জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ - ৬

দিল্লি দর্পণ || ৬ষ্ঠ পর্ব

কালীপদ চক্রবর্ত্তী 

অতীতের কিছু কৃতি বাঙালি 

লেখার শুরুতেই জানিয়ে রাখি, দিল্লিতে কৃতি বাঙালির সংখ্যা অনেক। সকলের কথা লিখতে গেলে একটি মোটা বই হয়ে যাবে। তাই সবার নাম এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ না করার জন্য দুঃখিত এবং ক্ষমা-প্রার্থী। মাত্র কয়েকজনের নামই উল্লেখ করলাম। কারণ সকলেই সম্মানীয় এবং নমস্য ব্যক্তি। তাঁরা দিল্লির উন্নতি এবং বিশেষ করে বাঙালিদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিকল্পে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন অনেকেই।তাদের সবাইকে প্রণাম জানাই।অতীতে যারা নাটক, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দিল্লিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের কিছু ব্যক্তিত্বের নামও পরবর্তী সংশ্লিষ্ট পর্ব-তে উল্লেখ করবো। আজও  বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব বাঙালি লোকচক্ষুর আড়ালে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির জন্য কাজ করে চলেছেন। তাঁদের কয়েকজনের কথা পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।

পুরানো দিল্লির বাঙালিরা বেশিরভাগই ছিলেন শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আইনজ্ঞ বা ব্যবসায়ী। এঁরা শুরুর দিকে পুরানো দিল্লিতে বাড়ি ভাড়া করেই থাকতেন। বাংলার সাথে শিকরের সম্বন্ধটাকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইতেন না। ভাবতেন কাজের শেষে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন। এরকমই তারা ভাবতেন সে সময়ে। সে সময়ে অনেক বাঙালিই করোলবাগবাসী হয়েছিলেন। সেজন্য এক সময় এই এলাকার নামকরণ হয়েছিল ‘বাঙাল নগর’।  
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময়ে, বিশেষ করে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বেশ কিছু বাঙালি আধিকারিক তাঁদের যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ বিশাল ভারত সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসন ব্যবস্থায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, স্যার ভূপেন্দ্রনাথ মিত্র, স্যার ব্রজেন্দ্রলাল মিত্র, স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকার, স্যার ধীরেন্দ্রনাথ মিত্র, স্যার মম্মথনাথ মুখার্জী এবং স্যার নলিনীরঞ্জন সরকার ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।নলিনীরঞ্জন সরকার ১৯৪১ সালে বড়লাটের শাসন পরিষদে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ভূমি দপ্তরের সদস্য হয়েছিলেন।শুধু তাই নয় ১৯৪৩ সালে তিনি বাণিজ্য এবং খাদ্যমন্ত্রী এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তিকালীন বঙ্গ বিভাজনের জন্য তৈরি ‘পার্টিশন কমিটি’-র সদস্য এবং স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনাকালে আর্থিক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতিও নির্বাচিত হন।
ব্রিটিশ ভারতে ফাইন্যান্স সেক্রেটারি ছিলেন পি সি ভট্টাচার্য এবং পরে তিনি স্বাধীন ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার গভর্নর পদেও ছিলেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়েছিলেন জে এন চৌধুরী। জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী দ্বিতীয় বাঙালি যিনি ভারতের সেনাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি ভারতীয় বায়ু-সেনাধ্যক্ষ সুব্রত মুখার্জী ছিলেন। দিল্লিতে ওনাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি জায়গার নামকরণ করা হয়েছে ‘সুব্রত পার্ক’।নৌ সেনাধ্যক্ষ হয়েছিলেন এডমিরাল এ কে চ্যাটার্জী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ছিলেন লে: জেনারেল শান্তনু চৌধুরী। পরে অবশ্য লে: জেনারেল শান্তনু চৌধুরী আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল সার্ভিসেস-এর সুযোগ্য ডাইরেক্টর জেনারেল। 
ডাঃ এস এন সেন, নির্মল সিদ্ধান্ত এবং ডা. বি এন গাঙ্গুলি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। প্রফেসর নিশিকান্ত সেন হয়েছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার।একসময় প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার প্রধান পদে ছিলেন স্যার ঊষানাথ সেন।চিফ ইলেকশন কমিশনার হয়েছিলেন সুকুমার সেন, মৃগাঙ্কমোহন বোস এবং এস পি সেন ভার্মা। বি সি গাঙ্গুলি হয়েছিলেন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান। ট্রেড ফেয়ার অথরিটির চেয়ারম্যান ছিলেন অনিমেষ ব্যানার্জী। দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির ভাইস চেয়ারম্যান এস জি বসুমল্লিক । আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডাইরেক্টর জেনারেল হয়েছিলেন অমলানন্দ ঘোষ।  
দিল্লির বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজগুলোতে বহু বাঙালি শিক্ষকতা করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছেন। তাদের নাম লিখে শেষ করা যাবেনা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক বাঙালি শিক্ষক, শিক্ষিকা সুনাম অর্জন করেছেন। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডা. বি. ডি.চৌধুরী এখানকার ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। অশোক মিত্র ছিলেন সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ-এর সুযোগ্য প্রধান। প্রফেসর পদ্মশ্রী আশিস দত্ত ছিলেন মলিকিউলার বায়োলজির অধ্যাপক। ইনি এখানে ভাইস চ্যান্সেলর-এর এবং ২০০৪ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট-এর পদেও ছিলেন।এছাড়াও আমার বন্ধু-সম প্রফেসর অপরাজিত চট্টোপাধ্যায়ের ঝুলিতে আছে কিউবা সরকারের দেওয়া ‘জোস মার্লিন’ পুরস্কার, পানামার ‘রোখেলিল্স সিলান’ পুরস্কার এবং চিলির রাষ্ট্রপতির দেওয়া ‘পাবলো নেরুদা’ পুরস্কার। অবসরপ্রাপ্ত অপরাজিত-বাবু এতদিন জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ ভাষা এবং ল্যাটিন আমেরিকান সায়েন্স পড়াতেন।

তথ্যসূত্র – দিল্লির চাঁদনিচকে কিছুকাল – পূষন কুমার দত্ত
        লালকেল্লা – প্রমথনাথ বিশী
        দিল্লির বাঙালি – চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী 
        মুছে যাওয়া দিনগুলি – প্রবীর কুমার ঘোষ 
        দিল্লি স্টুডেন্ট গাইড – স্টুডেন্ট এইড পাবলিকেশন্স, দিল্লি
        দিগঙ্গণ ম্যাগাজিন 
        উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস ম্যাগাজিন 
        দিল্লির বিভিন্ন স্থানীয় পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন

Post a Comment

3 Comments

  1. অনেক নতুন তথ্য পেলাম। তবে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ত্রিবান্দ্রমে অবস্থিত, জ.নে.বি.তে এফিলিয়েটেড।

    ReplyDelete
  2. আহা, কি পড়লাম। যদিও সবগুলোই জানা, তবু একযাগায় এতজন উল্লেখযোগ্য বাঙালির নাম পেয়ে বাঙালি হিসেবে আমার গর্ব হচ্ছে। যে কোন বাঙালির বুক চওড়া করবে।

    ReplyDelete
  3. গর্ব বোধ করি এমন সব বিষয় একসাথে পড়তে পেরে যেখানে শুধু বাঙালী নিয়েই আলোচনা। বাঃ , বেশ ভালো লাগল ।

    ReplyDelete