শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত || পর্ব -৩
সু দ র্শ ন ন ন্দী
এবার আসব পরের বছর ১৮৮২তে। ১৮৮২, ১লা জানুয়ারি।শ্রীরামকৃষ্ণ সিমুলিয়া ব্রাহ্মসমাজের সাংবাৎসরিক মহোৎসবে ভক্তসঙ্গে এসেছেন। জ্ঞান চৌধুরীর বাড়িতে মহোৎসব। শ্রীযুক্ত কেশব সেন, রাম, মনোমোহন, বলরাম, ব্রাহ্মভক্ত রাজমোহন, জ্ঞান চৌধুরী, কেদার, ব্রাহ্মভক্ত কান্তিবাবু, কালিদাস সরকার, কালিদাস মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র, রাখাল প্রভৃতি অনেক ভক্ত উপস্থিত।
ব্রাহ্মসমাজের পদ্ধতি অনুসারে উপাসনা হল।
ব্রাহ্মভক্তগণ গান গাইতে শুরু করলেন।
মন একবার হরি বল হরি বল হরি বল।
হরি হরি হরি বলে ভবসিন্ধু পারে চল ৷৷
জলে হরি স্থলে হরি, অনলে অনিলে হরি।
চন্দ্রে হরি, সূর্যে হরি, হরিময় এই ভূমণ্ডল।।
ঠাকুর গানের সঙ্গে নৃত্য করছেন। ভক্তরাও নাচছেন।
এদিন জ্ঞানবাবুর দোতলার ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ, কেশব প্রভৃতিকে জল খাওয়াবার আয়োজন হয়েছে।তাঁরা জলযোগ করে আবার নিচে নেমে বসলেন। ঠাকুর কথা বলতে বলতে আবার গান গাইছেন। কেশবও সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছেন —
মজলো আমার মন ভ্রমরা শ্যামাপদ নীল কমলে।
যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল কামাদি কুসুম সকলে ৷
সকলে মিলে গান ও নাচ, রাত পর্যন্ত চলল।
এর পরের গান থেকে কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত উপস্থিত। মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের দ্বিতীয় দর্শন এটি। সময় ২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ঠা মার্চের মধ্যে। তিনি পণ্ডিত ও জ্ঞানী মানুষ। ঠাকুরের সাথে ঈশ্বর নিয়ে কথা চলছে। তিনি কথায় কথায় ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ঈশ্বরকে কি দর্শন করা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ-হাঁ, অবশ্য করা যায়। মাঝে মাঝে নির্জনে বাস; তাঁর নামগুণগান, বস্তুবিচার -- এই সব উপায় অবলম্বন করতে হয়।
মাস্টার- কী অবস্থাতে তাঁকে দর্শন হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ- খুব ব্যাকুল হয়ে কাঁদলে তাঁকে দেখা যায়। মাগছেলের জন্য লোকে একঘটি কাঁদে, টাকার জন্য লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদছে? ডাকার মতো ডাকতে হয়।
এই বলে ঠাকুর গান ধরলেন:
“ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে।
কেমন শ্যামা থাকতে পারে, কেমন কালী থাকতে পারে...
গান গেয়ে বোঝালেন ঠাকুর, “ব্যাকুলতা হলেই অরুণ উদয় হল। তারপর সূর্য দেখা দেবেন। ব্যাকুলতার পরই ঈশ্বরদর্শন।
গানটি ঠাকুর আরও কয়েক জায়গায় উল্লেখ করেছেন কথাপ্রসঙ্গে।
পরের গানের কথা পাই কথামৃতকারের তৃতীয় দর্শনে ৫ই মার্চ ১৮৮২তে। বিশ্বাসের উপর আলোচনা হচ্ছে।
ঠাকুর বলছেন মাঝে মাঝে সাধুসঙ্গ আর মাঝে মাঝে নির্জনে থেকে ঈশ্বরচিন্তা করতে হয়। আর বিচার করতে হয়। তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হয়, আমাকে ভক্তি বিশ্বাস দাও। বিশ্বাস হয়ে গেলেই হল। বিশ্বাসের চেয়ে আর জিনিস নাই।
ঠাকুর বলছেন, যার ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে, সে যদি মহাপাতক করে -- গো, ব্রাহ্মণ, স্ত্রী হত্যা করে, তবুও ভগবানে এই বিশ্বাসের বলে ভারী ভারী পাপ থেকে উদ্ধার হতে পারে। সে যদি বলে আর আমি এমন কাজ করব না, তার কিছুতেই ভয় হয় না।” এই বলে ঠাকুর গান ধরলেন:
আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি।
আখেরে এ-দীনে, না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী ৷৷
এই গানটি ঠাকুর বিদ্যাসাগরের ঘরে, বলরাম মন্দিরে, ব্রাহ্ম সমাজে, দক্ষিণেশ্বরে মোট ছয়বার গেয়েছেন তার উল্লেখ পাই কথামৃতে।রচয়িতা অজ্ঞাত।
পরের গান ঐ একই দিনে। ৫ই মার্চ ১৮৮২। ঠাকুরের প্রিয় মানুষটি নরেনের কণ্ঠে।
কথামৃতকারের বর্ণনায় দৃশ্যটি এরকমঃ ভক্তেরা এদিক ওদিক পায়চারি করিতেছেন। মাস্টারও পঞ্চবটী ইত্যাদি স্থানে বেড়াইতেছেন, বেলা আন্দাজ পাঁচটা। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের দিকে আসিয়া দেখিলেন, ঘরের উত্তরদিকের ছোট বারান্দার মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার হইতেছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। নরেন্দ্র গান করিতেছেন, দুই-চারিজন ভক্ত দাঁড়াইয়া আছেন। মাস্টার আসিয়া গান শুনিতেছেন। গান শুনিয়া আকৃষ্ট হইয়া রহিলেন। ঠাকুরের গান ছাড়া এমন মধুর গান তিনি কখনও কোথাও শুনেন নাই। হঠাৎ ঠাকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া অবাক্ হইয়া রহিলেন। ঠাকুর দাঁড়াইয়া নিস্পন্দ, চক্ষুর পাতা পড়িতেছে না; নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বহিছে কিনা বহিছে! জিজ্ঞাসা করাতে একজন ভক্ত বলিলেন, এর নাম সমাধি! মাস্টার এরূপ কখনও দেখেন নাই, শুনেন নাই। অবাক্ হইয়া তিনি ভাবিতেছেন, ভগবানকে চিন্তা করিয়া মানুষ কি এত বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়? না জানি কতদূর বিশ্বাস-ভক্তি থাকলে এরূপ হয়। গানটি এই:
চিন্তয় মম মানস হরি চিদঘন নিরঞ্জন।
কিবা, অনুপমভাতি, মোহনমূরতি, ভকত-হৃদয়-রঞ্জন...
কথামৃতকারের ভাষায়ঃ গানের এই চরণটি গাহিবার সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শিহরিতে লাগিলেন। দেহ রোমাঞ্চিত! চক্ষু হইতে আনন্দাশ্রু বিগলিত হইতেছে। মাঝে মাঝে যেন কি দেখিয়া হাসিতেছেন। না জানি ‘কোটি শশী-বিনিন্দিত’ কী অনুপম রূপদর্শন করিতেছেন! এরই নাম কি ভগবানের চিন্ময়-রূপ-দর্শন? কত সাধন করিলে, কত তপস্যার ফলে, কতখানি ভক্তি-বিশ্বাসের বলে, এরূপ ঈশ্বর-দর্শন হয়? আবার গান চলিতেছে:
হৃদি-কমলাসনে, ভজ তাঁর চরণ,
দেখ শান্ত মনে, প্রেম নয়নে, অপরূপ প্রিয়দর্শন!
আবার সেই ভুবনমোহন হাস্য! শরীর সেইরূপ নিস্পন্দ! স্তিমিত লোচন! কিন্তু কি যেন অপরূপ রূপদর্শন করিতেছেন! আর সেই অপরূপ রূপদর্শন করিয়া যেন মহানন্দে ভাসিতেছেন!
এইবার গানের শেষ হইল। নরেন্দ্র গাইলেন:
চিদানন্দরসে, ভক্তিযোগাবেশে, হও রে চিরগমন ৷
(চিদানন্দরসে, হায় রে) (প্রেমানন্দরসে) ৷৷
সমাধির ও প্রেমানন্দের এই অদ্ভুত ছবি হৃদয়মধ্যে গ্রহণ করিয়া মাস্টার গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে হৃদয়মধ্যে সেই হৃদয়োন্মত্তকারী মধুর সঙ্গীতের ফুট উঠিতে লাগিল:
“প্রেমানন্দরসে হও রে চিরমগন।” (হরিপ্রেমে মত্ত হয়ে)।
গানটি চার জায়গায় উল্লেখ পাই কথামৃতে। ত্রৈলোক্যনাথ স্যান্যালের লেখা এই গানটি।
ঠাকুর নরেনকে দিয়ে গাওয়াতেন।
0 Comments