জ্বলদর্চি

জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা জরুরি/ মহাশীষ মাহাত

নিজের স্বার্থে, সমাজ- সভ্যতা রক্ষার স্বার্থে এবং মহামারী রোধে
জীববৈচিত্র্য কে রক্ষা করা জরুরি
   
 মহাশীষ মাহাত

সারা বিশ্বের অতুলনীয় জীববৈচিত্র্য ধীরে ধীরে ধ্বংশ হচ্ছে। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য এখন খাদের কিনারায়। '  ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসী প্লাটফর্মে'র এক সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে বর্তমান বিশ্বের ১০ লক্ষ প্রাণী ও উদ্ভিদ কূল লুপ্তপ্রায় হওয়ার আশঙ্কায় দিন গুনছে। ভারত সহ পৃথিবীর ১৩২ টি দেশে চলা সমীক্ষার ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
 জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বৈচিত্র্য দিয়েই পরিবেশ এবং বৈচিত্র্য দিয়েই পরিবেশতন্ত্র । সুপরিকল্পিতভাবে জীববৈচিত্র্য কে রক্ষা করতে না পারলে পৃথিবীর সংকট অনিবার্য। জলবায়ু পরিবর্তন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, গ্রীন হাউস গ্যাস ইত্যাদি শব্দগুলোর সঙ্গে  মানুষের পরিচিত বেড়েছে, কিন্তু সতর্কতা ও সচেতনতা তেমন ভাবে বাড়েনি। সুজলা- সুফলা- শস্য- শ্যামলা প্রিয় আমাদের মাতৃভূমিও দিনে দিনে তার জীববৈচিত্র্যের গরিমা হারাচ্ছে। সঙ্গে হারিয়ে যাতে বসেছে ঋতুবৈচিত্র। ষড় ঋতুর আমেজ আর তেমন ভাবে নেই। ঋতু তার সৌন্দর্যের রূপ- রস - গন্ধ- মাধুরী হারিয়ে চিরচেনা থেকে অচেনা- অজানা, অস্বাভাবিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চিরচেনা সেই দৃশ্য- সারি সারি সবুজ গাছ , পশু- পাখি, বনজঙ্গল, উপকারী কীটপতঙ্গ, নদী- নালা, খাল - বিল, জলাশয়, পুকুর , ডোবা ইত্যাদি আধুনিক নগর সভ্যতা নির্মাণের  নির্মম কষাঘাতে পিষ্ট হচ্ছে। বহুতল ভবন, সড়ক, মহাসড়ক  নির্মাণ, শিল্প- কলকারখানার বর্জ্য পদার্থে নদ নদী তার স্বমহিমার নাব্যতা হারাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকভাবেই জীববৈচিত্র্যের উপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। প্রকৃতি বিপর্যয়ের চেয়ে মানুষের নির্মমতায় জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে বেশি।
জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুয়ায়ী নিসর্গ ও জীববৈচিত্র্য নিজস্ব নিয়মে গড়ে ওঠে। এর ভাঙ্গা গড়াও হয় এক অনিবার্য পরিণতিতে। আধুনিক সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা, বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে প্রবল ভাবে দূষিত হচ্ছে মাটি, জলবায়ু, মূলত এর ফলেই  পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরেই আখেরে প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হচ্ছে। এর ভয়ঙ্কর পরিনাম স্বরূপ  জীববৈচিত্র্যের হ্রাস এবং সংকট ক্রমশ বাড়ছে ।  

অরণ্য ধ্বংসের কারণে সপুষ্পক উদ্ভিদের মোট প্রায় ১০% প্রজাতি  বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০টি বেশি হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। কোন নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, গাছপালা,  এবং অনুজীবের ভিন্নতা রয়েছে প্রকৃতির মাঝেই এদের অকৃত্রিম বসবাস। এরাই পরিবেশকে বৈচিত্র্য দান করে। পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৫০% এর অধিক জীব প্রজাতি গ্রীষ্মমন্ডলীয় আদ্র বনাঞ্চলে বিদ্যমান। পৃথিবী থেকে প্রায় প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো প্রাণী কিম্বা উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পূর্বেই বলেছি এর নানাবিধ রয়েছে; কিন্তু এর মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক  কারণ,  প্রকৃত কারণ, এবং মানবসৃষ্ট কারণ প্রধান। বিজ্ঞানীদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা পৃথিবীতে  স্তন্যপায়ী প্রাণীর অর্ধেকের বেশি  আজ বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচীর হিসাব অনুযায়ী এখনো  বিশ্বে প্রায় ২২ কোটি  জীব প্রজাতি রয়েছে। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে প্রায় ৭০ লক্ষ  জীব প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। নানা প্রজাতির তিন চতুর্থাংশ পাখি , ৩০ শতাংশ মাছ, ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে। এক গবেষণায় তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজ্যের পুঁটি, টেংরা সহ ৮১টি প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। 
  বনজঙ্গলে পূর্ণ আমাদের তথাকথিত জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম জেলাতেও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। গাছগাছালির মধ্যে মহুল, কেঁদ, পিয়াল, আতা, বৈহচি ইত্যাদি। মাছেদের মধ্যে লুলি ( এক জাতীয় খুব ছোট মাছ), পুঁটি , মাগুর, চেঙগ, লেঠা,  টেংরা, পাঁকাল, কৈই ইত্যাদি, পাখিদের মধ্যে কাক, চিল, শকুন, বাবুই , চড়ুই, বাদুড়, চামচিকা, মাছরাঙা, বেনেবউ, ইত্যাদি। আগে গ্রামে গ্রামে তালগাছে বাবুই পাখির বাসা দেখা যেতো এখন আর খুব একটা তেমন দেখা যায় না বললেই চলে। ছোট বেলায় দেখতাম রঙ - বেঙের ছোট ছোট কত প্রজাপতি। তাদের আর দেখা য়ায় না।
আমাদের ছোট ছোট অসেচতনতা, অপরিণামদর্শী কাজ কর্মই জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ডেকে আনছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি বদলের। সবাইকে আজ নিজেদের স্বার্থে,  সমাজ -  সভ্যতার স্বার্থে জীববৈচিত্র্য কে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে। এবিষয়ে এখনো যা সম্ভাবনা রয়েছে তাকে আরো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পরিকল্পিত যৌথ উদ্যোগে রক্ষা করতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে।
আমাদের পৃথিবী বিভিন্ন প্রজাতির, রঙের , বর্ণের, আকৃতির জীবকূল নিয়ে গঠিত। এদের মধ্যে আছে যেমন পরজাতিগত বৈচিত্র্য, ঠিক তেমনি আছে বাসস্থানগত বৈচিত্র্য। আবার সবথেকে মজার ব্যাপার হলো জিনগত বৈচিত্র্যতাও পরিলক্ষিত হয় জীবকূলের মধ্যে।আর এই সব কিছু নিয়েই গঠিত জীববৈচিত্র্য বা Biodiversity.  শব্দটি প্রকৃত অর্থ দাঁড়ায় প্রাণের বৈচিত্র্য। বিভিন্ন বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্রে একটি অপরটির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্ক যুক্ত। একটির পরিবর্তনে অপরটির পরিবর্তন অনিবার্য। একটির ধ্বংস সাধিত হলে আর একটিও অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবেই। পৃথিবীর প্রতিটি জীব একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে যত বেশি জীবনের বৈচিত্র্য থাকবে ততোই মঙ্গল মানবসভ্যতার জন্য। তাই আসুন নিজের স্বার্থে, প্রাণের স্বার্থে, সমাজ সভ্যতার স্বার্থে এবং মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে জীববৈচিত্র্য কে রক্ষা করার শপথ গ্রহণ করি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার
পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ
মোশারফ হোসেন
এই সময় পত্রিকা
কথামালা সেন

Post a Comment

0 Comments