শতভিষা ঘোষ
ছেলেবেলার ধুলোপথ থেকে কলকাতার গলিপথ, গ্রামের কুয়াশা থেকে শহরের কাঁটাতার, অপু পেরিয়ে আসে— স্বপ্ন নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে, আর এক ফাঁকা বুক নিয়ে।জীবনের ফাঁকে তৈরি হয় এক “অপুর সংসার"। “কাজল"এর হাত ধরে অপুর যাত্রা তাই কখনও শেষ হয় না— পৌঁছায় “অপরাজিত" জীবনের দোরে।
“চারুলতা" তখনও জানালার ধারে দুলছে নিঃশব্দ পিয়ানোর সুরে। বাইরের দুনিয়ার বাতাসটা কেবল একটু অনুভব করতে চাইছে দূর থেকে।
দু’জনেই খুঁজছে মুক্তি—
একজন অনন্ত যাত্রার খোঁজে, আরেকজন আবদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির আশায়।
ব্যথার সুরে বাজে জলসাঘর - এক বেহালার টানে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের ছায়া, যেখানে রাজা একা, অথচ চারপাশে শূন্যতা ভরপুর।
অন্ধকার রাজত্বে আলো জ্বালায় গুপী-বাঘা। অজানা রাজ্যের যুদ্ধ থেমে যায় সুরের মূর্ছনায়। মগজধোলাই প্রাসাদে হীরক রাজার কানে বাজে অস্বস্তির শব্দ—“নহি যন্ত্র, নহি যন্ত্র, আমি প্রাণী।" বিপ্লব আসে হীরক রাজ্যে।
হেঁটে যায় এক ”নায়ক"—
বাহিরে সাফল্যের আলো, ভিতরে এক গভীর অন্ধকার, যার মুখোশ খুলে ফেললে দেখা যায়-- আমরাও সেই একই ক্লান্ত মুখের যাত্রী।
মাঠের শেষে দাঁড়ায় এক মায়াবী দুর্গ, সোনার কেল্লা—যেখানে ছোট্ট মুকুলের স্মৃতি আর স্বপ্ন একসাথে ছুটে চলে। রহস্যের কুয়াশা ভেদ করে আসে “বন্ধু ফেলুদা"। ঠান্ডা মাথা, তীক্ষ্ণ চোখ, স্থির মন। তার হাতে অস্ত্র নেই, পেছনে ক্ষমতা নেই, কিন্তু আছে বুদ্ধির বলয়ে গড়া এক বিপ্লবী অস্ত্র, মগজাস্ত্র- যা দিয়ে ফেলুদা খুনির মন পড়ে ফেলে, শঙ্কু সভ্যতা রক্ষা করে, আর সত্যজিৎ রায় তার ক্যামেরা দিয়ে সমাজের ভেতর ঢুকে
একটি চরিত্রের চাহনি দিয়ে তুলে ধরে গোটা যুগকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জটায়ু অবলীলায় বলে ফেলে জীবনের সহজ হাসির ফাঁকে ফাঁকে থাকা গভীর অনুভব গুলোকে।
জটায়ুর কলম থেমে যায়।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ে এক আগন্তুক। সে প্রশ্ন করে না উত্তর পাওয়ার জন্য, সে প্রশ্ন তোলে ভাবনার জন্য। এক অচেনা অথচ চেনা মানুষ,যার প্রতিটি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে সভ্যতার ছাঁচে গাঁথা অস্তিত্ব।
নিউটনকে পাশে নিয়ে ডায়েরির পাতায় বসে শঙ্কু— বিজ্ঞানের মধ্যেও খোঁজে নৈতিকতা, বিজ্ঞান আর কল্পনার মাঝে দাঁড়িয়ে মানবতাকে জাগিয়ে তোলে নতুন প্রশ্নে!
এই সব চরিত্রেরা কেউ একা নয়, কেউ আলাদা নয়। তারা সবাই মিলে এক সুতোয় গাঁথা হয়ে গড়ে তোলে এক সত্যজিৎ-ভুবন-- যেখানে জীবন, কল্পনা, বাস্তব আর স্বপ্ন একসাথে হাঁটে, হেসে ওঠে, আর প্রশ্ন তোলে।
তুমি বলোনি কখনো “আমি রাজা!"
গোটা দেশ বলেছে, বিশ্ব বলেছে তোমায় “মহারাজা তোমারে সেলাম!"
তুমি গল্প লেখনি, তুমি সিনেমা বানাওনি তুমি পর্দার আচ্ছাদনে ঢাকা জীবনটাকে চিনিয়েছিলে নতুনভাবে, নতুনরূপে।
ভেঙে যাওয়া বারান্দায় বসা চারুলতার আবদ্ধ জীবন দিয়ে,
বাস ছুটিয়ে ফেলা অপুর অনন্ত যাত্রার মধ্য দিয়ে,
নির্ভার অথচ ভীষণ সচেতন ফেলুদার মগজাস্ত্রের তীক্ষ্মতা দিয়ে,
অবচেতন চেতনার সেই আগন্তুকের প্রশ্ন দিয়ে...
যেখানে গল্প বলে না,
গল্প জেগে ওঠে।
শুভ জন্মদিন চিরকালীন, অতুলনীয়, অপরাজিত।
🍂
0 Comments