জ্বলদর্চি

শ্রদ্ধা ও স্মরণে সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী /সোহম সেন

সো হ ম  সে ন

আজ সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর অমর হওয়ার দিন

কানাড়া সাহিত্যিক সুধা মূর্তি লিখেছিলেন ‘মহাশ্বেতা’ নামে একটি উপন্যাস, যার মুখ্য চরিত্র ‘অনুপমা’ নাম্নী এক নারীা। আর বাংলায় আমরা পেয়েছি মহাশ্বেতা নামেই এক নারীকে। বিপ্লবিনী, সংবেদনশীলা এই সুলেখিকা সরস্বতী-সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষের সাধনাই করে গেলেন আজীবন। কেবল খাতায়-কলমে নয়, মানুষের মাঝখানে মাঠে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাহিত্য অকাদেমি থেকে আরম্ভ করে পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, জ্ঞানপীঠ, রামন ম্যাগসেসে, সার্ক সাহিত্য সম্মান প্রভৃতি পুরস্কার ও সম্মান সারা জীবনে অসংখ্য পেয়েছেন। কিন্তু তা দিয়ে মহাশ্বেতা দেবীকে বিচার করা যায়না। 

মহাশ্বেতা দেবীর সমস্ত সৃষ্টি নিয়ে বিশদে আলোচনা করবার সুযোগ এ ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের নেই। আর প্রতিটির অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আমরা করবও না-- কারণ তা করলে সেটা হয়ে যাবে, যাকে আজকের ভাষায় বলে ‘স্পয়লার’, একেবারে তাই-ই। প্রায় শতেক উপন্যাস আর অগণিত ছোটগল্পের প্রসূতি মহাশ্বেতা। অমূলক রোমান্টিসিজম নয়, কল্পনার উচ্চ সৌধশিখরে বসে বাস্তবের রুক্ষ, কঠিন দুনিয়াকে বিস্মৃত হয়ে নয়; মহাশ্বেতা তাঁর নর-নারী চরিত্রদের তুলে এনেছেন জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর লেখনী স্পর্শ করেছে অন্তেবাসী মানবসমাজকে; কাহিনি আবর্তিত হয়েছে প্রান্তিক মানুষদেরকে কেন্দ্র করে। ভারতের অসংখ্য অনার্য আদিবাসীগোষ্ঠী-- শবর, লোধা, সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহালি আদি জনগোষ্ঠীই আমাদের দেশের প্রকৃত অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক শাসনকাল হোক কিম্বা স্বাধীন ভারত, এরাই রয়ে গিয়েছে সবার পিছে, সবার নীচে। তাদের একটা আলাদা সমাজ আছে, আছে একটা পৃথক জীবনযাপন পদ্ধতি, একটা বহুকাল-লালিত আপন সংস্কৃতি, নিজেদের মতো লোকাচার, প্রথা। মহাশ্বেতা আপন জীবনের পরতে পরতে এই আদিম, সুসংহত জীবনধারাকে অনুভব করতে চেয়েছেন। এই দিদৃক্ষাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছে বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, ছত্তিসগড়ের অরণ্যজীবী আদিবাসী সমাজের খুব কাছে, হয়ে উঠেছেন তাদেরই একজন। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বিচ্ছেদহীন সঙ্গিনী। কখনও বিজ্ঞাননিষ্ঠ আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে তাদের পরিচয় ঘটিয়েছেন, তো কখনও তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রাপ্য অধিকারটুকু লড়ে আদায় করে নেওয়ার প্রবল সংগ্রামী ইচ্ছের সম্ভাবনাগর্ভ বীজ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনেতিহাস থেকে তুলে এনেছেন বলিষ্ঠচিত্ত মরণপণ সংগ্রামের আখ্যায়িকা, উলগুলানের তেজোদীপ্ত ইতিবৃত্ত। জন্ম নিয়েছে ‘অরণ্যের অধিকার’। বীরসা মুন্ডার সংগ্রামকে সামনে রেখে মহাশ্বেতা আসলে বলেছেন প্রতিটা বঞ্চিত ও অত্যাচারিত মানুষেরই গল্প-- এখানেই তিনি অতিক্রম করে গিয়েছেন কালসীমা, হয়ে উঠেছেন যুগোত্তীর্ণ। কোল বিদ্রোহ, তামাড় বিদ্রোহ, সিধু-কানুর হুল থেকে শুরু করে তেভাগা আন্দোলন হয়ে নকশাল আন্দোলন-- যেখানেই রাজনীতির কায়েমি স্বার্থ, মানুষের অপমান আর বঞ্চনার বিপ্রতীপে সমবেত প্রতিবাদী কণ্ঠ সোচ্চার হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, সেখানেই মহাশ্বেতা পৌঁছে গিয়েছেন সাহিত্যের তরণী বেয়ে, বৈঠা আপোসহীন লেখনী। জন্ম নিয়েছে ‘হাজার চুরাশির মা।’ মর্গের ১০৮৪ নম্বর লাশের মা-- যার সন্তান ‘ব্রতী’ আরেক নতুন স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মহৎ ব্রতে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে গত শতকের অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিখিত হয়েছে এই মর্মন্তুদ উপন্যাস। 

আমাদের পড়তে হবে ‘মূর্তি’, ‘নৈঋতে মেঘ’, ‘স্তন্যদায়িনী’, ‘চোট্টিমুন্ডা এবং তার তীর’ ও আরও অনেক গল্পসঙ্কলন এবং উপন্যাস, ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের উপর গবেষণামুলক  গ্রন্থ যা মহাশ্বেতা তাঁর পড়াশুনো ও জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত করে লিখেছেন। দল নির্বিশেষে রাজনৈতিক অপশাসনের বিরুদ্ধে বলেছেন আজীবন। কল্যাণকামী রাজনীতিতে প্রতীতি রেখে সমস্ত অকল্যাণ, অত্যাচার, অসমতার ‘বিরুদ্ধে নিরঞ্জন, শুভ্র সূর্যমান’ অসন্তোষ আর ক্রোধ থেকেই সঞ্চয় করেছেন দৃপ্ত অস্মিতা ও লেখার প্রেরণা। অ্যাপ্রিহেন্ডেড হওয়ার পর গণধর্ষিতা হয়েও দোপদি মেঝেন যখন সম্বিত ফিরলে আকাশ আর চাঁদকেই দেখতে থাকে, তখন কি আমদের চোখের কোণ হ’তে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে না?

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। আলোকের স্পর্শ পেলাম।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো। আলোকের স্পর্শ পেলাম।

    ReplyDelete