জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / গৌতম বাড়ই

বাইশে শ্রাবণ

গৌ ত ম  বা ড় ই

আজও বাংলা ক্যালেন্ডার বেঁচে আছে  পয়লা বৈশাখ বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। পঁচিশে বৈশাখ আর বিষাদময় কালো অক্ষরের বাইশে শ্রাবণ এলে আমরা যেন আরো একবার হাতড়াই ঐ বাংলা ক্যালেন্ডারে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিনে এক উদভ্রান্ত ছবি দেখেছিল মহানগর কলকাতা। বুদ্ধদেব বসুর 'তিথিডোর' উপন্যাসের নায়িকা স্বাতীর সেই শোকার্ত ভিড়ে দেখা হয়েছিল এক কবির সঙ্গে। একা একা দোকানে বসে মদ খাচ্ছিলেন। তার মনে হয়েছিল জনতার ঐ শোকোচ্ছ্বাস আসলে বাঙালির সহজাত হুজুগ। তারা কথা ও কাহিনী ছাড়া রবীন্দ্রনাথ পড়েনি, পড়লেও বোঝেনি, বুঝলেও মানেনি। যাদের সমস্ত অস্তিত্বটাই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধতা, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের অভাবটা ব্যথা হয়ে বাজতে পারে না।
নিমতলাঘাটে লোকারণ্য। সেই প্রথম কলকাতার রাজপথে লক্ষ মানুষের ঢল।কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না। আমাদের রবীন্দ্রনাথ তাঁর নশ্বরদেহে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলেন জোড়াসাঁকোর কাছেই নিমতলা শ্মশানঘাটে।
তিথিডোর উপন্যাসের সেই কাল্পনিক কবি ধ্রুব দত্ত। বিচ্ছিন্ন আর আত্মম্ভরি। জনতা বিষয়ে উন্নাসিক। এই রকম লেখকদের প্রতিভূ হয়ে বলতেই পারেন মদের ঠেকে, ঠোঁট বেঁকিয়ে----আমি বেরিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ ঘুরলাম রাস্তায় রাস্তায়,তারপর টিকতে না পেরে ঢুকে পড়লাম এখানে।
বাঙালির রবীন্দ্র চর্চা কিশোর কণ্ঠে জনপ্রিয় কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীতে। অথচ তাঁকে সঠিকভাবে আজও জানা হলো না বা বলতে গেলে জানা হতে দিলো না। এক ধরনের এলিটিসিজম এর ঢালে। মুক্তির বাতাস ছিলো তার সাহিত্যে প্রবন্ধে কবিতায়। সাধারণ জনগণ ব্রাত্য থেকেই গেলো। তাই তো ক্ষোভের সঙ্গে বেরিয়ে আসে দেবব্রত বিশ্বাসের ব্রাত্যজনের রূদ্ধ সঙ্গীত‌।
কবির কলমে ঝরে পড়ে তাঁর মৃত্যুর সেই অমোঘ ভাবনা--মরিতে চাই না আমি সুন্দর ভুবনে। এই সুন্দর ভুবন এই প্রকৃতি এই চাঁদ তারা সূর্য আকাশে কবি প্রাণ খুঁজে পেয়েছিলেন। খুঁজে বেরিয়েছেন সেই মানবতাবাদী ঈশ্বরকে মানুষের মাঝে।মন্দিরকে ধুলোয় মেখে বলেছেন মানুষের দেবতাকে খুঁজে নিতে। দেবতা মানুষের মাঝেই বিরাজ করছেন। তাই তো তিনি বিশ্বকবি। তাই তো তিনি ঋষি। বাইশে শ্রাবণ তথ্যচিত্রের সেই দৃশ্য আর এক প্রয়াত বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালকের হাত ধরে আমাদের মনে ভেসে ওঠে শায়িত সেই কবির সাদাকালো ঋষিসুলভ দীপ্তিময় মুখ। বাইশে শ্রাবণ তাই এক কালো অক্ষরময় দিন আমাদের বাঙালিদের কাছে।
কবির মৃত্যুর ক'দিন আগে উনি ইনজেকশন নিচ্ছেন আধা চেতনে আছেন। অসম্ভব কাঁপুনি। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন। দিন কয়েক আগেই কলকাতা এসেছেন তাঁর নিজের গড়া ভুবন শান্তিনিকেতন থেকে।সবার তোড়জোড়ে উপায় নেই। এ শরীর যদি কলকাতা শহরে গিয়ে একটু মেরামত করে আরও দু-চারটি বছর টেকানো যায়।কবি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুক ভঙ্গীতে শান্তিনিকেতন ছাড়বার আগে বলছেন--আমাকে মারবার ব্যবস্থা করতে নিয়ে যাচ্ছ না তো?

মৃত্যুর আগের পক্ষকালের কম তখন, কবির মুখে তখনও কবিতা-
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে-
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-
কে তুমি।
পেল না উত্তর।

মনে রাখতে হবে তার আগের দিনেও কবির ধূম জ্বর। কবির চেতনায় কবিতার মৃত্যু হয়নি তখনো।
বাইশে শ্রাবণে গাঁথতে চাই আরও একটি বিষাদগুচ্ছ। সেদিন চৈত্রমাস শান্তিনিকেতনে দেখলাম কবির সর্বনাশ। ২৪শে মার্চ, ২০০৪ রবিকোষের সেই মস্তচুরি! না ওটা ইংরেজি ক্যালেন্ডারেই গাঁথা থাক। নোবেল পদক চুরির দিনটি। বাঙালি ঠিক এতদিন পরেও রবি ভাবনার চরম দায় চুকালো। বাইশে শ্রাবণের ব্যথাতুর দিনে তাই বাজে এখনও বিষাদের সেই কালোদিনও। রবির আপনগৃহে খোয়া গেলো আমাদের রবি।নিমতলার আকাশে কি দেখা যায় একখণ্ড বর্ষার কালো মেঘ বাইশে শ্রাবণে?



Post a Comment

0 Comments