জ্বলদর্চি

দিল্লি দর্পণ- ৭

দিল্লি দর্পণ

৭ম পর্ব

কা লী প দ  চ ক্র ব র্ত্তী 

অতীতের কিছু কৃতি বাঙালি শিক্ষক এবং চিকিৎসকেরা  
 
দিল্লির কিছু বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন – শান্তিরঞ্জন মুখার্জী (হারকোর্ট বাটলার স্কুল), রমেশ সেনগুপ্ত, অজিত চক্রবর্তী, ডা.অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ গুহ এবং রবীন বাবু (রাইসিনা স্কুল), ব্রজমাধব ভট্টাচার্য (ইউনিয়ন একাডেমী),কমলা সেনগুপ্ত, মিসেস নাগ (লেডি আরউইন স্কুল), শুধাংশুবালা সান্যাল এবং সোহিনী গুপ্ত (বিদ্যাভবন, সুনীল সেনগুপ্ত (রাইসিনা স্কুল, সি আর পার্ক), প্রফুল্ল চন্দ্র সেন (গোল মার্কেটের এম বি স্কুল এর প্রধান) ইত্যাদি।এই প্রসঙ্গে জানাই, ব্রজমাধববাবু পেরু, ব্রাজিল, মেক্সিকো, বলিভিয়া এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলো ঘুরে এসে সুন্দর পাঁচটি ভ্রমন কাহিনী লিখেছিলেন। অক্সফোর্ড বুক হাউস থেকে তাঁর দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল – Alien Corn এবং Magic Casement । তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ – The Sun of Cyprus, এবং The History of Human Trade. ইংরেজিতে ব্রজমাধববাবু ১১টি বই লিখেছেন তারমধ্যে The Religion of Love অন্যতম।  
সত্যানন্দ মুখার্জী ১৯২০ সাল থেকে ২৫ বছর দিল্লির নামকরা সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের অধ্যক্ষের পদে ছিলেন।দেশবন্ধু কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ডা.এ এন ব্যানার্জী। ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজের অধ্যক্ষা হয়েছিলেন বীণা দাশগুপ্ত, ডা.আর কে দাশগুপ্ত টেগোর চেয়ার হোল্ডার এবং শিশির কুমার দাশ ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ মর্ডান ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজের প্রধান।এর পর এই পদে অধিষ্ঠিত হন জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানও ছিলেন এবং আজও  আছেন বেশ কিছু বাঙালি।দিল্লির কলা বিদ্যালয়ের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়,সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদা এবং মান্যতাপ্রাপ্ত বাঙালি শিল্পীরা এখানে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এসব বাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে কমল সেন, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ইত্যাদিদের নাম উল্লেখ যোগ্য। আরও ছিলেন নীহাররঞ্জন চৌধুরী, সত্যেন ঘোষাল, শৈলজ মুখার্জী ভাস্কর চিন্তামণি কর এবং অন্যান্যরা।দিল্লির আরও একজন গুণী মানুষ হলেন সাতকড়ি মুখোপাধ্যায়। তাঁর সাথে আলাপ হওয়ার সুযোগ এসেছিল। বিভিন্ন ধর্মের মূলতত্ত্ব জানার আগ্রহে তিনি অবেস্থা,প্রাচীন গ্রীক, লাতিন, পালি এবং কিছুটা ফরাসি ভাষাও শিখে নেন। একসময় বারাণসীর চৌখম্বা প্রকাশন সংস্থায় প্রধান সম্পাদকের পদেও ছিলেন।১৯৭৫ সালে দিল্লিতে এসে আমেরিকান লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের দিল্লি শাখায় যোগ দেন। সাতকড়িবাবু সাহিত্য অকাদেমির ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার’যোজনায় সহকারী সম্পাদকও ছিলেন।শ্রীমদ্ভগবত্গীতার শ্লোকগুলো তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল।এছাড়াও অসংখ্য নামকরা শিল্পী এবং ভাস্করেরা দিল্লির শিল্পকলাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন।বর্তমানে যেসব নামকরা শিল্পীরা দিল্লিতে আছেন তাদের মধ্যে হিমাদ্রি দত্ত এবং তড়িৎ মিত্র-র সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। দুজনেই সাহিত্য এবং নাটকের সাথেও বর্তমানে যুক্ত আছেন এবং দিল্লির সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে চলেছেন।   
শ্রদ্ধেয় ব্রজমাধব ভট্টাচার্য

অবাঙালি চিকিৎসকদের মধ্যে দিল্লি তথা উত্তর ভারতের এক সময় খুব নামকরা চিকিৎসক ছিলেন, হাকিম আজমান খান ও ডাক্তার এম. এ. আনসারী। জানা যায় তারা বহু রুগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন। এ দুজনেই পরে অখিল ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। সে কালে যে কোনও ভারতবাসীর কাছে এই পদ ছিল শ্রেষ্ঠ সম্মানের। সবথেকে দুঃখের বিষয় হল ডাক্তার আনসারী যিনি সারা জীবন লোকেদের সেবা করলেন ওষুধ দিয়ে, তিনি মৃত্যুর সময়ে ওষুধের একটি গুলিও পেলেন না।   
শ্রদ্ধেয়া কমলা সেনগুপ্ত

তবে চিকিৎসা ক্ষেত্রেও কিন্তু বাঙালিরা তাদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।তাই আজও  দিল্লিতে ভাল ডাক্তার বলতে অবাঙালিরা বাঙালি ডাক্তারদের কথা প্রথম ভাবেন। তাদের মধ্যে অল ইণ্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স-এর কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা.সুজয় বিজয় রায়, নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা.এ কে ব্যানার্জী এবং ভিমহানস এর ডাইরেক্টর ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। সফদরজং হাসপাতালের প্রাক্তন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ডা. বি কে ঘোরাই, ডা.তরুণ চ্যাটার্জী, ডা. এস পি মণ্ডল এবং ডা.ডি ডি ঘোষের নাম উল্লেখযোগ্য।এছাড়াও ছিলেন নামকরা ডা. ঘোষাল, ডা. টি এন ঘোষ,ডা.বি সাহা,ডা.সুরঞ্জন সেন এবং গাইনোকলজিস্ট ডা. ধর্মা চ্যাটার্জির (দক্ষিণ ভারতের কিন্তু বিয়ে করেছিলেন ডা. চ্যাটার্জী-কে) মত আরও অনেকে।একসময় ডিফেন্স কলোনির ফ্লাইওভারের বামদিকে সেন নার্সিং হোমেরও খুব নাম-ডাক ছিল। ডা. এস কে সেন এবং ডা. সীতা সেন-কে এককথায় অনেকেই চিনতেন কারণ তখন ভাল নার্সিংহোমগুলোর মধ্যে সেন নার্সিং হোম ছিল অগ্রণী।শুনেছি আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ-ও একসময় ওই নার্সিং হোমে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন।দিল্লির কর্নেল ডা.প্রণব দত্ত- র খুব সুনাম আছে। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত । বর্তমানে চিকিৎসা জগতে অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউটের মুকুরদীপি রায় (ক্যান্সার বিভাগ), ডা.উজ্জ্বল চৌধুরী (হৃদয় এবং নিউরো বিশেষজ্ঞ), ডা.তুষারকান্তি রায়,ডা.কল্যান ব্যানার্জী,ডা.কে কে ব্যানার্জী, ডা. কল্যান ভট্টাচার্য ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। এককথায় অনেক অবাঙালিরা এখনও ভাল ডাক্তার এবং শিক্ষক বলতে বাঙালিদেরই বোঝেন।বর্তমান সময়ে দিল্লিতে হোমিওপ্যাথির জন্য চিত্তরঞ্জন পার্কের ডা.কল্যান ব্যানার্জী সর্বজনবিদিত। 
আপনারা সকলেই পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্ত ড.সিদ্ধার্থ মুখার্জী-র নাম শুনেছেন। দিল্লির সফদরজঙ্গ এনক্লেভে এখনও তার পৈত্রিক বাড়ি আছে। যদিও তিনি বর্তমানে আমেরিকার বাসিন্দা। অনেকেই তাঁকে মাতৃমন্দির কালীবাড়ির মাঠে খেলাধুলা করে বড় হতে দেখেছেন। ড.মুখার্জীর পিতা ছিলেন মাতৃমন্দির কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন । ওনার মা এবং পরিবারের সকলেই খুব সাংস্কৃতিক মনস্ক। ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে তাঁদের পরিচয় আছে। এক সময়ে আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীও এই সফদরজঙ্গ এনক্লেভ-এ বসবাস করতেন।     
এছাড়াও অসংখ্য বাঙালিরা অতীতে বহু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং এখনও বহু বাঙালি দিল্লিতে বিভিন্ন সরকারী অফিসে বা প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত আছেন, যাদের নাম এই স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না।সবচেয়ে আমার যেটা ভাল লাগে তা হল এখানকার বহু বাঙালি এখনও আছেন, যারা উচ্চপদে থাকা সত্ত্বেও অহংকার তাদের গ্রাস করতে পারেনি।আজও  তারা বাঙালিদের সাহায্যে এগিয়ে যান। দিল্লির বাঙালিদের মন আজও  বাংলার জন্য কাঁদে। নাড়ির টান আজও  সবার মনকে নাড়া দেয়।যেসব গুণী মানুষদের নাম উল্লেখ করলাম এবং স্বল্প পরিসরের জন্য যাঁদের নাম উল্লেখ করা গেলনা, তাঁদের এক একজনকে নিয়ে এক একটি বই প্রকাশ সম্ভব।   
বর্তমানে দিল্লির আয়তন ক্রমশই বেড়ে চলেছে।লোকসংখ্যাও বেড়ে চলেছে বুলেট ট্রেনের গতিতে।বাঙালিও খুব একটা কম নেই সংখ্যায়। কথিত আছে দিল্লিতে বাঙালির সংখ্যা প্রায় কুড়ি থেকে বাইশ লক্ষ (অনেকে বলেন প্রায় ২৫ লক্ষ।) আশাকরি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। কারণ দিল্লিতে এখনও চাকরী এবং পড়ার সুযোগ আছে । তবে লোক সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার জন্য চাকরীর সুযোগও কমে আসছে।দিল্লিতে এখনও একটি জিনিস কিন্তু আছে, ১০০ নম্বরে ফোন করলে সাথে সাথে পুলিশের গাড়ি এসে উপস্থিত হয়।
এতক্ষণ বেশ গুরু-গম্ভীর কথা লিখলাম,এবার লেখা শেষ করার আগে একটি মজার জিনিস বলি, সেটি হল আপনারা অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে দিল্লির প্রায় সর্বত্র জায়গার নামগুলোতে ‘নগর’ আর ‘পুর’এর ছড়াছড়ি।বেশিরভাগ জায়গার নামগুলোর সাথেই ‘নগর’ বা ‘পুর’ যুক্ত আছে।আরও একটা মজার জিনিস হল, দিল্লিতে অনেক সরকারী বাসগুলোতেই দেখবেন সংক্ষেপে গন্তব্যস্থানগুলোর নাম লেখা থাকে, তাই নতুনদের পক্ষে প্রথম প্রথম বুঝতে একটু অসুবিধে হতে পারে। যেমন গুরু তেগবাহাদুর নগর-কে গু.তে.বা.নগর লিখতেও দেখেছি।এরকম আরও অনেক আছে। কেন্দ্রীয় লোক নির্মাণ বিভাগ-কে সংক্ষেপে কে.লো.নি.বি. দেখে বেশ চমকে উঠেছিলাম শুরুর দিকে।  
আগামী সপ্তাহে হাজির হবো নতুন বিষয় নিয়ে। 

তথ্যসূত্র – দিল্লির চাঁদনিচকে কিছুকাল – পূষন কুমার দত্ত
        লালকেল্লা – প্রমথনাথ বিশী
        দিল্লির বাঙালি – চিত্তরঞ্জন পাকড়াশী 
        কৃতজ্ঞতা স্বীকার – ছবি - প্রবীর কুমার ঘোষ মহাশয়ের সৌজন্যে   
        কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রীযুক্ত শেখর ঘোষ মহাশয়

Post a Comment

6 Comments

  1. সিরিজটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। লেখকের লেখনী তে গভীর ঋদ্ধতা প্রকাশ পায়।

    ReplyDelete
  2. খুব‌ই সুন্দর ও তথ‍্যবহুল লেখা

    ReplyDelete
  3. খুব‌ই সুন্দর ও তথ‍্যবহুল লেখা

    ReplyDelete
  4. আপনার এই তথ্যবহুল লেখাটি পড়ে স

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লাগল বিষয় গুলো জানতে পেরে । সুন্দর উপস্থাপনা ।

    ReplyDelete
  6. তথ্য সমৃদ্ধ সাবলীল লেখা ।পাঠক উন্মুখ থাকে পরবর্তী সংখ্যা পড়ার জন্য ।

    ReplyDelete