বাইশে শ্রাবণ : মৃত্যুহীনতার প্রতীক
তু ল সী দা স মা ই তি
অনন্ত বোধের ছায়া ফেলে তুমি ভিজছো।
শুধু ছায়াটি নয়, ছাতিমের ছাতাটিও গেছো ফেলে।
বাইশে শ্রাবণের মনোভূমি ছুঁয়ে কবি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু বাঙালির 'প্রাণের পরে' কারো চলে যাওয়া। শুধু বাঙালি নয়, সমগ্র বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এ এক বিষাদ মুহূর্ত। এই মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কষ্ট দেয়, একটা শোকের আবহও তৈরি করে। কিন্তু কবির মৃত্যুদর্শনে এর মূল্য ভিন্ন। তাঁর কাছে মৃত্যু তো একটা স্বাভাবিক ছন্দ। জীবনেরই এক অপরিহার্য পর্যায়। আর তাঁর আদর্শ যতই আমাদের বোধের সাথে মূর্ত হয় ততই দেখি এই মৃত্যু নিয়ে দুঃখ অনুভব আসলে সংকীর্ণতারই রূপ। তাই বাইশে শ্রাবণকে আমরা নিছক মৃত্যুদিন হিসেবে পরিচয় দিতে নারাজ।
সভ্যতার ইতিহাসে হৃদয়বৃত্তির গুরুত্ব, প্রেমের মূল্য, সত্যের প্রয়োজনকে বৈজ্ঞানিক ও নাগরিক অবয়বে যিনি পূর্ণভাবে যোজিত করেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। মানুষের জীবনের সমস্ত উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতার নির্যাস ও তা থেকে প্রাপ্ত একটা গভীর সত্য দিয়েই তিনি সাজিয়েছেন তাঁর সৃষ্টির ভুবন। এই সম্ভারে যে ভাবনাগুলিকে তিনি যোগ করেছেন তার ভেতরে আছে এক মহৎ 'নীতিবোধ'। এই 'নৈতিকতা ক্ষুদ্র জৈব জীবনের নীতি নয়। সে এক বৃহৎ পারমার্থিক নীতিবোধ। সে এক উচ্চতর কল্যাণ এবং বৃহত্তর মানবতার নীতি।' প্রকৃতপক্ষে সারাজীবন ধরেই এই পবিত্র মানবিক আবহকে ছড়িয়ে গেছেন অজস্র কবিতা, গল্প, নাটক, সংগীত,ও চিত্রকলায়। তার সৃষ্টি কি নিছকই শব্দবিস্তার বা পঙক্তি বিন্যাস? একদমই তা নয়, তাঁর সব লেখা ও সৃষ্টির মধ্যেই তিনি এঁকে গেছেন একটা ভিতরজ্যামিতি। যার প্রতিটি রেখায় প্রতিটি কোণে পরিশীলিত ধর্ম, আচার, বোধ, মঙ্গলানুভূতির প্রকাশ। আর আছে এক অনাবিল আনন্দবোধ। শুদ্ধ প্রেম ও প্রতিবাদও যুক্ত হয়েছে তাতে। 'অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো।'
আমরা কবির সমস্তটা চিনে উঠতে পারিনি বলেই তাঁকে অনেক সময় দূরের লক্ষত্র করে ঠেলে দিয়েছি। তিনি যে জীবনে পাওয়া দুঃখ ও বিপদ কে দর্শনবিদ্যার অভিমুখে দেখেননি, দুঃখকে বরণ করেই তা থেকে উত্তরণ করতে চেয়েছেন, অনেক সময় তা ভুলে আমরা অহেতুক কোলাহলে ডুবেছি। দুঃখকে সাধনা রূপে গ্রহণ করে তিনি আমাদের সামনে দুঃখ শোককে অতিক্রম করার চাবি তুলে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গেই এসেছে তাঁর প্রেমচেতনা। স্বার্থহীন দ্বন্দ্বহীন এই প্রেম প্রকৃত অর্থে মানবপ্রেম। আমাদের এক অনাবিল আনন্দকল্যাণের পথে নিয়ে যাওয়া। তিনি নানা প্রেক্ষিতে তাই বলেছেন-
"ভয়কে যদি কেউ সম্পূর্ণ অতিক্রম করতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে পারে, তবে তাহা প্রেম।"
তাই বলা যায়,রবীন্দ্রনাথ একটি প্রতীক। যেখানে বেদনা শোক সংকটের ভেতর একটি শুদ্ধ আনন্দবোধের প্রতিষ্ঠা। নিকষকালো অন্ধকারে এই প্রতীক এমনই একটি নক্ষত্র যেথায় সব আলো নিভে গেলেও সে জ্বলতে থাকে। বৃহতের প্রচ্ছায়ায় আমাদের অস্তিত্বকে নিয়ে যে অহংবোধ তাকে মাটিতে নামিয়ে আনে কবির এই অনুভূতিমালা। দুঃখ বিলাস নয়, রোমান্টিকতাকে নিয়ে আদিখ্যেতার রূপকথা নয়, অরূপের ভেতর রূপ ও মহাকালের গভীরে কালের বাস্তবতা নিয়ে কবিকে পাওয়া। বর্তমানে কবির জন্মদিন ও মৃত্যুদিন ঘিরে আমরা যে সংকীর্ণতার চর্চা করে চলেছি, তা থেকে বেরোনোই আমাদের আজ জরুরি কর্তব্য।
বিশ্বজুড়ে আজ যে দুঃসময় চলছে তাকে অতিক্রম করার জন্য রবীন্দ্রনাথ অন্যতম ক্ষেত্র। এই রণভূমিতে দাঁড়িয়ে সময়ের অভিঘাতকে বরণ করেই এগিয়ে চলা। হলাহলের স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে তাঁকেই পেতে চাই। তাঁর সত্য দর্শন, প্রেমের মূল্য ও প্রতিবাদের ভাষা নিয়েই এই ক্ষয়জর্জর ক্লান্তি দূর হোক।
সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের দেশও আজ বিপন্ন। ভয়মুক্ত হতে তাঁর কথাতেই বলি-
"এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়
দূর করে দাও তুমি সর্বতুচ্ছ ভয়
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।"
0 Comments