আমার মুক্তি গানের আলোয়
শি শি র কু মা র বা গ
রবীন্দ্রসংগীত কেবল আমাদের কাছে নয়, মানবজাতির কাছে এক পরমাশ্চর্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বলেছেন, “তবে সবচেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালিরা, শোকে দুঃখে, সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এই গান তাদের গাইতে হবেই।”১
প্রথম যৌবন থেকেই সংগীত-স্রষ্টা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মহাবিপ্লবী, ব্যতিক্রমী। পরীক্ষা নিরীক্ষা ভাঙ-চুর চালিয়ে গেছেন সর্বদাই। সুর আহরণ করেছেন নানান সীমানা থেকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ কিংবা পাশ্চাত্যভূমি, কোনোটাকেই ব্রাত্য ভাবেননি তিনি। ওস্তাদদের কাছ থেকে একদিকে যেমন শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনই নিজের গানে বিভিন্ন রাগ রাগিনীর সুর মিশিয়ে দিয়েছেন অনায়াস ভঙ্গিমায়। জীবনের পথ-পরিক্রমায় যখন যে অঞ্চলে গিয়েছেন, সেখান থেকে সুর সংগ্রহ করেছেন। মগ্ন হয়ে শুনেছেন, বাউল গান, মাঝিমাল্লাদের গান, ডাক-হরকরাদের গান। নানান ধরনের সুর নিয়ে কখনও রচনা করেছেন প্রেমের গান, কখনও বা প্রতিবাদের। মানব মনের চাওয়া পাওয়া, ব্যথা বেদনা, আনন্দ উচ্ছ্বাস সবই দার্শনিক উপলব্ধিতে মূর্ত করে তুলেছেন নিজের গানে।
প্রায় বাইশশো গান তিনি রচনা করেছেন। গীতবিতানের পাতায় থরে থরে সাজানো রয়েছে সে মহাসম্ভার। এতো যে গান, এতো যে রাগ-রাগিনীর মিশ্রণ, এতো যে দেশি-বিদেশি-আঞ্চলিক সুর, এ সব কিছুকেই তিনি এমনভাবে আত্মস্থ করে নিয়ে তার সঙ্গে নিজস্বতা মিশিয়ে দিয়েছেন যে, মন দিয়ে শুনলে পরিষ্কার বোঝা যাবে, এটা রবীন্দ্রসংগীত, এমনই এই গানসমূহের বিশেষ সুরশৈলী তথা গায়কী।
ছেলেবেলায় যে রবীন্দ্রসংগীতগুলি আমরা সাধারণভাবে শুনে এসেছি, পরিণত বয়সে প্রায় প্রত্যেক অনুভবী বাঙালির মনের মধ্যে সেই গানগুলির অর্থ ধীরে ধীরে অনেক বেশি স্পষ্ট ও বোধগম্য হয়ে উঠতে থাকে। অনুভবের এই গতিময়তাই বুঝি রবীন্দ্রসংগীতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ছাত্রজীবনে দেখেছি, মঞ্চে কোনো এক বালিকা গান গাইছে, “ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা।” তখন সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলাম গানটির সুরে এবং দোলা দেওয়া ছন্দ স্পন্দনে। গানটির অন্তরা বা সঞ্চারীর অর্থ তখন স্বাভাবিক কারণে বোধগম্য ছিল না। কিন্তু পরে একসময় চিত্ররূপটি স্পষ্ট হতেই গানটির সর্বজনগ্রাহ্য একটি অর্থ চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে ভেসে ওঠে। মনে হয়, এই তো, একঝলক টাটকা প্রাণবায়ুর সন্ধান পেলাম। নদী তার নিজের ছন্দে পাগলের মতো মাতোয়ারা তথা বহমান হলেও নদীতীরের একটি ছোট্ট চাঁপা গাছ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে অপূর্ব এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। সে যেন বলছে, আমি সদাই অচল বা আপাত স্থির থাকলেও আমার চলমানতা অন্য জায়গায়। “আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা” এবং সর্বোপরি আলোর পানে আমার চলা। চাঁপা গাছ আরও বলছে, আমার এই অন্তস্থিত চলার আনন্দ অনুভব করতে পারে “আকাশ” এবং “নিশার নীরব তারা”দের দল।
বর্ষা দিনের একটি অনবদ্য গান, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।” বাদল প্রকৃতি কবিকে তার প্রথম কদম ফুলটি দান করেছে। আর বিনিময়ে কবি তাকে দান করেছেন “শ্রাবণের গান।” বাদল দিনে কবির মনের মধ্যে যে সুর গুনগুনিয়ে ওঠে সেই সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ফসলটি হল এই শ্রাবণসংগীত। গানটির সঞ্চারীতে বলা হল, বাদল দিন ফুরিয়ে গেলে ফুল আর থাকবে না। “আজ এনে দিলে, হয়তো দিবে না কাল, রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।” কবি বলছেন আমার এই গান কিন্তু চিরন্তন, চিরস্থায়ী। আমার এই গান তোমাকে ভুলবে না। প্রতি শ্রাবণে ফিরে ফিরে এই গান স্রোতের প্লাবনে সম্মানিত করবে প্রকৃতিকেই।
ভাবলে আবাক হতে হয়। মনে করুন আপনি ট্রনে চলেছেন। অন্ধ গায়ক গাইছেন, “চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।” রবীন্দ্রসংগীতের এই বাণী তার অন্তরলোককে আলোকিত করেছে। হয়তো আম-জনতা, রিক্সাওয়ালা কিংবা সাধারণ কোনো দোকানদার বসন্ত দিনে হঠাৎ গুনগুনিয়ে উঠছে “একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি।” অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষও তার মতো করে গাইতে থাকে, “আঘাত, সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার।”
জানি না পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় আর কোনো কবির কবিতা এমনভাবে গান হয়েছে কি না, কিংবা আর কোনো গীতিকারের গানে এমন সুন্দর কবিতা আছে কি না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন, “পৃথিবীর সর্বকালের সর্বদেশের সমস্ত মহান কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রধান তফাত এই যে, আর কেউ তাঁর মতোন কাব্যবাণীর অঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারেননি সুর, সৃষ্টি করতে পারেননি এতগুলো সার্থক সংগীত। এই দিক থেকে তিনি বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য। ভারতেও অন্য ভাষায় রবীন্দ্রসংগীতের তুল্য কাব্যগীতি নেই।”২
পরিশেষে বলি, আমাদের পরম সৌভাগ্য এই যে, এই পোড়া বাংলায় তাঁর মতো একজন বড়ো মাপের মানুষ জন্মেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাতেই আমরা তাঁর অমূল্য সৃষ্টি সম্ভারের প্রত্যক্ষ স্বাদ গ্রহণ করতে পারছি। পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার সুমহান কবিকে বুঝতে হলে আমাদের সেই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে, নতুবা অনুবাদকের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। আর আমাদের চরম দুর্ভাগ্য এটাই যে, তথাকথিত ষিক্ষিত বাঙালি আজও তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকছেন। তারা বুঝতেই পারছেন না অথবা বুঝতেই চাচ্ছেন না যে, নিজেদের অজান্তেই তারা তাদের সন্তানদের এক মহা সম্পদের রসাস্বাদন থেকে চিরতরে বঞ্চিত করছেন।
তথ্যসূত্র-
১. রানী চন্দ, আলাপচারি.রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৪১৭ , পৃ.৭৮
২. সুনীল গঙ্গোপোধ্যায়, মাসিক বসুমতী, মে ২০১২, পৃ.১১
0 Comments