জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

তুমিই আকাশ, তুমি নীড়

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

"মানুষের চিত্ত যেখানে সবল থাকে সেখানে সে আপনার নিহিতার্থকে আপন শক্তির যোগে উদ্বোধিত করে........ মানুষের সকলের চেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে, সে সৃষ্টিকর্তা।" --- রবীন্দ্রনাথ। 

 বুদ্ধদেব তার মৃত্যুর সময় শিষ্যদের বলেছিলেন, প্রকৃত বৌদ্ধ তিনি যে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা আলোয় পথ চলবে। অন্যের দেখানো আলো বা নির্দেশে পথ চলবে না। প্রকৃত বৌদ্ধ বুদ্ধকে উপাসনা করারও দরকার নেই। কিন্তু কিছু অতি বৌদ্ধ বুদ্ধদেবকে দেবতা বানিয়ে ছেড়েছেন। যে দেবতার রূপ আমরা মনে মনে বা শাস্ত্রে কল্পনা করি, যদি তাদের কেউ অন্ধকার রাত্রে আমাদের সামনে পড়েন, নিশ্চিত আমরা ভয়ে মূর্ছা যাবো বা প্রাণপণে দৌড়ে এসে ঘটি ঘটি জল খাবো। আমরা পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রনাথকে মালা পরিয়ে ধুপধূনা জ্বালিয়ে তাকে দেবতায় পর্যবসিত করেছি।  গোরা থেকে রক্তকরবী, স্ত্রীর পত্র,... এর লেখককে ঘষে মেজে ডিম্বাকার শালগ্রাম শিলায় পরিণত করেছি। যে দেবতা স্বর্গে থাকে, কার কি উপকারে লেগেছে আমার অন্তত জানা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমার রক্তে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে শোকে দুঃখে স্বদেশে বিদেশে যাকে অনুভব করি, তাকে আমরা দেবতা বানিয়ে কল্পলোকের বাসিন্দা করেছি৷ এ ভীষণ লজ্জার! এত লজ্জা যে, মুখ লুকোনোর জায়গা থাকে না৷ 
রবীন্দ্র-জীবন চার পর্বের! প্রথমত বাঙালী কবি। দ্বিতীয় ভারতের কবি। তৃতীয়ত বিশ্বকবি। চতুর্থ নির্বিশেষে মানবতার কবি। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে সংসারের দুঃখ, সংঘাত, ভাঙাচোরার পেছনে এমন কোনও চৈতন্যময় পুরুষ আছেন যিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিজ্ঞানও তাই মনে করে যে এই পৃথিবীর প্রত্যেকটি বস্তু অসংখ্য অণু পরমাণুর সমষ্টি, এই অণু-পরমাণুকে এক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ রেখেছে এক শক্তি। সেই শক্তিকে রবীন্দ্রনাথ এক চৈতন্যময় পুরুষ বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দুঃখে সান্ত্বনা! তিনি দেখিয়েছেন তার লেখায় আজীবন সাধনায় যে ফুল না ফুটে ঝরে যায় বা যে মানুষ অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে মারা গেল তার পেছনে রয়েছে এক গোপন সার্থকতা! এর ফলে এই পৃথিবীর কোন দুঃখ আমাদের দুঃখিত করে না। পৃথিবীকে সুন্দর লাগে।আমাদের মনে প্রেম করুণা সৌন্দর্য ধৈর্য্য, প্রীতি মানবীয় গুণের প্রকাশ ঘটে।
তিনি আমাদের শেখালেন, "না রে, না রে, ভয় করব না বিদায় বেদানারে।" আমরা যদি বিশ্বসংসারের নিয়মের সঙ্গে সহজে না খাপ খাওয়াতে পারি, তার সঙ্গে মিল খাওয়াতে নিজেরা যদি তার মত করে নিজেদের না তৈরি করতে পারি তবে আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। এই খাপ খাওয়াতে গেলে কিছু ত্যাগ করতেই হবে। তা যদি না করি, তবে প্রকৃতির নিয়ম আমাদের কান ধরে বাধ্য করবে তাঁর অনুগত করবে। কারণ শিশু গর্ভ ত্যাগ করলেই মাকে পায়। তাই তো রবীন্দ্রনাথ বলেন, "আমরা ত্যাগের মধ্যে আনন্দ পাইনা বলে, মৃত্যু আমাদের কাছে ভয়ের কারণ।" এই ত্যাগের মধ্যে যে প্রেম পাওয়া যায়, তা রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন। যা আমার দিতে ইচ্ছা নেই কিন্তু বাধ্য হয়ে অনিচ্ছায় যখন দিই তা ত্যাগ নয়। কিন্তু আমরা ভালোবেসে যা দিই তাই প্রকৃত দেওয়া। কে আমাকে প্রকৃত ভালোবাসে? সেই প্রকৃত ভালোবাসে যে নিজস্ব প্রয়োজনে দেয় না, তবু আমার জন্য সে সমস্ত দিতে প্রস্তুত। এই দেওয়া হচ্ছে আনন্দের, কোন চাপে পড়ে নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "প্রেম নিজের নিয়মেই নিজে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত, সে নিজের চেয়ে উপরের আর কারও কাছে কোন কৈফিয়ত দেয় না।"
আজকের করোনা ভাইরাস যখন বিশ্ব মহামারি আকার ধারণ করছে। তখন ছিল প্লেগ। এই প্লেগ অতিমারীতেও আমরা রবীন্দ্রনাথকে পাই। এই প্লেগকে কেন্দ্র করে, ইংরেজদের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। তিনি ভারতী পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে "প্রজাবিদ্রোহ" নামে একটি নতুন শব্দ রবীন্দ্রনাথ উদ্ভাবন করেন। তিনি লেখেন, "আমরা ক্ষুব্ধ হইলে রাজবিদ্রোহ। কিন্তু রাজারা রুখিয়া থাকিলে তাহা কি প্রজাবিদ্রোহ নয়। উভয়ের ফলই কি সমান অমঙ্গলজনক নহে?" প্লেগ যখন ভারতে মৃত্যুর মিছিল নিয়ে হাজির, তখন সমগ্র ভারত জুড়ে বিদ্রোহ দানা বাঁধে। এই বিদ্রোহকে দমনের জন্য ইংরেজ সৈন্যদের বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে টাউন হলে যে জনসভা হয় রবীন্দ্রনাথ  সেখানে একটি প্রবন্ধ পড়েন যার নাম "কন্ঠরোধ"। আজকের চারদিকে করোনা ভাইরাসের অতিমারী ঠেকাতে যে অব্যবস্থা চোখে পড়ে, সেদিনও সেই একই অব্যবস্থা ছিল। আজকের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বা সাধারণ মানুষদের জন্য কোয়ারেন্টাইন সেন্টার, সেদিনও ছিল বহিরাগত যাত্রীদের জন্য প্লেগ নির্ণায়ক কেন্দ্র। স্থাপন হয়েছিল খানা জংশন, কাঠিহার ও দামুকদিয়ায়। আজকের যেমন এই কেন্দ্রগুলিতে অব্যবস্থা সেদিনও ঠিক একইরকম ছিল। রবীন্দ্রনাথ এই "কণ্ঠরোধ" প্রবন্ধে লেখেন, "খানা জংশনে যখন প্লেগ-সন্দিগ্ধদের বন্দীশালা দেখিতাম তখন বার বার একথা মনে হইত যে অশোকের ন্যায় আকবরের ন্যায় কোনো প্রাচ্য রাজা যদি সাধারণের হিতের জন্য করিতেন..... ব্যবস্থা কখনোই এমন দীনহীনও একান্ত আপত্তিকর হইত না।" এই প্লেগ প্রতিরোধের জন্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ঘোরেন এবং চুন বিলি করেন। 
রবীন্দ্রনাথের জীবন তাঁর সৃষ্টির থেকে পথভ্রষ্ট হয়নি। তিনি আমাদের সুখ দুঃখ ভালোমন্দ আশা নিরাশাকে ভিত করে তিনি তার সৃষ্টির ইমারত বানিয়েছেন। একদিকে একক অন্যদিকে বহুমুখী তাঁর মন ও প্রতিভা। তাই রবীন্দ্রনাথকে বলতে পারি তাঁরই ভাষায়, "একাধারে তুমিই আকাশ তুমি নীড়।"


Post a Comment

0 Comments