জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / সন্দীপ দত্ত

 

অন্তহীন পদচিহ্ন

 স ন্দী প  দ ত্ত


যাঁর বিচিত্র সৃষ্টিসম্ভার নিজস্ব এক পৃথিবী ধারণে সক্ষম, তাঁর অপার দৃঢ়তার কাছে বারে বারেই আমাদের নত হতে হয়েছে। এ নত হওয়ার গরিমা বাঙালির হৃদয়কে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অমূল্য সেই বোধের কাছে, যেখান থেকে শুরু হয় অন্তহীন রবীন্দ্রচেতনায় পথ চলা।
    মৃত্যু  মানে কি শুধুই শূন্যতা? কবিগুরুর কাছে শূন্যতা বলে কিছু নেই। কোনোদিন ছিল না। মাত্র চব্বিশ বছর বয়স থেকেই পরিবারের একের পর এক মৃত্যু  দেখেছেন তিনি। মৃত্যুর হাহাকার ধ্বনি রবীন্দ্রনাথকে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ঋদ্ধ করেছে। খুঁজে পেয়েছেন জীবনপ্রবাহকে। তিনি জানতেন, একমাত্র অভিজ্ঞতাই আগুন হয়ে মানুষের নরম মনকে লোহার মতো শক্ত করে। বাধাময় পৃথিবীতে মনের দৃঢ়তাটা সবথেকে জরুরি। চলার পথে ঝড়ের ঝাপট সহ্য করতে না পারলে কীসের এগোনো?
    দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে কবি প্রথম পরোক্ষ মৃত্যুর মুখোমুখি হন বউঠানের আত্মহননের সময়। কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু  রবীন্দ্রনাথকে যে চরম সত্যের সামনে দাঁড় করায়, তা আরও  চূড়ান্ত হয় পত্নীবিয়োগ যন্ত্রণায়। লিখলেন, "আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো।"
     প্রথম জীবনে মৃত্যু  আর শেষ জীবনে মৃত্যুর উপলব্ধি প্রসঙ্গে কবি বলেছিলেন, "মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি আমার কাব্যের এমন একটি বিশেষ ধারা নানা বাণীতে যার প্রকাশ।"
    রবীন্দ্রনাথের জীবন যতই অস্তাচলগামী হয়েছে, মরণ সম্পর্কে অনভূতিতে এসেছে গভীরতা। তিন সন্তানকে খুবই কম সময়ের ব্যবধানে হারানো এমনকি পরম স্নেহধন্য কনিষ্ঠের অকালমৃত্যু কবিকে শক্ত হয়ে বলতে শেখালো, "মৃত্যু  যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক / তবে তাই হোক।"
    ১৯৩৭ সালের সপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করেই কবি যখন অচেতন হয়ে পড়েন, মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে ভাবনায় প্রকাশ পেল " দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায় / দেহ মোর ভেসে যায় কালিন্দী স্রোত বাহি / অন্তহীন তমিস্রায়।"
    ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের শরীর আরও ভেঙেছে। ১৯৪০ সালের শেষের দিকে কালিম্পঙ সফরে গিয়ে তিনি অনুভব করেন "ভিতরের যন্ত্রগুলো কোথাও কোথাও যেন বিকল হয়ে গেছে।"
     তবু জীবনের প্রতি কী ভীষণ আকুতি ! ১৯৪১ সালের শেষ জন্মদিনকে কেন্দ্র করে ভেতরের অব্যক্ত ইচ্ছেটা বলতে হল, "হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।"
    আমাদের দুর্ভাগ্য, রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড়ো একজন কাছে পেয়েও শিক্ষিত হওয়ার যে দৃঢ়তা, তা রপ্ত করতে পারলাম না। পৃথিবীর কোনায় কোনায় আজ যখন হতাশার বীজ ছড়িয়ে পড়ে, অবসাদের ভাইরাস ছুটে বেড়ায়, মৃত্যুচিন্তা চলার পথকে প্রতিহত করে, মুষড়ে পড়ি।
    ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু  বাঙালির চিরন্তন আবেগে এক বড়ো ধাক্কা। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনুভবে, "গহন গভীর উৎস হতে/ছড়িয়ে আছ শেষ চেতনা প্রান্তে।"
   কবি দিনেশ দাশের কথায়, "আমার সর্বাঙ্গ যখন অবসন্নতায় জড়িয়ে আসে / তখন আমি তোমাকে অনুভব করি / আমার চোখের পাতার নীচে / একটি পবিত্র প্রার্থনার মত।"
   শ্রাবণের ধারায় আজও যখন প্রকৃতি স্নাত হয়, সবুজে সবুজে ভরে ওঠে চারপাশ, ২২ শে শ্রাবণ আসে। রবীন্দ্রনাথকে হারিয়ে ফেলার বেদনা অনুভব করি। মনখারাপ লাগে। কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর বাণী থেকে সাহস সঞ্চয় করি। "ফুলের মধ্যে পাই তাঁহাকে/জলের মধ্যে পাই/আলোতে পাই, ছায়াতে পাই / পাই দুঃখের কালে।"
   শ্রাবণ মাস আর সতেজতা, বারিধারা আর জীবন অনন্য প্রতীকী হয়ে আসে। কবি জয় গোস্বামী বলেছেন, " রৌদ্র নিয়ে, বৃষ্টি নিয়ে, প্রতি বছর / সবার চোখ আড়াল দিয়ে, প্রতি বছর /কে জন্মায়?"
    জন্মায় আমাদের আবেগ। বাঙালির বেঁচে থাকার চিরন্তন  রসদ।

Post a Comment

0 Comments