মৃত্যু-শ্রাবণ মরণযাপন
রা জ র্ষি রা য়
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা- সেও তো এক ধরনের স্রোতের অনুকূলে যাত্রা, যদিও সে যাত্রা কখনো কখনো কারুকে আবার বাঁচিয়ে তোলে, ভাবিয়ে তোলে কিংবা জীবনের কাছে নতজানু হতে শেখায়। মহৎ মানুষের কাছে কিংবা মহৎ জীবনের কাছে আমরা কি চাই? আমরা কি তাঁর জীবনকে অনুকরণ করে যাই, নাকি তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এই পৃথিবীতে চলার পথকে সুগম করতে চাই? সেই প্রশ্নটা আজ বড় হয়ে, বৃহত্তর হয়ে আমাদের কাছে ঘুরে ফিরে আসে। আসলে আমরা তো তাঁর তুলনায় অতি সামান্য মানুষ। আশ্চর্য! আমরা আসলে কি মানুষ হতে পেরেছি? প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ অর্থে আমরা যা বুঝি কিংবা বুঝতে চেষ্টা করি তা কি আদৌ রবীন্দ্রযাপনে সম্ভব হয়েছে? তাঁর চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন, রচিত শিল্প-সৃষ্টি, কি আমাদের কোনভাবে ভাবায়? অথবা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা-চেষ্টা-ক্লান্তি-প্রেম-অবসাদ,
ভালোবাসা-দুঃখ-ঘৃণা-ভয় প্রভৃতি অধরা মানবিক গুণগুলি কি আমাদের কোনও শিক্ষা দেয় আদৌ? সেটাই আজকের দিনে বুঝে নেওয়া দরকার।
এখানে কেবলমাত্র তাঁর একটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তা হলো তাঁর মৃত্যুযাপন বা মরণ-ভাবনা। তিনি তাঁর আশি বছরের অভিজ্ঞতায় জীবনের বিপ্রতীপে অবস্থিত মৃত্যুকে নানাভাবে উদযাপন করেছেন নিজস্ব আত্মিক তন্ময়তায়। তাঁর মায়ের মৃত্যু থেকে নিজের চলে-যাওয়ার শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মৃত্যুকে কত ঘনিষ্ঠভাবে যে অনুভব করেছেন তা বলাই বাহুল্য। তবু মনে রাখতে হবে কোনও মৃত্যুই তাঁর কাছে কোন পার্থিব শোকের বার্তা বহন করে আনেনি, বরং নিজস্ব আত্মিক সাধনার দ্বারা বারবার সেই মৃত্যুকে নতুন রূপে দেখেছেন। সমস্ত বিচ্ছেদের মধ্যেই তিনি বিশ্ববিধাতার অবিচ্ছিন্ন নিয়ম দেখতে পেয়েছিলেন। বলেছেন-
"সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবন-মৃত্যুর হরণপূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে,"
(জীবনস্মৃতি)
আমরা যদি শুধু তাঁর 'সঞ্চয়িতা'র কবিতাগুলি লক্ষ্য করি, তাহলেই দেখব তাঁর সারা জীবনের কাব্যসাধনার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলির মধ্যে প্রায় পঁচিশটি কবিতায় মৃত্যুচেতনার কথা আছে। 'সঞ্চয়িতা'র প্রথম কবিতা 'মরণ' থেকে শুরু করে-- প্রাণ, মৃত্যুর পরে, মৃত্যু, বিদায়, মরণমিলন, জন্ম ও মরণ, অসমাপ্ত, দিনান্ত, মোহন মৃত্যু, মৃত্যুঞ্জয়, ওই মরণের সাগরপাড়ে, দিন যদি হল অবসান, কান্নাহাসির-দোল-দোলনো, যাবার সময় হল বিহঙ্গের, অবসন্ন চেতনার গোধূলি বেলায়, স্মরণ, ধূসর গোধূলি লগ্নে, আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু, পথের শেষে, সংসারের প্রান্ত জানালায়, রূপনারানের কূলে, দুঃখের আঁধার রাত্রি, তোমার সৃষ্টির পথ- -----প্রভৃতি কবিতাগুলির মধ্যেও তিনি মৃত্যুকে নানারূপে আবর্তিত হতে দেখেছেন ও অনুভব করেছেন। তাঁর মৃত্যুদিনে দাঁড়িয়ে এবং আমাদের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যুভাবনা কি প্রাসঙ্গিক নয়? যদি আমরা এই পৃথিবীতে প্রাণী হিসেবে বা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকি তাহলে তাঁর বিপরীতে এই যে লেলিহান মৃত্যুচিন্তা তা কি আমাদের আরও একবার রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে বলে না? বলে না কি সেই মৃত্যুকে জয় করার শিক্ষা নিতে? তাঁর জীবন ও সৃষ্টি তো আমাদের সেই শিক্ষা দেয়।
জীবনের প্রথম দিকে 'ভানুসিংহের পদাবলী'তে তিনি অনুকরণের মধ্য দিয়ে যে সুর নিজের অলক্ষ্যে রচনা
করেছিলেন--
"মৃত্যু অমৃত করে দান
তুঁহু মম শ্যাম সমান।"
সেই তিনিই আবার পরে মৃত্যুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলেছেন-
"মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে-
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।"
-এই দুই বিপরীত ভাবনা যে কবির, সেই কবিই একদিন আবার 'আত্মপরিচয়'-এ বলেন-
"অনাদিকাল হইতে বিচিত্র বিস্মৃত অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে আমার এই বর্তমান প্রকাশের মধ্যে উপনীত করিয়াছেন- সেই বিশ্বের মধ্য দিয়া প্রবাহিত অস্তিত্বধারার বৃহৎ স্মৃতি তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া আমার অগোচরে আমার মধ্যে রহিয়াছে।"
এই 'তিনি' কে? তাঁকে পাওয়ার বা জানার চেষ্টা কেন কবির? তার উত্তরে তিনি আমাদের বলেছেন-
"যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাকেই আমার কাব্যে আমি 'জীবনদেবতা' নাম দিয়াছি।"
এই জীবনদেবতা'র দ্বারা রবীন্দ্রনাথের জীবন যেমন প্রভাবিত হতে পেরেছিল তেমনি আমাদের প্রত্যেকের জীবনেও যেন একজন করে জীবনদেবতা আছেন। তিনি আমাদের জীবনকে পরিচালিত করছেন প্রতি মুহূর্তে। তাই কবি বলেন-
"বিশ্বব্যাপী জন্ম-মৃত্যু সমুদ্র দোলায়/
দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার-ভাঁটায়।"
সমস্ত মানুষের মধ্যেই আছে তার নিজের ধর্ম। কিন্তু তাকে স্পষ্ট করে জানার চেষ্টা করতে হয়, তা হয়তো সকলে পারেন না। সেই কারণে কবি বলেন-
" মানুষের প্রত্যেকের মধ্যে সত্যের একটি বিশ্বরূপ আছে, আবার সেই সঙ্গে তার একটি বিশেষ রূপ আছে সেটি হচ্ছে তার বিশেষ ধর্ম।"
এই বিশেষ ধর্মের গুণেই আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন,আবার কোথাও এক। কিন্তু কবি বলছেন-
"বিশ্ব মানবের ইতিহাসে যে একজন চিন্ময় পুরুষ সমস্ত বাধাবিঘ্ন ভেদ করে দুর্গম বন্ধুর পথ দিয়ে চালনা করছেন এখানে তারই কথা দেখি।"
অর্থাৎ বিচ্ছেদের মধ্যেও তিনি সেই চিন্ময় পুরুষকে দেখতে পান। তাইতো তিনি বলতে পারেন-
"আমি ফিরিব না করি মিছা ভয়,
আমি করিব নীরবে তরণ-
সেই মহা বরষার রাঙাজল
ওগো মরণ হে মোর মরণ।"
মৃত্যুকে এত আপন করে কেউ কখনো দেখেছি কি? রবীন্দ্রনাথ তা পারেন। সেই কারণেই তিনি আমাদের পথ-প্রদর্শক। তাঁর গানে আমরা সেই কথারই পুনরাবৃত্তি শুনতে পাই-
"শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন মাঝে/
অশান্তি যে আঘাত করে তাইতো বীণা বাজে/"
অশান্তি আছে বলেই না আমরা সেই চিন্ময়- পুরুষের অস্তিত্ব অনুভব করছি-এই সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। বিশ্বাস রাখতেই হচ্ছে সেই চিরকল্যাণময়ের কাছে। তাই তিনি বলেন-
"এই যে দ্বন্দ্ব, মৃত্যু এবং জীবন, শক্তি এবং প্রেম, স্বার্থ এবং কল্যাণ- এই যে বিপরীতের বিরোধ মানুষের ধর্মবোধ যার সত্যকার সমাধান দেখতে পায়-- সে সমাধান পরম শান্তি, পরম মঙ্গল, পরম এক..."
সেই পরম এককের সাধনাই মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র সাধনা।
সেই কারণেই তিনি ঋকবেদের বাণী থেকে উদ্ধৃত করে বলেন-
" প্রাণের নেতা আমাকে আবার চক্ষু দিয়ো, আবার দিয়ো প্রাণ,.... আমাকে স্বস্তি দিয়ো।"
(আত্মপরিচয়)
এই স্বস্তি চাওয়ার মধ্যেই আছে সেই পরমকে পাওয়া। আর সেই পরমকে পেতে গেলে মানুষকে যা করতে হবে, তা তিনি তাঁর অন্তিমের কবিতায় বলেন-
"আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন/
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে/
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।"
-আসলে কি মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ হয়? বিশ্বচরাচর কেন সচল থাকে তখনও? তার জন্য কেন তবে কারুর মাথা ব্যথা থাকে না? তার উত্তর হল আছে। মৃত্যু বা দুঃখের তপস্যার মধ্য দিয়েই তাঁকে খুঁজতে হবে আমাদের। এই যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি তার মধ্যেও আমাদের আস্থা রাখতে হবে বারংবার সেই পরমের উপর। তিনি বলেন-"অহরহ জীবনকে মৃত্যু নবীন করিতেছে, ভালোকে মন্দ উজ্জ্বল করিতেছে, তুচ্ছকে অভাবনীয় মূল্যবান করিতেছে। যখন পরিচয় পাই, তখনই রূপের মধ্যে অপরূপ, বন্ধনের মধ্যে মুক্তির প্রকাশ আমাদের কাছে জাগিয়া উঠে।"(আত্মপরিচয়)
আমরা যদি তাঁর সেই উপলব্ধ-পথে নতুন পথ দেখতে পাই, তবেই এই রবীন্দ্রযাপন তাঁর মৃত্যুভাবনার মধ্য দিয়ে নতুন পথ পাবে এবং সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিরন্তন রূপে আরো বেশি করে গ্রহণ করতে শিখব।
0 Comments