জ্বলদর্চি

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর / মধুমিতা মহাপাত্র


চিত্রকলা ও সাহিত্যের সুচারু সমন্বায়ক অবনীন্দ্রনাথ

ম ধু মি তা  ম হা পা ত্র 

মানব সভ্যতার ধারার উন্মেষলগ্নে মানুষের অনুভূতিকে ব্যক্তিক থেকে সার্বজনীন করার প্রগাঢ় ইচ্ছা থেকেই চিত্রের জন্ম। আর তার হাত ধরেই এসেছে লিপি। এই লিপিই  উন্নতির শীর্ষে এসে সাহিত্যকে  চিরন্তনত্ব দান করেছে। মানব মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম দুই সমৃদ্ধ ধারা চিত্রকলা ও সাহিত্যের সূচনালগ্নের সেই অঙ্গীভূত সম্পর্ক আজও অটুট।--এই দ্বিবিধ কর্মদক্ষতা যার সত্তায় সমভাবে বিরাজিত তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি একাধারে সাহিত্যিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রথম ভারতীয় চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথ যেমন অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে সাহিত্য থেকে চিত্রে পৌঁছেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথও অনেকটা তেমনিভাবে চিত্র থেকে সাহিত্যে পৌঁছান। সৃষ্টিশীলতার সেতু বেয়ে সাহিত্য থেকে চিত্রকলা, চিত্র থেকে সাহিত্যে অবাধে বিচরণ করতে পারেন।
মহান এই চিত্রশিল্পী ১৮৭১ সালের ৭ ই আগস্ট জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চিত্রাঙ্কন প্রবণতা তাঁর সহজাত গুণ। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অসিত কুমার হালদার এর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে--"শুনিয়াছি প্রসিদ্ধ চিত্রকর রাজা রবি বর্মা কোন সময়ে তাঁহাদের জোড়াসাঁকো ভবনে তাঁহার স্বর্গীয় পিতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আসেন, সেই সময়ে বালক অবনীন্দ্রনাথের পৌরাণিক গল্প অবলম্বনে রচিত রেখাঙ্কন দেখিয়া বলিয়াছিলেন বালকের সাহস তো কম নয় এখন হইতেই এরূপ গুরুতর বিষয়  আঁকিবার চেষ্টা।"
সাহিত্যপ্রীতিই তাঁকে  চিত্রকলা চর্চায় উৎসাহিত করে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় সৃষ্টি বৈষ্ণব পদাবলীকে অবলম্বন করে তাঁর চিত্রকলা চর্চার সূত্রপাত। অভিসারিকা, কৃষ্ণলীলা সিরিজ দিয়ে তাঁর চিত্রকলার জয়যাত্রা। বিখ্যাত ছবি কচ ও দেবযানী, ভারতমাতা, গণেশ জননী, বুদ্ধ এবং সুজাতা। চিত্রাঙ্কন এর ক্ষেত্রে দৃশ্যমান জগত থেকে সরে এসে অনুভূতির জগতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি ।
মোঘল- রাজপুত মিনিয়েচার চিত্র কলা অনুশীলনের সূত্র ধরেই তাঁর সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ। তিনি অনুভব করেছিলেন সাহিত্যে হিন্দু- মুসলমানের মিলন তেমন ঘটেনি যেমন ঘটেছিল চিত্রকলা ও স্থাপত্যে। এই উৎসাহ থেকে রচনা করেন 'রাজকাহিনী'। বুদ্ধের কাহিনী অবলম্বনে লেখা নালকও -এ জাতীয় রচনা। তাঁর লেখনীর স্পর্শে পুরানো রূপকথা নবরঙ, রস নিয়ে সাহিত্যের দরবারে হাজির হয়। শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, পথে বিপথে, ভূত-পতরির দেশ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। এছাড়া শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থ --শিল্পের ষড়ঙ্গ, ভারত শিল্প ও শিল্পায়ন, লোকসংস্কৃতি সম্পর্কিত গ্রন্থ ছেলেভুলানো ছড়া, বাংলার ব্রত, স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ঘরোয়া, জোড়াসাঁকোর ধারে, আপন কথা- যা আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।


অবনীন্দ্রনাথের দুটি খণ্ডে সংকলিত 'রাজকাহিনী' রূপকথা ও কথকতার সংমিশ্রণে এক অপূর্ব সৃষ্টি। পরবর্তী গ্রন্থ 'ভূত-পতরী'র দেশ এ রাজপুত কাহিনী থেকে বেরিয়ে প্রবেশ করলেন বাস্তব-অবাস্তব ইতিহাস ও বর্তমানের বিচিত্রবর্ণ মায়ামণ্ডপে। এরপর ইতিহাস ও কল্পনা থেকে লেখকের লেখনি বাঁক নিল ভূগোলের অভিমুখে। লিখলেন' বুড়ো আংলা'। হাঁস-সারসের মানুষ সহযাত্রী বুড়ো আঙ্গুলের আকার প্রাপ্ত বালকের কাহিনী। সেই সঙ্গে বাংলাদেশসহ উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের বিবরণ। যা চিত্রকরের লেখনীর গুণে পেয়েছে সজীবতার স্পর্শ। শুধু কল্পজগত নয় বাস্তবের বিবর্ণ জগতও তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্পর্শে বর্ণময় হয়ে উঠেছে।
অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধ গুলির মধ্যে 'শিল্পায়ন' অন্যতম যা ১৩২৮ ফাগুন থেকে ১৩৩৩ আশ্বিন পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত তাঁর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী বঙ্গবাণী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে তিনি তীক্ষ্ণ ধীশক্তি দিয়ে চিত্র ও সাহিত্যের ওতপ্রোত সম্পর্ককে ব্যক্ত করেছেন।

সবশেষে বলা যায় অবনীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে চিত্রকলা ও সাহিত্য অখণ্ড রূপ লাভ করেছে। ডক্টর সুকুমার সেনের কথায়- 'অবনীন্দ্রনাথের লেখাকে সত্যসত্যই বলিতে পারি  তুলির লিখন'।
আজ জন্মতিথিতে এই মহানশিল্পীকে জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। 


Post a Comment

0 Comments