স্বাধীনতা ও দেশভাগ- ইতিহাস ও সাহিত্য
পা র্থ সা র থি চ ক্র ব র্তী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ব্রিটিশরাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে তারা ভারত থেকে নিজেদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেবে। তার পেছনে কারণ ছিল বিশ্বজুড়ে শক্তির মেরুকরণ ও ভারতে ছড়িয়ে পড়া ব্রিটিশবিরোধী গণ আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা। ভাইসরয় ওয়াভেল ক্ষমতা হস্তান্তরের ইঙ্গিত দেন। তিন মাসের মধ্যে দেশে আসে কেবিনেট মিশন। তাদের প্রস্তাবেই নিহিত ছিল বিভেদের বীজ।কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নিজের নিজের অবস্থানে অনড় থাকে। বিরোধের পথ প্রশস্ত হয়। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। যার প্রভাব বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৭ র গোড়ায় মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন ভাইসরয় হয়ে। শেষ পর্যন্ত দাঙ্গার রক্ত ধুয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা পায় দেশ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা ও পাঞ্জাব। এই প্রদেশ দুটিও বিভক্ত হয়ে যায় ।প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায়। কয়েক লাখ মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ধর্মীয় ভিত্তিতে, অবিশ্বাস ও অনৈক্যের যুক্তি দিয়ে জোর করে সৃষ্টি হয় এক নতুন দেশ- পাকিস্তান।এই জন্মের যন্ত্রণা আজও লাঘব হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ ই আগস্টের মতোই আজও দগদগে। তারপর আবার ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ।
সাহিত্য মানুষের অভিজ্ঞতার চিত্রায়ন। শিল্পরূপ। কিন্তু এই দেশভাগ বাঙালির সাহিত্যে শুরুতে ততটা প্রভাব ফেলেনি যতটা ফেলা উচিত ছিল বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। কৃষন চন্দর, সাদাত হাসান মান্টো, ভীষ্ম সাহানি, খুশবন্ত সিং এর মতো লেখকরা যেভাবে এই বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন, বাংলা সাহিত্যে সেটা সহজে হয়নি। বাংলা সাহিত্যে কিছু ছোটগল্প এলেও উপন্যাস আসতে অনেক সময় নিয়েছে। প্রথম উপন্যাস জ্যোতির্ময়ী দেবীর 'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা'।
দুই সম্প্রদায়কে আলাদা করতে গিয়ে বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করা হয়। এই ক্ষত আজও শুকোয়নি। দেশভাগের কারিগরেরা মনে করেছিলেন যে, দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে আলাদা করে দু'দিকে বসবাসের ব্যবস্থা করলে সংঘাত ও রক্তপাত এড়ানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে হলো তার উল্টো। যে ব্যবস্থা রক্তপাত এড়াবে বলে মনে করা হচ্ছিল, তা রক্তপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিংশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা ' binary opposition ' বা ' যুগল বৈপরীত্য 'বলে একে ব্যাখ্যা করেছেন। জাতিসত্তার ধুয়ো তুলে দেশটাকে ভাগ করা হলো তা ছিল এক ভ্রান্ত দর্শন ছিল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হলো। সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চারুকলা সর্বত্র। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগ নিয়ে পরবর্তীতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশ হয়েছে। তুলনায় বাংলাদেশে এই নিয়ে গবেষণা ও চর্চা খুব কম।তার কারণ অনুসন্ধানযোগ্য।
দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে দেশভাগের ইতিহাস ও তার যন্ত্রণা। তার কয়েকটির উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা যেতে পারে।
পূর্ব-পশ্চিম: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়--
ভারত এবং পাকিস্তান, এই দুই দেশ ভাগ করা নিয়ে বাংলায় লেখা এই উপন্যাসটি অনেকের কাছেই অন্যতম প্রিয়। ধর্মের অজুহাতে ও রাজনৈতিক স্বার্থে দিনের পর দিন একসাথে থাকা মানুষগুলো একে অপরের থেকে আলাদা হলো এই এক সিদ্ধান্তের ফলে। যদিও বইটিতে মূলত দুই বাংলার বিভাজনই বিষয়বস্তু। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার প্রায় একই। বাপ-ঠাকুর্দাার ভিটে ছাড়া হলেন। হলেন কর্মহার। সরকার ও রাষ্ট্র হিমশিম খেয়ে গেল উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে। করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এহেন প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাস।
দেশ বিভাগ: ফিরে দেখা / আহমদ রফিক--
দেশভাগের ট্র্যাজেডি ফুটে উঠেছে এই বইটিতে। লেখক ধর্মনিরপক্ষেভাবে তথ্য অনুসন্ধান করে বইটি লেখেন। ইতিহাসের বিশ্লেষণ করেছেন। এতে কয়েকজন দেশনেতাকে তাদের ভুলের জন্য দায়ী করেছিলেন। যা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।
কেয়াপাতার নৌকা: প্রফুল্ল রায়---বাংলাদেশ ( পূর্ব পাকিস্তান)থেকে বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের নিদারুণ কষ্ট তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তী দুটি অংশ 'শতধারায় বয়ে যায় ' ও ' উত্তাল সময়ের ইতিকথা 'ধরতে গেলে এই উপন্যাসেরই অন্তর্ভুক্ত। তিনটি মহাকাব্যিক গ্রন্থে অসামান্য ভাষায় প্রাঞ্জলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে কষ্টের কথা।
আগুনপাখি: হাসান আজিজুল হক --একটি গাঁয়ের মেয়ে, যার কাছে আত্মীয় আর চারপাশের মানুষজন ছাড়া আর কেউ নেই। হিন্দু-মুসলিম সংহতির পরিবেশে সে বড় হয়। হঠাৎ যেন সব পাল্টে যায়। শুনতে পায়, দেশটাও নাকি ভাগ হয়ে যাবে! তা কি করে হয়! অবিশ্বাস্য সেই ঘটনাও সত্যি হয় চোখের সামনে। একে একে সবাই চলে গেলেও সে কিছুতেই যেতে চায় না।
Train to Pakistan:Khuswant Singh-- " In the summer of 1947, when the creation of the new state of Pakistan was formally announced, ten million people- Muslims and Hindus and Sikhs-were in flight. By the time the monsoon broke, almost a million of them were dead, and all of northern India was in arms, in terror, or in hiding. The only remaining oases of peace were a scatter of little villages lost in the remote reaches of the frontier.One of these villages was Mano Majra "- বইটির সারমর্ম। বোঝা যায়, কি নিদারুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন ছিল দেশ।
Midnight Children: Salman Rushdie--১৯৮১ তে প্রকাশিত এই উপন্যাস। " It's a loose allegory of events in India both before and primarily, after the independence and partition of India. The protagonist and narrator of the story is Saleem Sinai, born at the exact moment when India became Independent country. " এই বইটি বুকার প্রাইজ পেয়েছিল।
দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে রচিত বহু কাহিনী আলোচনায় আসতে পারে। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার সময়েও দ্বিজাতিতত্ত্বের শেষ পেরেকটা পুঁতে দেয় দেশের মেরুদণ্ডে। প্রাপ্তির ভাঁড়ারে - দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প সর্বত্র জাতিবিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টি করে দেয় এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
ভারতের স্বাধীনতার আনন্দকে দেশভাগের যন্ত্রণা বহুলাংশে ম্লান করে দেয়।
সূত্র: উল্লিখিত উপন্যাস সমূহ ।
0 Comments