জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান - ১০

হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-১০

তু ল সী দা স  মা ই তি


কবিগান ও কবিওয়ালাদের প্রসঙ্গ :বাংলা গানে তার প্রভাব 

"বঙ্গসহিত্যের সুরম্য উদ্যানে অসংখ্য সঙ্গীত-কুসুম প্রস্ফুটিত আছে। বেলা, মল্লিকা, জুঁই, জাতি, যুথী, গোলাপ, গন্ধরাজ- সৌরভে সে উদ্যান আমোদিত করিয়া রাখিয়াছে; অন্যত্র পলাশ, কিংশুক, অপরাজিতা, জবা, স্থলপদ্ম প্রভৃতি- উদ্যান আলোকিত করিয়া রহিয়াছে; আবার উদ্যান-বৃতি পার্শ্বে ঘেঁটু, আকন্দ, চিতা, কালিকা প্রভৃতিরও  অভাব নাই "

বাঙালির গান বিষয়ক আলোচনায় এক গবেষকের লেখা ওপরের উদ্ধৃতিটি তাৎপর্যপূর্ণ। এই সূত্র থেকেই বাংলা গানের গভীর আলোচনায় প্রবেশ করা সম্ভব। 

বাঙালির গানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রভাব তার ব্যাকরণ অনেক সময় বাংলা  গানের বহিরঙ্গ কখনো বা অন্তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আবার বাঙালি তার স্বভাবেই ভৌগোলিক, সামাজিক ও  মানবিক নিজস্ব মনন ও অনুভব নিয়ে তার গানের পসরা সাজিয়েছে। তাই বাংলা গানে এত বৈচিত্র্য। সময়ের বদলে গানেরও বদল ঘটিয়েছে বাঙালি। অষ্টাদশ শতক থেকেই চিন্তাভাবনার ধারায় একটা বড়ো পরিবর্তনের সূচনা দেখা যায়। ইংরেজ রাজত্ব শুরু হলে নবজাগরণের প্রভাব সংস্কৃতিজগতের সব ক্ষেত্রগুলিতে পড়তে থাকে। বাংলা গানেও এই প্রভাব পড়বে এতো সহজেই অনুমেয়।  বাঙালির নিজস্ব কবিগান সম্পর্কে আলোচনার আগেও তাই তার প্রেক্ষিতটিও জানা জরুরি।
 রবীন্দ্রনাথ বলেছেন "বাংলার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবিওয়ালাদের গান। ইহা এক নূতন সামগ্রী এবং অধিকাংশ নূতন পদার্থের ন্যায় ইহার পরমায়ু অতিশয় স্বল্প। এক- একদিন হঠাৎ গোধূলির সমযে যেমন পতঙ্গে আকাশ ছাইয়া যায়, মধ্যাহ্নের আলোকেও তাহাদিগকে দেখা যায় না এবং অন্ধকার ঘনীভূত হইবার পূর্বেই তাহারা অদৃশ্য হইয়া যায়-এই কবির গানও সেইরূপ একসময় বঙ্গসহিত্যের স্বল্প  ক্ষণস্থায়ী গোধূলি আকাশে অকস্মাৎ দেখা দিয়াছিল। তৎপূর্বেও তাহাদের কোনো পরিচয় ছিল না। এখনো তাহাদের  কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না'। এই কথাতেই স্পষ্ট হয় কবিগান অল্পকাল বাংলার সংস্কৃতিকে জোরালো প্রভাবিত করেই হারিয়ে যায়। তবে তার সুদূরপ্রসারী পরোক্ষ প্রভাব যে থেকেই যায় তা বলা বাহুল্য।

কবিগান একসময় বাঙালির কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণত দুই দলে ভাগ হয়ে এই গান গাওয়া হতো।  চাপান ও উতোর অর্থাৎ প্রশ্ন ও উত্তর এই ছকে সভাস্থলে দাঁড়িয়ে গাওয়ার রেওয়াজ ছিল। রাজা বা জমিদারের  ডাকে অথবা কোনো উৎসবে কবিগানের দল গান গাইতো। দলে থাকতেন মূল কবিওয়ালা যাকে সরকারও বলা হতো, সঙ্গে দোহার বা দুয়ারীবৃন্দ ও বাদকবৃন্দ। বাদকদলে ঢুলী অর্থাৎ ঢোল বাদকের ভূমিকা ছিল বেশি। তাছাড়া থাকত কাঁসি, হারমোনিয়াম কোথাও কোথাও বেহালা ও দোতারা। গায়নরীতি ছিল বিশেষ ভঙ্গি যুক্ত। গানের পদক্রম গুলি সর্বদা রক্ষা করার চেষ্টা ছিল। সাধারণ ভাবে এই গানের ক্রমে থাকতো প্রথমে মহড়া, পরে চিতেন, আরো পরে অন্তরা। চিতেন এর পর পরচিতেন ও ফুকার ,খাদ থাকতো কোনো কোনো গানে। পূর্ববঙ্গের কবিগানে এই অঙ্গগুলো ছাড়াও ধুয়া ছাড়, ফাঁদ, ডাইনা এই ক্রম দেখা যায়। মিশ,  মুখ, খোট, ধরণ, পড়ণ, ছুট্টি -নানান বৈচিত্র্য থাকতো। ভাষার চাকচিক্যে, ভাবের গাম্ভীর্যে, চিন্তার বৈচিত্র্যে ও বুদ্ধির চাতুর্যে গানের পদক্রম অনুযায়ী পরিবেশন প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা-আকর্ষণ করতো মানুষকে। সংগৃহীত বহু কবিওয়ালাদের গানে রাগ রাগিনী তালের উল্লেখ আছে। প্রচলিত রাগ রাগিনীর সাথে 'খট', 'অহং' প্রভৃতি  ব্যতিক্রমী রাগেরও উল্লেখ দেখি।

মালসি, গোষ্ঠ, ভোর ও সখিসংবাদ কবিগানের প্রাণ। তবে শহর বা গ্রাম সর্বত্রই কবিগানের নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়াও তৎকালীন সমাজের ছবি বিশেষ করে বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ, ইংরেজি সভ্যতার বাড়াবাড়ি ও স্বদেশের কথা ফুটে উঠতো। পুরাণ শাস্ত্র প্রভৃতি দারুণভাবে আসলেও গানের আসরে চটুল লঘুরস ঢেউ তুলতো।  শাস্ত্র দিয়ে শুরু হয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণও ভক্তিসূধার আবহকে নিম্নরুচির মাত্রা দিত। 

সমসাময়িক কালে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে ছিল বলেই বাংলার আনাচে কানাচে কবিওয়ালারা গানের ভাণ্ডার পূর্ণ করে। বহু গায়ক ও  রচয়িতা গান রচনা করেন। আমরা সাধারণভাবে কয়েকজন কবিওয়ালার কথাই বেশি স্মরণ করি। হরু ঠাকুর, রাম বসু, ভোলা ময়রা, আন্তোনি ফিরিঙ্গি,  গোঁজলা গুই, যজ্ঞেশ্বরী দেওয়ান রঘুনাথ সিংহ প্রমুখ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া আছেন দেওয়ান ব্রজকিশোর, দেওয়ান নন্দকুমার, দেওয়ান রামদুলাল, নীলু ঠাকুর, ভবানী বণিক, মোহন সরকার, ঠাকুর দাস সিংহ, সাতু রায় (সাতকড়ি রায়),কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, গদাধর মুখোপাধ্যায়, নিত্যানন্দ বৈরাগী, গোরক্ষনাথ ঠাকুর, নীলমণি পাটনী ঠাকুরদাস চক্রবর্তীর নাম পাওয়া যায়। গবেষকগণ পূর্ববঙ্গের আরো কিছু খ্যাতনামা কবিওয়ালা ও কবিগান রচয়িতার কথা উল্লেখ করেছেন। হরিচরণ আচার্য, নকুলেশ্বর সরকার ও কুঞ্জ দত্ত, শরত বৈরাগী, উমেশ শীল, যামিনী সরকার, ভরত শীল, বিধু দে, অম্বিকা পাটনী  প্রমুখের নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। জানা যায়, অনেকেই শুধু গান রচনা করতেন। গানের দল গঠিত হতো রথযাত্রায়। দুর্গাপূজার প্রথম দিন থেকে বাকি বছর চলতো বুকিং।
কবিগানের গায়করা গুরুর কাছেই কৌশল শিখতেন। যেহেতু সমাজের সব শ্রেণির মানুষ কবিগানের প্রতিনিধি ছিলেন তাই গান রচনার গুণমান কম বেশি হতো। কারো কারো গান নিতান্ত চটুল ও আদিরসে পূর্ণ থাকতো।  তবে বাংলাগানের যুগসন্ধিতে বহু কবিগান ছিল অপূর্ব গীতিরসে  সমৃদ্ধ। হরু ঠাকুর অর্থাৎ হরেকৃষ্ণ ঠাকুরের গান স্মরণীয়। কবিত্ব ভাবুকতা পূর্ণ। তাঁর গান শিল্পসুধারসে ঋদ্ধ। একারণেই তিনি কৃষ্ণনগর, বিষ্ণুপুর,শোভাবাজার প্রভৃতি জায়গায় ডাক পেতেন। শোভাবাজারের রাজার সভাসদও তিনি হন। তাঁর ' বড়শি গিলেছে যেন চাঁদে' গানের প্রসঙ্গটি সুন্দর ইতিহাস। তাঁর গানের কাব্যময়তা মুগ্ধ করে দেয়।  
"শ্যাম তিলেক দাঁড়াও
হেরি চিকণ কালো বরণ।
শ্যাম তিলেক দাঁড়াও।"

রাম বসুর রাধাকৃষ্ণবিষয়ক গান  মানুষের মন জয় করত। তিনি কবি দলে অনেক বড় আসনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁকে  'বিরহসঙ্গীতের রাজা' বলা হয়ে থাকে। তাঁর গানেও হরু ঠাকুরের মতো মহড়া চিতেন ও অন্তরা-এমন পদক্রম আছে।

বর্ধমানের রাজার দেওয়ান ব্রজকিশোর রায় ও তাঁর পুত্ররা কবিগান রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর পুত্র  বর্ধমান রাজ তেজেশচন্দ্রের দেওয়ান রঘুনাথ রায় প্রতিভাবান কবিগান শিল্পী। বর্ধমানরাজ তাঁর গানকে উৎসাহ দেওয়্যার জন্য দিল্লি ও লখনৌ থেকে গানের ওস্তাদ নিয়ে আসতেন। 
ভোলা ময়রা, আন্তোনি ফিরিঙ্গি, গোঁজলা গুই যজ্ঞেশ্বরী প্রমুখের কবিগান পরবর্তী বাঙলা গানের নানা দিককে প্রভাবিত করতে পেরেছিল। ভোলা ময়রা হরু ঠাকুরের শিষ্য হলেও তার নিজেস্ব প্রতিভায় তিনি শ্রোতার মনে স্থান করে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। সাতু রাযের লেখা কবিগানও তিনি গাইতেন। আন্তোনি ফিরিঙ্গির গান বাংলার মানুষের কাছে প্রিয়তা লাভ করে। শাস্ত্র অর্জন করেও তিনি মানবধর্মের জয়গান গেয়েছেন। তাঁর  'খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই' পঙক্তি তো বাঙালির অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। পূর্ববঙ্গের রামরূপ ঠাকুরও কবিগানের জগতে অবদান রেখে গেছেন।
বঙ্গভূমির সর্বত্র বহু কবিওয়ালা কবিগানের আসর মাতিয়েছেন। গান গেয়েছেন। সবার নাম জানা যায়নি। অনেকে হারিয়ে গেছেন। তবুও হারিয়ে যাওয়া সেই অনুষঙ্গগুলি বাংলার সংস্কৃতিতে রয়ে গেছে। অসংখ্য ঢোল বাদক যাঁরা আসরকে প্রাণবন্ত করে তুলতেন তাঁরাও রয়ে গেছেন হৃদয়ের গভীরে। কবিওয়ালাদের জীবনী অনুসন্ধান করেছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। নিজেও কবিওয়ালা ছিলেন। কবিগানের প্রতি 'স্বাভাবিক প্রীতিবশত' তিনি কবিওয়ালাদের জীবনী সংকলিত করেছেন। 'কবিজীবনী' গ্রন্থটি বাঙালির কাছে বিশেষ সমাদৃত। রাম বসুকে তিনি বলেছেন 'কবিওয়ালাদের কালিদাস'। 
 কবিগানে উঁচুদরের শিল্পী যেমন অনেকেই ছিলেন তেমনই  সময়ের চাহিদায় অথবা কিছু নিম্ন রুচির শ্রোতার আবেগকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে একটা সময় তার উচ্চমান রক্ষা করা যায়নি। ব্যক্তি আক্রমণ ও লঘুরসের আধিক্য নবজাগ্রত বাঙালির মননে আঘাত করছিল বলেই শিক্ষিত সমাজ তাঁকে বর্জন করতে থাকে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে নির্মিত হওয়া একটা সংস্কৃতি বাঙালির মন অধিকার করেই থেকে যায়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যাযের কথায়-
"রসসঞ্চয় ও রস আহরণের পূর্বতন আয়োজনগুলি  সবই বিপর্যস্ত হইয়াছে। এখন জনতার শতমুখে যাহা নিঃসৃত হয় তাহা রাজনৈতিক উগ্র সুরা, ভক্তিরসমধূর কাব্যসুধা নহে। তথাপি সাহিত্যের ইতিহাসে এই কবিগানের একটি চিরন্তন তাৎপর্য  আছে।"
কবিগান বাঙালির একান্ত নিজস্ব। বাঙালির মৌলিক আবেগ প্রতিফলিত হয়েছিল বলেই আজও  বাঙালি ভুলে যায়নি। তাকে যত্নেই তুলে রেখেছে  বাংলা গানের ঐতিহাসিক উঠোনে।( চলবে)
----

Post a Comment

0 Comments