
      অপরূপ সুন্দর পরিবেশ। মন্দিরের পিছনে মেঘের চাদর  জড়ানো বরফে ঢাকা কেদারনাথ পর্বত। সামনে অসংখ্য পুণ্যার্থীর ঢল। মাঝে মাঝেই শব্দব্রহ্ম আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ করে বেজে উঠছে -
  ওঁ নমঃ শিবায়। ওঁ নমঃ শিবায়। 
মন্দিরের সামনেই বাবার বাহন "নন্দীঘোষ" দোর আগলে বসে। পাশে রূপোর তৈরী দীর্ঘ ত্রিশূল। পাশের প্রবেশ দ্বারে পুণ্যার্থীর সুবৃহৎ লাইন। চিন্তা না করে আমরাও সামিল হোলাম সে লাইনে। বাবার জয়ধ্বনিতে সে পথ এগিয়ে চলল। বেশী সময় কিন্তু লাগলো না। মন্দির কক্ষে প্রবেশ করলাম। সিমেন্টে বাঁধানো একটি কুণ্ডের মাঝে উঁচু পাথরের লিঙ্গরূপ। এই হ'ল মহিষরূপী মহাদেবের পেছনের অংশ। কুণ্ড ঘিরে অসংখ্য পুণ্যার্থীর ভিড়। আমরা কোন ভাবেই কাছে যাওয়ার পথ পাচ্ছি না। এখানে লাইনের বালাই নেই। এক একজন পুরোহিতের তত্বাবধানে বেশ কিছু যজমান মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। আমরা তো অভিভাবকহীন। তাই যেখানেই ঢোকার চেষ্টা করছি, পুরোহিত মশাই বড় বড় চোখ দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠছেন, --এ ভাগ্যবান, উধার যাইয়ে। ইধার নেহি। 
  আমরাও নাছোড়। 'উধারের' খোঁজে কুণ্ডকে একটু একটু করে প্রদক্ষিণ করে চলেছি। আবার একটু এগোলে আর একজন বলছেন, --ইধার নেহি বাবা, উধার যাইয়ে না! 
  -ঘুরতে ঘুরতে যখন প্রায় কুণ্ডের বিপরীত প্রান্তে পৌঁছেছি, হঠাৎ দেখলাম আমাদের পাশে আর কেউ নেই। এত এত মানুষ, সবাই আমাদের থেকে দূরে। আমরা দুজন আর আমাদের সামনে বাবা কেদারনাথ ।একেবারেই হাতের নাগালের মধ্যে। হাত বাড়িয়ে দিলাম। দু হাতের বন্ধনে জড়িয়ে ধরলাম শিলারূপী বাবার পূর্ণ শরীর। এক অনির্বচনীয় আনন্দে দেহের প্রতিটি কোষ উদ্বেলিত হ'ল। দেব শরীরের স্পর্শ যতবার অনুভব করছি ততবার সামনে দৃশ্যমান হচ্ছেন ত্রিশূলধারী সৌম্যদর্শন দেবাদিদেব। যাঁর একটি ইঙ্গিতে এ বিশ্বলোক আন্দোলিত হয়, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের নিয়ন্তা সেই জ্যোতির্ময় আমার দুটি বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ। দু'নয়নে আনন্দাশ্রু চাপতে পারছিলাম না। ভবেশদাও বাহ্যজ্ঞান রহিত। দুজনে একই সঙ্গে বাবার স্পর্শসুখ অনুভব করছি। সহসা আমরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনের চোখেই আনন্দের বন্যা। হাত ধরাধরি করে আমরা মন্দির গৃহ থেকে বেরিয়ে এলাম। হাতে জামায় সমগ্র বক্ষ জুড়ে ঘৃত স্পর্শ। মন্দিরের দেওয়াল, দরজা, বাবার প্রস্তর মূর্তি ভরে গাওয়া ঘিয়ের প্রলেপ। বাইরে এসে স্থির ভাবে দাঁড়ালাম। বাবার চরণে নিবেদিত পূজা এখন প্রসাদ। সারা দেহ মন অনুভূতি জুড়ে কেবল দেব স্পর্শসুখ। আমরা একই সঙ্গে উচ্চারণ করলাম -
  -জয় বাবা কেদারনাথ। ওঁ নমঃ শিবায়। (চলবে)

Post a Comment

1 Comments