জ্বলদর্চি

স্বাধীনতা দিবসের দিনলিপি

স্বাদহীনতার দিবসের দিনলিপি

ভা স্ক র ব্র ত  প তি

সাত সকালের মহানিদ্রা ভাঙিল উচ্চৈঃস্বরে অমায়িক ধ্বনি এবং ডি জে বক্সের গুরুগম্ভীর মন্দ্রধ্বনি শ্রবণের মাধ্যমে। "শুনো গোর সে দুনিয়াবালো, চাহে জিতনা জোর লাগালো, সবসে আগে মেরা হিন্দুস্তান"! অগত্যা তড়াং করিয়া শয্যাস্তান ত্যাগ করিলাম হিন্দুস্তানের মঙ্গল কামনায়। অদ্য তো "স্বাদহীনতা দিবস"! বিদ্যালয়ে যাইতে হবে। অগত্যা কাকভোরে প্রাতঃক্রিয়াদি অর্ধসম্পন্ন করিয়া এই লক ডাউনের বাজারে প্রত্যুষের সুখনিদ্রা ত্যাগ করিয়া যন্ত্রচালিত দ্বিচক্রযান সহযোগে গমন করিলাম আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালনে। 

অদ্য কোনোরূপ খাদ্যদ্রব্যাদি গৃহে গ্রহণ করি নাই। আসলে, অদ্যকার দিনে নানাবিধ বিতরিত খাদ্যসামগ্রী পথিপ্রান্তে পাইবার পূর্বেকার অভিজ্ঞতা এবং গোপন লালসাপূর্ণ ঈপ্সা আমার অন্তরে উদ্রেক করিয়াছিল। আর আমি বিনামূল্যে আলকাতরা পাইলেও সেবন করিতে পছন্দ করি। সেখানে স্বাদহীনতার দিনে কদলী, অণ্ড সহযোগে সরস মিষ্টান্ন,  নিদেনপক্ষে শুষ্ক কাঠিগজা পাইবার তুমুল সম্ভাবনাকে ভরসা করিয়া 'জয় বিষ্ণুমাতা' জপিতে জপিতে গৃহ হইতে বাহির হইলাম দেশপ্রেমে নিমজ্জিত হইয়া।

যন্ত্রচালিত দ্বিচক্রযান চালনা হেতু মম্তকে কঠিন আচ্ছাদনের সাথে সাথে মুখগহ্বর সহ নাসিকাচ্ছাদন পরিহিত করিয়া চন্দ্রাভিযানের নিমিত্ত এডুইন অলড্রিন সুলভ দর্শনধারী হইয়া চলিলাম। ইত্যবসরে পৃথ্বিসমূহে 'কোরোনা' নামক ভাইরাসের জীবনভেদী আক্রমণের গভীর আশংকাহেতু। 

পথিমধ্যে দেখিলাম, দেশপ্রেমিকদের তুমুল বর্ষণ এবং তৎসহ 'আমফান' ঝটিকার ন্যায় তাঁহাদের আস্ফালন। ইঁহাদের দেখিয়া আমার চরম বিশ্বাস জাগিয়াছিল এবং মননের মধ্যে আসিতেছিল যে, ইঁহারা যদি ক্ষুদিরাম যুগে জন্মাইতেন, তাহা হইলে ব্রিটিশদিগরা টের পাইতেন বাংলার দোর্দণ্ডপ্রতাপ যুবাসকলের রূপ এবং কর্মপরাক্রমতা এবং কর্মদক্ষতা সম্পর্কে। ব্রিটিশদিগের অস্থিসকল দিয়া ইঁহারা ডাঙ্গুলি খেলা খেলিয়া ওলিম্পিক স্বর্ণপদক অর্জন করিয়া দেশ ও দশের সম্মান বৃদ্ধি করিতেনই। 

যাইহোক, পথিমধ্যে দেখিলাম মোড়ে মোড়ে দেশহিতৈষী দেশপ্রেমিক জনগণের তুমুল আবেগ এবং আলোড়ন। কি নিদারুন আগ্রহ। বর্ষণঘন প্রত্যুষে মুখগহ্বরে দন্তমঞ্জন কাঠি ঢুকাইয়া লুঙ্গি গুটাইয়া শ্যাওলা পড়া ইষ্টকসকল আনিবার কি তৎপরতা! ইষ্টক সাজাইয়া তাহাতে সংবাদপত্র লাগাইয়া নির্মাণ হইতেছে 'বেদী'। আসলে স্বাদহীনতার সংগ্রামে মৃত্যুবরণ করা মানুষজনের বেদনায় এবং সাম্প্রতিককালে পাক ও চৈনিক সৈনিকদের অমানুষিক ক্রিয়াকলাপে দেশভক্তি তৎপরতার সহিত বৃদ্ধি পাইয়াছে বলিয়া মননে আসিলো।

এবার চাই বংশদণ্ড! না, আপনি যা ভাবিতেছেন তাহা নহে। পতাকা উত্তোলনের নিমিত্ত দীর্ঘকায় দণ্ড। কেহ পাইল, কেহ পাইল না। যাঁহারা পাইল না তাঁহারা খাটে মশারী টাঙানোর দণ্ড আনিয়া কাজ সারিল। এদিকে কোথাও কোথাও উচ্চৈঃস্বরে বাজিতেছে রক্তকনিকা গরম করা সঙ্গীত 'মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে, উগলে হিরা মোতি'। কোথাও বা 'বর্ডার' চলচ্চিত্রের সঙ্গীত।

বেদী ঘিরিয়া জনসমাগম বাড়িতেছে। কাচ্চা বাচ্চা থেকে ঘুঙটপরা বধূগন হাজির। চায়ের দোকানে আড্ডামারা বিজ্ঞানীরাও উপস্থিত। পাড়াতুতো 'দাদা' ও 'ভাই' গণ ইসতিরি করা পাঞ্জাবী পরিহিত হইয়া দৃষ্টিশক্তিবর্ধক কাঁচের আবরণটিকে মস্তকে ধারণ করিয়া অপেক্ষমান। 'উনি' আসিতেছেন খুব শিঘ্রই। 

'উনি' এখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। চতুর্থ শ্রেণী পাঠগ্রহণের পর উনি ওনার শিক্ষাগ্রহণ সমাপ্ত করিয়াই দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখিয়াছেন নানাভাবে। তৃতীয় সংখ্যার নামতা মেধাতে না রাখিবার জন্য অমূল্য মাস্টারের হাতে 'প্রহারেণ ধনঞ্জয়' উপভোগ করিয়াই বিপ্লবের পথ বাছিয়া নিয়াছিলেন সেই কবেই। 

নানা রঙে নানা সময়ে নিজেকে রঞ্জিত করিয়া তিনি অদ্যপি জনসেবায় এবং জনহিতকর কাজে ব্যস্ত রহিয়াছেন। একসময় মৃত্তিকার সূতিকাগৃহস্বরূপ গৃহে বসবাস করিতেন। তাম্বাকু সেবনের জন্য অন্যের নিকটে ভাগ চাহিতেন। অদ্য তাঁহার সুদৃশ্য অট্টালিকা, চারচক্রযান, অর্থের প্রাচুর্য চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন করিতেছে। 'জনসেবা'য় সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। এই মুহূর্তে তিনিই প্রধান অতিথি। আয়োজকগণ বহুদিন হইতে ওনার সম্মতি আদায় করিয়া রাখিয়াছিলেন অদ্যকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকিবার জন্য।

অবশেষে 'উনি' আসিলেন। সুদৃশ্য এবং দামী পাদুকাদ্বয় পরিহিত চরণ যুগল আবীর রঞ্জিত "স্বাদহীনতা দিবস' লেখাটির উপরিপৃষ্ঠে রাখিয়া তরতর করিয়া পতাকা উত্তোলন করিয়া সম্মান প্রদর্শন করিলেন। এখনো সাত জায়গায় যাইতে হইবে ওনাকে। তাই সংক্ষেপে কিছু ভাষণোত্তর পর্বে জানাইলেন 'আমরা আজ কঠিন পরিস্থিতিতে বিরাজমান। সর্বত্র চৌর্যবৃত্তির রমরমা। এমতবস্থায় আমাদের মস্তক সরল রাখিয়া এগিয়ে যাওয়াই অন্যতম কার্য। ইহাই দেশবাসীর অন্তঃকরণে স্থান দিতে হইবে'। উনি প্রস্থান করিলেন করতালির উচ্চনিনাদ সহকারে। উপস্থিত জনগণকে বিলি করা হইলো যৎসামান্য খাদ্যসামগ্রী। কর্ণকূহরে তখন বাজিতেছে 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা'!!

অগত্যা আমি চলিলাম বিদ্যালয় অভিমুখে। যথারীতি দেশমাতৃকার চরণতলে আত্মিক দায়িত্ব সম্পন্ন করিয়া ফিরিয়া আসিলাম নিজ গৃহাভিমুখে। ফিরিয়া আসিবার সময় দেখিলাম ভিন্নতর চিত্রাবলী। পথিমধ্যে পতাকাগুচ্ছ অবনত মস্তকে মৃয়মান। মৃত্তিকায় লুটাইতেছে কিয়দংশ। 'অমায়িক' স্বরে সঙ্গীতের সুরে তখন সুরঝঙ্কার 'দিলবর দিলবর , হাঁ দিলবর'। আর একদল উন্মত্ত যুবক মাইকেল জ্যাকসনের ন্যায় সেই সঙ্গীতের তালে তাল মিলাইয়া নৃত্যরত দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হইয়া। কেহ কেহ মস্তকের ভার সামলাইতে না পারিয়া কর্দমাক্ত পতাকাতলে শয্যাশায়ী!

আসলে এই 'স্বাদহীনতার দিবসে' অত্যল্প ভিন্ন স্বাদ গ্রহণের ঈপ্সা কাহার নাহি হয়? অদ্যকাল হইতে ৭৩ বৎসর পূর্বে যাঁহারা মৃত্যবরণ করিয়াছিলেন কিংবা গরাদখানায় আশ্রয় নিয়াছিলেন, তাঁহাদের সেই অমানুষিক নির্যাতন এবং কষ্ট স্মরণে আসিতেছে আজিকার দিবসে। সেই যন্ত্রণা লাঘবের নিমিত্তই এইভাবে এই যুবসমাজ এই পন্থা অবলম্বন করিয়াছে। ইহাতে অন্যায়ের কারণ নাই। এই বাক্য যেন কেহ আমাকে চুপিচুপি কর্ণকূহরে জানাইয়া দিলো। আমি অগত্যা আমার যন্ত্রচালিত দ্বিচক্রযান চালনা করিয়া গৃহাভিমুখে রওনা দিলাম। মনে মনে প্রনাম জানাইলাম আমাদের উষ্ণশোনিতধারী ভবিষ্যত প্রজন্মকে।

দেখিলাম অদ্যকার এই 'বিপ্লবী'রা নয়নজলে ভাসিয়া আকুল হইয়া বুক চাপড়াইতেছে ডি জে বক্সের সুরঝংকারে -- "আঁখ মারে, ও লেড়কি আঁখ মারে"!

( কল্পিত )

Post a Comment

2 Comments

  1. দুর্দান্ত লেখা।অনেক অনেক ধন্যবাদ লেখককে।

    ReplyDelete
  2. এক কথায় দুর্দান্ত লেখা।লেখককে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete