২২ শে শ্রাবণ : অনেক মানুষের মৃত্যুদিন
প্র ল য় বি শ্বা স
বৈশাখের (১২৬৮,২৫শে বৈশাখ) খর রৌদ্রতাপ সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, আর শ্রাবণের(১৩৪৮,২২শে শ্রাবণ) ভেজা আবহে লক্ষ লক্ষ মানুষকে অশ্রুজলে সিক্ত করে বিদায় নিয়েছিলেন। মাঝখানের সুদীর্ঘ সময়টিতে বাঙালি তথা ভারতবাসীর বোধ বুদ্ধি চেতনায় তুমুল ঝড় তুলে তাদের আছড়ে ফেলেছিলেন এক অন্যরকম আলোকোজ্জ্বল আত্মপোলব্ধি এবং আত্মপরিচয়ের আঙিনায়। তাই ২২শে শ্রাবণ তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি শুধু এক মহান ভারতীয় কবি বা দার্শনিকের মৃত্যু দিন নয়, সেদিন আসলে নতুন উপলব্ধি এবং চেতনার রসে জারিত হওয়ার প্রাপ্তি থেকে আপামর ভারতবাসীর বঞ্চিত হওয়ার দিন।
বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ এর প্রভাব বিস্তর এবং অতি বিস্তর। তিনি বাঙালিকে নতুন আলোয় ভাবতে শিখিয়েছেন, জীবন যুদ্ধে পথ দেখিয়েছেন, বিপর্যয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন, প্রেম-বিরহের গভীরতা বুঝিয়েছেন, বিশ্বপ্রকৃতি ও ঈশ্বরকে এক সূত্রে বাঁধতে শিখিয়েছেন, বৃহত্তর জগতে বাঙালিকে পরিচিতি দিয়েছেন, এবং... এরকম আরো অনেক কিছু করেছেন। তাই ২২শে শ্রাবণের মধ্যে লুকিয়ে আছে বাঙালির এক লহমায় অজস্র ঐশ্বর্য হারিয়ে ফেলার এক নিবিড় স্তব্ধ যন্ত্রণা।
রবীন্দ্র-জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল তাঁর অতলান্ত অনুভব ক্ষমতা। জীবন সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ দুচোখ ভরে জীবনকে দেখে গিয়েছেন। অফুরান বিশ্ব, অফুরান ঈশ্বর, অফুরান প্রেম, অফুরান প্রকৃতি, অফুরান সময়... তাদের হাজারো বিচিত্র রূপ ! হাজারো বিচিত্র খেলা ! দেখেছেন, আর তাঁর মুগ্ধ অনুভবের নির্যাসটুকু উদারভাবে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন গল্প উপন্যাস গানে কবিতায়। আমরা আপ্লুত হয়েছি, আমরা ঋদ্ধ হয়েছি, প্রাণিত হয়েছি।তাঁর চোখ দিয়ে আমরা জীবনকে দেখতে শিখেছি।
আবার জীবনের ভিতর দিয়ে মৃত্যুকেও অন্তরঙ্গ রূপে চিনিয়েছেন তিনিই। তাঁর ব্যক্তি জীবনে মৃত্যু ছিল এক পরিচিত অতিথির মতো। ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর জানাশোনা। সারাজীবন ধরে তিনি একের পর এক মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেছেন, আর প্রতিটি মৃত্যুই তাঁকে ঠেলে দিয়েছে গভীর থেকে গভীরতর পর্যবেক্ষণে। তারই ফলস্বরূপ মৃত্যু তাঁর কাছে ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক জীবন-শিক্ষক।
" জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড্ড মনোহর।"
জীবন মৃত্যুর মধ্যে যে হাজারো খেলা এবং তার প্রত্যেকটিই যে সুশৃঙ্খল এবং সুন্দর এই চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ এবং অনুভবের জন্যই তিনি সকলের কাছে ঋষিতুল্য, এবং এ জন্যই তাঁর নিজস্ব বোধ প্রকাশে তিনি এতো সাবলীল। 'মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান'- এভাবেই তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, বন্দনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের আগে এবং পরে এই বাংলায়, এই দেশে, অনেক কবি জন্মেছেন, অনেক ঔপন্যাসিক জন্মেছেন, অনেক গল্পকার জন্মেছেন, অনেক সুরকার- গীতিকার জন্মেছেন, অনেক চিত্রকর জন্মেছেন, অনেক সমাজসংস্কারক জন্মেছেন, অনেক দার্শনিক জন্মেছেন, অনেক পথপ্রদর্শক জন্মেছেন, অনেক আধ্যাত্মিক মানুষ জন্মেছেন... কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই জন্মেছেন ভিন্ন ভিন্ন আধারে। আলাদা আলাদা মানুষের অবয়বে। একই সঙ্গে একটি প্রাণাধারের মধ্যে এতগুলো যশস্বী মানুষের অবস্থান, শুধু এদেশে কেন গোটা বিশ্বেই বিরল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই বিরলের মধ্যে বিরলতম যাঁর মধ্যে এতসব প্রতিভা একসঙ্গে সুতীব্র ভাবে একই সঙ্গে সহাবস্থান করত। সেজন্য ২২শে শ্রাবণ মানে একসঙ্গে এতগুলি মানুষের মৃত্যু দিন, এতগুলি প্রতিভার মৃত্যুদিন। আর এই 'একাধিক মৃত্যুর' পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অসংখ্য শিক্ষিত সংস্কৃতি বোধ সম্পন্ন উপরের স্তরের মানুষের বৌদ্ধিক আবেগ, এবং সঙ্গে সঙ্গে একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ করে ভারতীয় কাব্য সংস্কৃতির জগতে রবীন্দ্রনাথ এক অসাধারণ আলোর উৎস, যার জ্যোতি যত সময় অতিবাহিত হয়েছে, ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণের পর থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কত হাজার মানুষ পি এইচ ডি করে কর্মক্ষেত্রে বিদগ্ধের শিরোপা পেয়েছেন, কত হাজার শিল্পী তাঁর গান কবিতা নৃত্যকে অবলম্বন করে সামাজিক প্রতিপত্তি ও সম্মান লাভ করেছেন, কত হাজার ক্যাসেট কোম্পানি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন, কত শত প্রকাশনা সংস্থার মালিক রবীন্দ্র রচনার সম্ভার ছাপিয়ে অর্থের ইমারত গড়েছেন, কত হাজার মানুষ তাঁর তৈরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন, এবং পরোক্ষ ভাবে কত সহস্র মানুষ তাঁকে সম্বল করে বেঁচে আছেন- সেও এক বিশাল গবেষণার বিষয়। এবং তক্ষুনি বোঝা যায়, ২৫শে বৈশাখ এবং ২২শে শ্রাবণ এই দুটি দিনই বাঙালির কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, কেন এত জীবন্ত। আসলে বৌদ্ধিক, মনস্তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক দিকগুলির সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পেশাগত দক্ষতা ও উপার্জনেরও পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। আর এভাবেই, এই সুন্দর ভুবনে সমাজের সমস্ত স্তরের মানবের মাঝে বাঁচিবার যথাযথ ক্ষেত্র তিনি নিজেই তৈরি করে গিয়েছেন।
তাই, রবীন্দ্রনাথ এর মৃত্যু দিন, ২২শে শ্রাবণ, আসলে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে আপামর বাঙালির নিজস্ব বোধ ও চেতনাকে আরো বহু বছর বাঁচিয়ে রাখার সংকল্প গ্রহণের দিন।
0 Comments